চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আফতাব চৌধুরী
॥ দুই ॥
এই আইন কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগের মাধ্যমে সংবিধান কার্যকর হয় এবং সংবিধানের লক্ষ্য অর্জিত হয়। কিন্তু যখনই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে ঘুষের প্রচলন চালু হয় তখন আইনের বিকৃতি শুরু হয়। আইনের বিকৃতিসাধন করে যখন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হয় তখন তা সংবিধান বহির্ভূত কাজ হিসেবে পর্যবসিত হয় এবং প্রতিষ্ঠানের সার্বিক ক্ষতি সাধিত হয়।
আমাদের রাষ্ট্রও একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং সামগ্রিক উন্নতির জন্য একটি মহৎ সংবিধান আছে।
আমাদের সংবিধানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জিত হলে আমরা জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে একটি সম্মানজনক আসন লাভ করতে পারি। রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ কিছুটা অগ্রসর হলেও জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের সংবিধানে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। আমাদের দেশ সামাজিক অসাম্য, দুর্নীতি, বিচ্ছিন্নতা, নৈতিক অধঃপতন ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমরা মহৎ একটি সংবিধানের অনুসারী হয়েও মহান জাতি হিসাবে কেন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হলাম তার কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, ঘুষ বা উৎকোচের অবাধ প্রচলন আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে হরণ করে নিয়ে সংবিধান অনুসৃত আইন-কানুনগুলোকে পাশ কাটিয়ে এক শ্রেণীর, আমলা এবং রাজনৈতিক নেতারা এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, দেশে আইনের শাসন চলছে অথবা চলছে না ঠিক বলা যাবে না।
কোনও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষে ঘুষ গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল সাধনের অঙ্গীকার দিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী কাজ করে অরাজকতার সৃষ্টি করে তখন তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্তির বিবেক, চরিত্র এবং স্বভাবের উপর পড়ে। ফলে তার বিবেক, চরিত্র এবং স্বভাব বিনষ্ট হয়ে যায়। হীন স্বভাবের একজন লোকের আচার-আচরণ হয় হীন ও অমার্জিত। ফলে লোকটি তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী তথা সামজের দৃষ্টিতে অপ্রিয় ও অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠে। কিন্তু অনুশোচনার বিষয়, তার এই অবস্থার উপলব্ধি হয় জীবনের সন্ধ্যাবেলায় যখন সবকিছু ফুরিয়ে যায়। পরিতাপের বিষয়, পরিবার তথা সমাজের কাছে নিজেকে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে যে লোকটি জীবনের সব মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে ঘুষের টাকায় আপনজনের জন্য এতসব সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিল তারাই কিনা জীবনসায়াহ্নে তার প্রতি অশ্রদ্ধা, অনাদর পোষণ করে। এটা অতি স্বাভাবিক। অর্থ দিয়ে মানুষের কাছে থেকে শ্রদ্ধা লাভ করা যায় না। স্বভাব, চরিত্র, মন, মানসিকতায় নিজেকে সমুন্নত করতে পারলে তবেই মানুষ শ্রদ্ধাস্পদ হয়, ভালবাসা পায়।
ঘুষদাতা সাধারণত একজন অবাঞ্ছিত স্বার্থপর ব্যক্তি যদিও কিছু ক্ষেত্রে সে ঘুষের শিকার। সে অন্যায়ভাবে সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দোষে দুষ্ট, যদিও ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে কিছু ক্ষেত্রে ঘুষের বলি। ঘুষদাতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রলোভিত করে এবং অবৈধ কাজে উৎসাহিত করে। সুতরাং ঘুষদাতা দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নৈতিক অবক্ষয় ও অরাজকতা সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করার জন্যও দায়ী। আবার অনেক সরকারি কমকর্তা , কর্মচারী বা ঘুষ গ্রহীতা নানা অযুহাতে সেবা গ্রহণকারীদের হয়রানি করে থাকেন, উদ্দেশ্য ঘুষ আদায়। বাধ্য হয়েই তখন সেবা গ্রহণকারী ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে থাকেন। ঘুষ না দিলে তার বৈধ কাজই আর হবে নাÑ হয়রানির শিকার হতে হবে।
আমাদের দেশে ঘুষ বা উৎকোচ একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে নিয়েছে। জাতীয় জীবনে ঘুষ এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, এর বাইরে গিয়ে চিন্তা করার অবকাশ যেন আর নেই। একটা সময় ছিল যখন ঘুষের লেনদেন চলত টেবিলের নীচ দিয়ে। ঘুষদাতা ও গ্রহীতা কাজটাকে লজ্জাজনক মনে করত। এখন আর তা নেই। আজকাল ঘুষের লেনদেন বুক ঠুকে সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সংঘটিত চচ্ছে। উকিল যেভাবে তার মক্কেলের কাছ থেকে পারিশ্রমিক চেয়ে নেন বা দর কষাকষি করেন ঠিক সেভাবেই জনগণের সেবক জনগণের কাছ থেকে পারিশ্রমিক চেয়ে নিচ্ছেন। ন্যায়-অন্যায় বলে আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। টাকা দিলে সব হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।