Inqilab Logo

বুধবার, ২৬ জুন ২০২৪, ১২ আষাঢ় ১৪৩১, ১৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নারীসহ নিহত ২ : চার জনের আত্মসমর্পণ

রাজধানীর আশকোনায় ১৬ ঘণ্টাব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযান

| প্রকাশের সময় : ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় প্রায় ১৬ ঘণ্টার পুলিশি অভিযানে জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ দু’জন নিহত হয়েছেন। ‘জঙ্গি আস্তানা’ সন্দেহে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ অভিযানটি হয়েছে রাজধানীর আশকোনায় হাজি ক্যাম্পের কাছে ‘সূর্য ভিলা’ নামের একটি বাড়িতে। প্রায় ১৬ ঘণ্টা অভিযান চালায়। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে শুরু হওয়া এই অভিযান গতকাল শনিবার বিকেল পৌনে চারটায় শেষ হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানিয়েছেন, আশকোনার জঙ্গি আস্তনায় অভিযান শেষ হয়েছে। এ অভিযানে দুই জন নিহত ও চারজন আত্মসমর্পণ করেছে।
দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় হজ ক্যাম্পের কাছে তিন তলা বাড়ি সূর্য ভিলায় গতকাল শনিবার ভোররাতে অভিযান শুরু করে বিকালে তা শেষ হয়। তিন তলা ওই বাড়ির নিচ তলার জঙ্গি আস্তানায় এখনও অনেক বিস্ফোরক পড়ে আছে বলে কাউকে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ।
বিকাল পৌনে ৪টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সামনে এসে অভিযানের সমাপ্তির কথা জানান।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তিনটি গাড়িতে করে ৩০-৩৫ জন ঘটনাস্থলে যান। এ সময় দাঙ্গা পুলিশের ছিলেন ৪০ জন। আর পুলিশের উত্তরা বিভাগের তিনটি গাড়িতে করে পুলিশ সদস্যরাও সেখানে যান। ‘নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতার’ সন্ধান করছিল কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।
শুরুতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ‘সূর্য ভিলা’ বাড়ির পাশের একটি বাড়িতে তল্লাশি চালান। এরপর তারা নিশ্চিত হন, ‘সূর্য ভিলা’ বাড়িতে ‘জঙ্গি আস্তনা’ আছে। এরপর রাত সাড়ে ১২টার তারা ওই বাড়িটি ঘিরে ফেলেন। রাত চারটার দিকে সোয়াত দল সেখানে যোগ দেন। ভোর পাঁচটার দিকে ঘটনাস্থলে যান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। পরে ঘটনাস্থলে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, বাড়িটিতে ‘নব্য জেএমবির শীর্ষ এক নেতা’ রয়েছেন। এ ছাড়া নারীসহ একাধিক জঙ্গি রয়েছেন। জঙ্গিদের কাছে শক্তিশালী গ্রেনেড রয়েছে। তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। তবে তারা শরীরে গ্রেনেড বেঁধে প্রতিরোধের ঘোষণা দিচ্ছে।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দুই শিশুকে নিয়ে দু’জন নারী আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। এই চারজন হলেন মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি ও সাবেক মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, তাঁর মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তাঁর মেয়ে। তাদের মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ওই বাড়ির মালিকের বড় মেয়ে জোনাকি রাসেল দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, গত ১ সেপ্টেম্বর মো. ইমতিয়াজ আহমেদ পরিচয় দিয়ে একজন নিচতলার বাসাটি দেখতে আসেন। তখন ওই ব্যক্তি নিজেকে অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন যে, বাসায় তিনি, তাঁর স্ত্রী ও এক বাচ্চা থাকবে। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর বোন এসে থাকবেন। ১০ হাজার টাকায় তিনি বাসাটি ভাড়া নেন। ৩ সেপ্টেম্বর পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে ওঠেন। বাসা ভাড়া দেওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন। বাসায় ল্যাপটপ, খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উনারা কখনো বের হতেন না। বাসায় ওঠার সময় বাচ্চার বয়স ছিল ৪০ দিন।’ কেন বের হন না? জানতে চাইলে বলতেন, হিজড়ারা বাচ্চা দেখলে টাকা চায়। সে কারণে বের হন না। তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে দুজন নারী ওই বাসায় আসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মা ও এক আত্মীয়। গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন।’
দুপুরে এডিসি ছানোয়ার হোসেন বলেন, ওই বাসায় আরও তিনজন ছিল। তাদের বের হওয়ার জন্য পুলিশ এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিয়েছিল। বারবার তাদের হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি। দুপুর সাড়ে ১২টার একটু পরে নিচতলা বাসার দরজা খুলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন এক নারী। কীভাবে ওই ‘জঙ্গি’ নারী বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। আরও তিনজন ওই বাসায় ছিল। তিনি নিজে ওই বাড়ির গাড়ি পার্কিংয়ের পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জানিয়ে বলেন, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি দেখতে পান বোরকা পরা একজন নারী বাঁ হাতে একটি মেয়েশিশুকে ধরে বাসার দরজা খুলে বাইরে এসেছেন। ওই দুজন পার্কিংয়ের দিকে আসছিলেন। তখন তিনি তাঁদের দাঁড়াতে বলেন। বারবার বলেন হাত তুলতে। কিন্তু ওই নারী দাঁড়াননি। তিনি শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। একপর্যায়ে বাঁ হাতে শিশুটিকে ধরে রেখে ডান হাত ওপরের দিকে তোলার মতো ভঙ্গি করেন। তবে তখন তিনি কোমরে রাখা বিস্ফোরকে চাপ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই নারীর মৃত্যু হয়। বিস্ফোরণে আহত এক শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তখনো বাড়ির ভেতরে আজিমপুরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরির ছেলে ছিল বলে ধারণা করা হয়।
বেলা তিনটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গি নারী মারা গেছেন। ভেতরে থাকা আরেক ‘জঙ্গি’ বিস্ফোরক ও গুলি ছুড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা গুলি করেছে। এরপরে ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসেনি। ভেতরে থাকা ‘জঙ্গি’ জীবিত না মৃত, তা নিশ্চিত নয় পুলিশ।
অভিযান চালানো বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল এক কিশোর সবজি বিক্রেতার। সবজি বিক্রির জন্যই ওই বাড়িতে যেত সে। পুলিশকে ওই কিশোর জানায়, এই বাড়ির আনুমানিক ১৩/১৪ বছর বয়সের এক কিশোরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটি তার নাম শহীদ বলে জানায়। শহীদ বিভিন্ন সময় তাকে অস্ত্র দেখাত। তাকে জিহাদে অংশে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শহীদ বলত, ‘তোমারও বোমা বানানো শেখা উচিত, অস্ত্র চালাতে পারা উচিত। আমি এসব পারি।’ পুলিশ ধারণা করছে, শহীদ নামের ওই কিশোরের আসল নাম আসিফ কাদরী। সবজি বিক্রেতা ওই কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায় পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেলা সোয়া তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। পরে বিকেল পৌনে চারটার দিকে ঘটনাস্থলে তিনি সংবাদ ব্রিফিং করে বলেন, আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে চালানো অভিযান পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এই অভিযানে চারজন আত্মসমর্পণ করেছেন। নিহত হয়েছেন দুজন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন নারী জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। আহত অবস্থায় একটি শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। ওই বাসার ভেতরে অসংখ্য তাজা গ্রেনেড, বোমা পড়ে আছে। অভিযান পরিসমাপ্ত হলেও ভেতর থেকে এগুলো পরিষ্কার করার কাজ চলবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের অবস্থান জানতে পেরে পুলিশ এখানে অভিযান চালায়। বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গি মুসা। আমরা জঙ্গিদের আহ্বান করেছি, তোমাদের অবস্থান থেকে সারেন্ডার করো। পুলিশ বাহিনী নানাভাবে তাদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছিল। তারা কী করবে, কী করবে না এমন অবস্থায় ছিল।
তিনি জানান, মেজর জাহিদের স্ত্রী ও মেয়ে ছিল এখানে। এই জায়গাটি ভাড়া করেছিল মুসার স্ত্রী ও মেয়ে। প্রথমে দু’জন আত্মসমর্পণ করেছে। তারা দু’জনই শিশু। এরপর আরও তিনজন বাকি থেকে গিয়েছিল। তারা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। ওই তিন জনের মধ্যেও ছিল একজন শিশু।
আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, আমাদের পুলিশ বাহিনী তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করেই যাচ্ছিল। তারা চরম ধৈর্য দেখিয়েছে। তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে করতেই এক সময় সুমনের স্ত্রী হঠাৎ করে বেরিয়ে আসার কথা বলে। শিশু মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। তার গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট বাধা ছিল। তাতে তাজা গ্রেনেড ছিল। পুলিশ তাকে ওই ভেস্ট পরে না আসার জন্য চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু ওই নারী ভেতরে গিয়ে আবার বেরিয়ে আসে। এক পর্যায়ে সুইসাইড ভেস্টের সুইচ ধরে টান দেয়। এতে বিস্ফোরণ হয়। সঙ্গে থাকা ওই মহিলা তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে। সঙ্গে থাকা শিশুটি গুরুতর আহত হয়। পুলিশ ওই শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এরপরও ভেতরে একটি ছেলে ছিল। সে কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিল না। তাকে আত্মসমর্পণের অনুরোধে কাজ না হলে পুলিশ ভেতরে (কাঁদানে) গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপর সে গুলি করতে শুরু করে। তার কাছে গ্রেনেড ছিল। সেগুলো ছুড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করলে ভেতর থেকে গুলি বন্ধ হয়। ভেতরে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
মন্ত্রী আরো বলেন, বাসাটির ভেতরে অসংখ্য গ্রেনেড রয়েছে। কতগুলো রয়েছে আমরা জানি না। ভেতরে অস্ত্রও থাকতে পারে। আমাদের বোম্ব ডিসপোজাল টিম সেখানে গিয়ে দেখবে ভিতরে কী কী আছে। এখন কাউকেই ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা বিস্তারিত জানতে পারলে জানাব।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আজকের অপারেশনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এখন বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা ভেতরে ঢুকে সেগুলো ক্লিয়ার করবে।
তিনি বলেন, বারবার আহ্বান জানানোর পরেও জঙ্গিরা না শোনায় এ অভিযান চালানো হয়। শুক্রবার দিবাগত রাত দুইটা থেকে রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ওই বাড়িটিতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের সোয়াত টিম।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেলা সোয়া তিনটার দিকে ঘটনাস্থলে যান। রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়িটি ঘিরে চলা অভিযান প্রসঙ্গে পুলিশ বলেছে,  শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার একটু পরে নিচতলা বাসার দরজা খুলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন এক নারী। ঘটনাস্থলে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। আর তাঁর সঙ্গে থাকা সাত বছর বয়সী একটি মেয়েশিশু আহত হয়েছে। শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কীভাবে ওই ‘জঙ্গি’ নারী বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছেন, উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দফায় ওই বাড়ির নিচতলার বাসা থেকে চারজন আত্মসমর্পণ করেন। এই চারজন হলেন মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গি ও সাবেক মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা, তাঁর মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তাঁর মেয়ে। আরও তিনজন ওই বাসায় ছিল। তাদের বের হওয়ার জন্য পুলিশ এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দিয়েছিল। বারবার তাদের হ্যান্ডমাইকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা তাতে সাড়া দেয়নি।
ছানোয়ার হোসেন আরো বলেন, তিনি ওই বাড়ির গাড়ি পার্কিংয়ের পিলারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তিনি দেখতে পান বোরকা পরা একজন নারী বাঁ হাতে একটি মেয়েশিশুকে ধরে বাসার দরজা খুলে বাইরে এসেছেন। ওই দুজন পার্কিংয়ের দিকে আসছিলেন। তখন তিনি তাঁদের দাঁড়াতে বলেন। বারবার বলেন হাত তুলতে। কিন্তু ওই নারী দাঁড়াননি। তিনি শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে সামনে দিকে হাঁটতে শুরু করেন। একপর্যায়ে বাঁ হাতে শিশুটিকে ধরে রেখে ডান হাত ওপরের দিকে তোলার মতো ভঙ্গি করেন। তবে তখন তিনি কোমরে রাখা বিস্ফোরকে চাপ দেন। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ওই নারী ঘটনাস্থলে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। শিশুটিকে নড়াচড়া করতে দেখে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়েছে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান।
গতকাল শনিবার বেলা তিনটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটি) প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো জঙ্গি নারী মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। ভেতরে থাকা আরেক ‘জঙ্গি’ বিস্ফোরক ও গুলি ছুড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও পাল্টা গুলি করেছে। এরপরে ভেতর থেকে আর কোনো শব্দ আসেনি। ভেতরে থাকা ‘জঙ্গি’ জীবিত না মৃত, প্রথমে তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
মনিরুল ইসলামের ভাষ্য, বেলা পৌনে তিনটার দিকে ভেতর থেকে আরেক ‘জঙ্গি’ গুলি ছোড়ে এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে। তিনি কী অবস্থায় আছেন, তা বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘরের ভেতর বিস্ফোরক ছড়িয়ে আছে। এর আগে ওই জঙ্গি আজিমপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরির ছেলে বলে জানিয়েছিল পুলিশ।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার পরে পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, গত শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তনা সন্দেহে তিনতলা বাড়ি ঘিরে অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বলছে, বাড়িটির নিচতলায় ‘জঙ্গি আস্তানা’। দুপুর সাড়ে ১২টার একটু পরে বাড়িটির ভেতর থেকে দরজা খুলে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটান এক নারী ‘জঙ্গি’। এ সময় তাঁর সঙ্গে এক শিশুও ছিল। আহত শিশুকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) শফিক সামান্য আহত হন।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম ৩ ইউনিটের আট সদস্যের একটি দল ওই বাড়িটি গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার ও সাবির্ক পরিস্থিতিও পরিদর্শন করেছে সিআইডির ওই টিম।
অনলাইন ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া নেয় জঙ্গিরা
রাজধানীর আশকোনায় হাজিক্যাম্পের কাছে ‘জঙ্গি আস্তানা’ সন্দেহে যে বাড়ি ঘিরে অভিযান চালানো হচ্ছে, সেই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটেরা বাইরে বের হতো না। এ তথ্য জানিয়েছেন ওই বাড়ির মালিকের বড় মেয়ে জোনাকি রাসেল।
জোনাকি রাসেল বলেন, তাঁর বাবা মোহাম্মদ জামাল হোসেন বাড়িটির মালিক। তিনি কুয়েতপ্রবাসী। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। তিনি বাবার বাড়ির কাছেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন।
বাসা ভাড়া দেওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে জোনাকি রাসেল বলেন, তাঁর বাবার বাড়িতে টু-লেট টাঙানো ছিল। গত ১ সেপ্টেম্বর মো. ইমতিয়াজ আহমেদ পরিচয় দিয়ে একজন নিচতলার বাসাটি দেখতে আসেন। তখন ওই ব্যক্তি নিজেকে অনলাইন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন এবং বলেন যে বাসায় তিনি, তাঁর স্ত্রী ও এক বাচ্চা থাকবে। মাঝেমধ্যে স্ত্রীর বোন এসে থাকবেন। ১০ হাজার টাকায় তিনি বাসাটি ভাড়া নেন। ৩ সেপ্টেম্বর পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে ওঠেন।
বাড়িওয়ালার মেয়ে দাবি করেন, বাসা ভাড়া দেওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকবার ওই বাসায় গেছেন। বাসায় ল্যাপটপ, খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্রিজ দেখেছেন। তিনি বলেন, ‘উনারা কখনো বের হতেন না। বাসায় ওঠার সময় বাচ্চার বয়স ছিল ৪০ দিন।’ কেন বের হন না? জানতে চাইলে বলতেন, হিজড়ারা বাচ্চা দেখলে টাকা চায়। সে কারণে বের হন না। তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে দুজন নারী ওই বাসায় আসতেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, মা ও এক আত্মীয়। গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন।’
বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় পরিবারটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়েছে, ভাড়াটে সংক্রান্ত ফরম পূরণ করেছে এবং সে ফরম থানায় জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান জোনাকি রাসেল।
পুলিশের অভিযান শুরুর বিষয়ে বাড়িওয়ালার মেয়ে বলেন, গত শুক্রবার রাত ১২টার পুলিশ তাঁর বাবার বাড়িতে নক করে। তাঁর মা নিচে নেমে যান। তখন পুলিশ তাঁর কাছে নিচতলার ভাড়াটে সম্পর্কে জানতে চায়। তখন তিনি পুলিশকে বলেন, তাঁর বড় মেয়ে (জোনাকি রাসেল) সব জানেন। তখন তাঁর মা পুলিশকে নিয়ে তাঁর বাসায় যান। তখন তিনি ভাড়াটেদের কাছ থেকে নেওয়া সব কাগজপত্র পুলিশকে দেন। এরপর পুলিশ চলে যায়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, ‘অপারেশনের নাম সাধারণত সোয়াত টিমের বিশেষজ্ঞরা দিয়ে থাকেন। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে রিপল ২৪। রিপল হচ্ছে, ঢেউয়ের মতো প্রসারিত হওয়া। আর এই অভিযানও প্রসারিত হয়েছে।’ শনিবার পৌনে ৫ টায় রাজধানীর আশকোনায় জঙ্গি আস্তানায় কাউন্টার টেরোরিজম  ও ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সোয়াত টিমের অভিযান শেষে ঘটনাস্থলের সামনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। আইজিপি আরও বলেন, ‘এখানে তিনটি শিশুসহ মোট ৭ জন ছিল। এদের মধ্যে দুটি শিশুসহ চারজন আত্মসমর্পণ করেছে। এক শিশুকে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকি দুজনের মৃতদেহ ভবনের ভেতর পড়ে আছে। যেহেতু সেখানে গ্রেনেড ও বিস্ফোরক আছে তাই এখন সেখানে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়ের কাজ চলছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, নিহত দুজনের মধ্যে আজিমপুরের ঘটনায় তানভীর কাদের সিদ্দিকী ওরফে করিমের যমজ ছেলে রয়েছে। নিহত অপর নারী জঙ্গি সুমনের স্ত্রী। তবে সুমন নামে কোনও জঙ্গির তথ্য পুলিশের কাছে নেই। ধারণা করা হচ্ছে এটি কোনও জঙ্গির সাংগঠনিক নাম। তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। গ্রেফতার চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এদের সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।



 

Show all comments
  • সুলতান আহমেদ ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:১৮ এএম says : 1
    এসব প্রতিরোধে সকলের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ