ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
আদম মালেক : রোহিঙ্গা নিধন চলছে। নাফ নদীতে ভাসছে লাশ। লম্বা হচ্ছে লাশের মিছিল। লাশ দেখতে গিয়ে ফিরে গেল কফি আনান কমিশন। দেখতে পারলো না গণহত্যার চিত্র ও রোহিঙ্গাদের গণকবর। গত ৯ অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূল অভিযানে নেমেছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী জাতীয় উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির প্রশাসন। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সফরে যায় জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশন। ঢুকতে পারেননি চরম নির্যাতনকবলিত এলাকায়। রাখাইন মুসলিমদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে ৪ রোহিঙ্গা মুসলিমকে ধরে নিয়ে যায় সেনাবাহিনী। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করা সম্ভব হয়নি আনানের পক্ষে। তবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতাকে তিনি গণহত্যা বলতে নারাজ। তিনি বলেন, সেখানে উত্তেজনা আছে, ভয় আছে, আছে অবিশ্বাস। উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভয়ের মধ্যে আছে। সেখানে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আমি বিষয়টিকে সেদিকে নিয়ে যেতে চাই না অন্যরা যা করছেন। এ জন্য তিনি পর্যবেক্ষকদের গণহত্যা শব্দটি ব্যবহারে খুবই সতর্ক থাকার উপদেশ দেন। এভাবে তিনি এড়িয়ে গেলেন রোহিঙ্গা নির্যাতনের ভয়াবহতা। প্রকাশ করেননি সভ্রমহারা রোহিঙ্গা নারীর অপমানের যন্ত্রণা। দেখাতে চাননি সেনা কর্তৃক দুগ্ধপোষ্য রোহিঙ্গা শিশুকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের বীভৎসতা। তার বর্ণনায় উঠে আসেনি সেনার আগুনে দগ্ধ রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ির পোড়া চিত্র। তিনি বেমালুম অস্বীকার করেন পলাতক রোহিঙ্গাদের, তাদের পোড়া ভিটামাটিতে পুনরায় ঘর তুলতে সেনাদের বাধাদানের কথা। আনান যেমন সত্য গোপন করেছেন তেমনি সৃষ্টি করেছেন বিভ্রান্তি। তিনি উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের কথা বললেও আমরা এখনও শুনিনি রোহিঙ্গাদের ভয়ে কোন বৌদ্ধ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। আমাদের নজরে আসেনি কোন রোহিঙ্গা পুরুষের কাছে কোন বৌদ্ধ তরুণীর সম্ভ্রম হারানোর তথ্য। তবুও তিনি বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আগ্রাসী বৌদ্ধদের ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার কাল্পনিক ছবি অঙ্কন করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন। তিনি বলছেন, সেখানে যুদ্ধ চলছে। আমরাতো সেখানে কোন যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি না। যুদ্ধ হলে তো উভয় পক্ষের মধ্যে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বৌদ্ধদেরও ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হওয়ার কথা। সেখানে কোন বৌদ্ধের বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের খবর পাওয়া যায়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা-মগদের একচেটিয়া নির্যাতন। এই একচেটিয়া নির্যাতনকে কফি আনানের যুদ্ধ ঘোষণা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এর মধ্যে মাত্র একজন মিয়ানমার সেনা নিহত হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পরিকল্পিত বিরতিহীন সহিংসতা ও বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে পার্থক্য করতে তিনি ভুলে গেছেন। তিনি এত বড় বর্বরতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি না দিয়েও প্রকৃত সত্য গোপন করেছেন। এ কারণেই টনক নড়েনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির। তিনি গণহত্যা বন্ধের নির্দেশ তো দূরের কথা তার বিরোধিতাও করেননি, উল্টো দুষেছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। আন্তর্জাতিক মহলের ‘নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’ মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার অভিযোগের তীরে বিদ্ধ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বিশ্বসম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে তার অভিযোগের বিষমাখা ছুরি থেকে মুক্তি মেলেনি বাংলাদেশেরও। বিশ্ব মোড়েল রাষ্ট্রগুলোও নীরবতা পালন করে চলেছে। অথচ ঢাকার হলি আর্টিজানে ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রাশিয়া ও কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ। নিন্দা জানাতে ভোলেননি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। অথচ মিয়ানমারে আড়াই মাস ধরে চলা গণহত্যায় একমাত্র মালয়েশিয়া ও তুরস্ক ছাড়া ভারতসহ বিশ্বমোড়ল দেশগুলো নীরব রয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাই, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করুন। মিয়ানমার এমন কোন পরাশক্তি নয় যে দেশটির বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর শক্তি বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও জনগণ আপনার পাশে রয়েছে। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেছেন, “প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সে দেশের সরকারি বাহিনী পরিচালিত সুপরিকল্পিত ও বর্বরোচিত ‘জেনোসাইড’-এর ঘটনায় আমি গভীরভাবে বেদনাহত ও উৎকণ্ঠিত। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, গভীর পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোনো সামরিক জান্তা নয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সু চির নেতৃত্বে পরিচালিত মিয়ানমারের প্রশাসনই এ অমানবিক সন্ত্রাসী কার্যকলাপের হোতা। যিনি নিজে দীর্ঘকাল নির্যাতিত হয়েছেন তিনি কী করে এমন পৈশাচিক কাজকে অনুমোদন করছেন, ভেবে আমরা স্তম্ভিত হচ্ছি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর কী হচ্ছে! মানুষের ওপর এত অত্যাচার-নির্যাতন কখনো শুনিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিন, তাদের বাঁচান। অনেকেই ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের বিরোধিতা করেছে একশ্রেণীর খুদ-কুঁড়া খাওয়া বুদ্ধিজীবী। এরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে কেবল। যেখানে অনেক পরে হলেও জাতিসংঘসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কারণে সমালোচনায় পড়েছে মিয়ানমার সরকার সেখানে আমাদের দেশের কথিত বুদ্ধিজীবীর রোহিঙ্গাদের মাঝে ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ আর জঙ্গিপনা আবিষ্কারে ব্যস্ত, কারণ জঙ্গিবাদের তকমা লাগিয়ে মুসলিম বিরোধিতাও কারও কারও কাছে একধরনের ফ্যাশন। কেউবা তাদের মাঝে খুঁজে বেড়ায় মাদক চোরাচালান ও সামাজিক অস্থিরতাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক উপসর্গ। মানবতা যেখানে বিপন্ন সেখানে বেপরোয়া কি নিরীহ হিন্দু কি মুসলিম, বৌদ্ধ কি খ্রিস্টান, আস্তিক কি নাস্তিক তা বড় প্রশ্ন নয়। বড় কথা হল, এরা দুনিয়ার সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ। তাই এই মুহূর্তে নিজেদের মানবতা বিসর্জন দিয়ে দোষত্রুটি আবিষ্কারের চেয়ে তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ অনেক জরুরি। তারা এ পৃথিবীর সন্তান ও আরাকানের ভূমিপুত্র। নিজ দেশে তারা পরবাসী। একদিন তারা স্বাধীন ছিল। জীবনের ভাঙ্গাগড়ার খেলায় তাদের আরাকান রাজ্য আজ মিয়ানমারের উপনিবেশ। কিন্তু উপনিবেশের বাসিন্দা হিসেবে বৃটিশ সরকারের কাছে আমাদের যে অধিকার ছিল মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সে অধিকারটুকুও নেই। তারা আরাকানের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেশের নামটিও কেড়ে নিয়েছে। আরাকানের পরিবর্তে দেশটির নাম রাখে রাখাইন রাজ্য। মিয়ানমার সরকারের অনুমতি ছাড়া তারা বিয়ে করতে পারে না। দুয়ের অধিক সন্তান গ্রহণ নিষিদ্ধ। রাখাইন রাজ্য থেকে বের হওয়ার কোন সুযোগ তাদের নেই। এর ওপর রয়েছে মিয়ানমার সরকারের নিয়মিত রোহিঙ্গা মুসলিম নির্মূল অভিযান। মিয়ানমারের বর্বরোচিত হত্যাকান্ডে হাজার হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু যখন প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের দেশের অসুস্থ চিন্তার বুদ্ধিজীবীরা তার জন্য ক্ষুব্ধ না হয়ে আইসিজির কারখানায় উৎপাদিত হারাকা আল ইয়াকিনের নামে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আমরা আশা করতে চাই, গণহত্যা ও রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার অপরাধে অং সান সু চির প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সংসদে একটি নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।