চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ : চেম্বারে রোগী যিনিই আসেন রোগের কথা বলার আগে জিজ্ঞাসা করেন বার্মার মুসলমানরা কি সব শেষ হয়ে যাবে, গণহত্যা বন্ধে কেউ কি সাহায্য করবে না? দেশের ইসলামী দলগুলো কী করছে? সব ইসলামিক দল মিলে আন্দোলন করলে অসুবিধা কেথায়? আমরা মরতে রাজি আছি তবুও বার্মার মুসলমান ভাইদের জন্য কিছু একটা করুন। শুধু চেম্বার নয়, রাস্তাঘাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ মানুষের সমাগম যেখানেই কথা একটিই মিয়ানমারের মুসলমানদের অবস্থা কী হবে? এদেশে কি মুসলমান নেই? জবাব দেয়া সম্ভব হচ্ছে না! কোন একটা উপায় খুঁজে বের করার। আমি নিজেও বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি, মিয়ানমারে মুসলমানবিদ্বেষী হিংস্রতার প্রতিবাদ কেন করতে পারছি না।
তপ্ত খুনে রঞ্জিত বিশ্ব মানচিত্রে এক ভূখণ্ডের নাম মিয়ানমার। যার বুকে বইছে মজলুম মুসলমানদের রক্ত স্রোত, অসভ্য ও বর্বর বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের গর্দান থেকে শিরশ্চেদ করে উল্লাস করেছে। অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়, আজ আমরা লজ্জিত, আমরা নির্বাক, কিছুই করতে পারলাম না তোমাদের জন্য। ক্ষমা কর আমাদের মিয়ানমারের মুসলমান। আমি বাকরুদ্ধ এক মুসলিম আমার ভাইয়ের পোড়া লাশ, আমার বোনের ইজ্জত, ছোট শিশুর আর্তনাত দেখে মনে হয় বিশ্বে প্রায় ২শ’ কোটি মুসলমানদের দরকার নেই। প্রয়োজন শুধু একজন বীর সেনাপতির। যে মরক্কোর মরুভূমি থেকে ছুটে আসবে ইউসুফ বিন তাসকীনের মতো, বড় প্রয়োজন তারিক বিন যিয়াদের, খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো একজন লড়াকু সৈনিকের। হে প্রভু! রক্তাক্ত আফগান, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকান, মিয়ানমারের মুসলমানদের জন্য তুমি পাঠিয়ে দাও সুলতান সালাহ উদ্দিন আইউবীর মতো একজন মরণজয়ী মুজাহিদ।
টেকনাফে মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদ। এই নদের পাড় থেকেই দেখা যায় দিনের বেলায় ধোঁয়া উঠছে। এতে বোঝা যায় সেখানে বাড়িঘরে আগুন দেয়া হচ্ছে। দাউ দাউ করে জ¦লছে আগুন, পুুড়ছে ঘরবাড়ি। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। গুলিতে নিহত রক্তাক্ত লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নারী-শিশুর স্বজন, ঘরের ভেতর আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পাশে বসে আহাজারি করছে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এক বিভীষিকাময় নারকীয় দৃশ্য। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারের সেনাবাহিনীর এই নিষ্ঠুরতায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়াগুলোতে এগুলো স্বাভাবিক খবর, নীরব বিশ্ববিবেক। সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিষণ্নতা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করছে না। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এমন অত্যাচার চলছে যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়, সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কোন সাংবাদিককেই মিয়ানমার সরকার সহিংসতা কবলিত রাখাইন রাজ্যে যেতে দিচ্ছে না। নির্যাতনের ভয়াবহতা এতই ব্যাপক যে, রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে যে যেভাবে যেদিক পারে পালিয়েছে। তারাও অনাহারে-অর্ধাহারে ঝোপঝাড়ে জঙ্গলে ও সীমান্ত ছাড়িয়ে বাঁচতে নৌকা নিয়ে সাগরে যাত্রা করেছে। সেখানেও নৌ সদস্যদের হাতে রক্ষা নেই। যারা কোনো মতে বেঁচে আছেন তারা সাগরে ঘুরতে ঘুরতে পানীয় খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছেন।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা উত্তর আরাকান এবং মন্ডু টাউনশিপে রোহিঙ্গারা রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথেঘাটে, খালে, নদীতে তাদেরকে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। লোকজন নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চাইলে তাদের নৌকার ওপর গুলি করা হচ্ছে। আমার মনে হয় মানবিক কারণে বিষয়টি বিবেচনা করে এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ না করে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে স্বল্প পরিসরে হলেও আশ্রয় দেয়া উচিত। কারণ আমাদের কারো ঘরে যদি আগুন জ¦লে সে যে ধর্মেরই হোক না কেন তখন প্রতিবেশীর উচিত তার বাড়িতে আশ্রয় দেয়া। বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসি। কিন্তু তারা মিয়ানমারকে কেন চাপ দিচ্ছে না।
অতীতে চীনের কিছুটা চাপ ছিল কিন্তু বর্তমানে মানবিক কারণে তা শিথিল করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। সে হিসেবে মানবিক কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্য করার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের লোকগুলো যখন জীবনের ভয়ে ভীত হয়ে আরেক দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেছে তখন শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোসহ সব দেশের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করার একটা বিষয় রয়েছে। শুধু তাই নয়, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি বাতাসে বারুদের গন্ধ ছড়িয়ে বন্দুকের নলে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান কিনা- এ প্রশ্ন রেখে তারা নোবেল প্রাইজ বাতিলের দাবি জানিয়ে ২০ নভেম্বর দুপুর পর্যন্ত ওয়েবসাইটের পিটিশনে ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন নরওয়ে নোবেল কমিটির কাছে। পিটিশনটি উপস্থাপন করতে হলে তাগুত দেড় লাখ স্বাক্ষর লাগবে পিটিশনে। অং সান সুচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে খোলা হচ্ছে নতুন নতুন পিটিশন। চলছে স্বাক্ষর সংগ্রহ। আমার প্রশ্ন হলো, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তাক্তের খবর ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে বিপন্ন হয়ে পড়েছে মানবতা। তারপরও বিশ্ব বিবেক নীরব কেন, রোহিঙ্গারা মুসলিম ধর্মের বলেই কি তারা বিশ্বের পরাশক্তির দেশগুলোর কাছে অপাঙ্ক্তেয়? আর প্রতিবেশী দেশের মুসলিম হিসেবে বিপর্যয়ের মুখে পড়া রোহিঙ্গা মুসলিম শিশু নারীদের জন্য আমরা কি করছি, রোহিঙ্গা মুসলিম না হয়ে যদি অন্য ধর্মাবলম্বী হতো তাহলে আমরা কি নীরব থাকতাম। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান সমর্থিত রোহিঙ্গা ভিশন নামে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায় কিছু আগুনে পোড়া লাশ মাটিতে রাখা হয়েছে এবং সেগুলোকে ঘিরে তাদের স্বজনরা আর্তনাত করছে। এলাকাটি বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে খুব কাছে। বিবিসির খবরে বলা হয়, ওই ভিডিওতে যাদের দেখানো হয় তাদের ভাষা অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকার আঞ্চলিক ভাষার মতোই। ভিডিওতে একটি লাশের পাশে বসে দুই মহিলা কাঁদছে। এক মহিলা লাশটির মুখে হাত বোলাচ্ছে এবং বিলাপ করছিলেন। আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বর্তমান অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে মিথ্যাবাদী উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যাযজ্ঞের পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক কিংবা সাংবাদিকদের সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সাথে কথাবার্তার ভিত্তিতে আমরা যেসব খবর পাচ্ছি সেই চিত্রটা আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। অবশ্য রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য অস্বস্তিকর বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। গত ২০ নভেম্বর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চোরাচালান প্রতিরোধ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে তিনি জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মিয়ানমার সীমান্তে বিশেষ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হাজার বছর আগে মুসলমানরাই এক সময় মিয়ানমার শাসন করত। সেই মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিহ্ন করতে ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম বদলে রাখাইন প্রদেশ রাখা হয়। একই সময় বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার। মুসলিম রোহিঙ্গাদের অধর্মী ও অবৌদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়।
নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের বিদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, শুধু তাই নয়, তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী অবৈধ বাঙালি অভিবাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। বার্মা থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে অপারেশন পরিচালনা করা হয়, ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের চেষ্টায় সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। এ সংকট শুরু হয় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার আরাকান দখলের পর থেকে। রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটেবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন ঘরের ভিতরে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশের পাশে বসে আহাজারী করছে। অথচ বিশ্ববিবেক নীরব।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।