বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণের ওপর ভয়াবহ দমন-পীড়ন ও নিধন চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সংলগ্ন আরাকান বা রাখাইন উপকূলে বসবাস করে আসছে শত শত বছর ধরে। এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দ তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে আগত দাবি করে তাদের ওপরে হত্যা ও ধর্ষণসহ সব রকমের নির্যাতন চালাচ্ছে। এ নির্যাতন চলছে ১৯৩৭ সাল থেকে। রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ সব সময়েই ছিল। তবে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গণহত্যায় পরিণত হয়েছিল ১৯৩৮, ১৯৪২, ১৯৪৮, ১৯৭০, ১৯৭৮ সাল এবং ১৯৯০ এর দশকে। সাম্প্রতিককালে এই গণহত্যা ও গণবিতাড়নের ঘটনা ঘটেছে ২০১২, ২০১৫ এবং এই ২০১৬ সালে। রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। তাদের জমিজমা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত করে পথের ভিখারি করে রাখা হয়েছে। তারা বেঁচে থাকত মূলত বিদেশিদের দেওয়া যৎসামান্য সাহায্য ও সহযোগিতার ওপর। বর্মি সরকার সে সাহায্যটুকুও তাদের পেতে দিচ্ছে না।
তারপর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের হাতে মিয়ানমারের ৯ জন পুলিশ নিহত হলে মিয়ানমার সরকার আক্রমণকারী ব্যক্তিদের সন্ধান না করে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয় পুরো রোহিঙ্গা জনগণের ওপর। এই সৈন্যরা মগ দস্যুদের সাথে একত্রিত হয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ। ধর্ষণ করেছে নারী ও শিশুদের। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। করছে তাদের শেষ সম্বলটুকু লুণ্ঠন। যারা প্রাণে বেঁচে আছে এখনও তাদেরও হয় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিংবা শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। প্রাণে বাঁচতে সিকি লক্ষের মতো রোহিঙ্গা অতি কষ্টে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
সারা বিশ্ব স্বীকার করে যে, রোহিঙ্গারা বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি। কিন্তু তাদের উপরের এই নিপীড়ন দূর করতে কেউই এগিয়ে আসছে না। জাতিসংঘ থেকে পর্যন্ত বলা হচ্ছে যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। অথচ জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তার শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণ করছে না। পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে হৈচৈ করলেও রোহিঙ্গাদের রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। তারা মিয়ানমারের ওপর এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ পর্যন্ত করছে না।
রোহিঙ্গাদের রক্ষায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোও তেমন আগ্রহী নয়। তারা ব্যস্ত নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষায়। সৌদি আরবসহ বহু ইসলামপন্থি রাষ্ট্র বিশ্বে আছে। কিন্তু তারা তাদের মুসলিম ভাই রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ বন্ধের ব্যাপারে নিশ্চুপ। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওআইসি এখন পর্যন্ত একটি প্রতিবাদ পর্যন্ত জানাতে পারেনি, প্রতিরোধ তো দূরের কথা। রোহিঙ্গা জনগণ নিধন হচ্ছে শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে। অথচ অন্যান্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মতোই মুসলমান নেতৃবৃন্দ রোহিঙ্গাদের ওপরের পাশবিক নির্যাতন ও হত্যাকা- নিবারণ করতে বিবেকের দংশন বোধ করছেন না। তাদের কেউ কেউ ইসলামের নানা তরিকার নামে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে চায় শুধু নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার। এই আইএস, আলকায়দা, আলসাবা, তালেবান, বোকো হারাম, জেএমবি প্রভৃতি সংগঠন ইসলামের নামে অস্ত্র ধারণ করলেও ক্ষতি করছে শুধুই ইসলাম ও মুসলমানদের। তাদের কর্মফল ক্ষুদিরামের সেই গানের মতো, “বড় লাটকে মারতে গিয়ে মারলেম ভারতবাসী।” মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমুখ রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদকারী নেতৃবৃন্দের প্রতি ‘পাঞ্জেরী’ কবিতার কবির ভাষায় বলা যায়Ñ
“তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে,
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি,
রাত পোহাবার কত দেরি, পাঞ্জেরী।”
রাত পোহাবার এই দেরির কারণে রোহিঙ্গাদের পরিণতি হচ্ছে, “অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের পারাপার তরী।” অথবা তাদের “ক্ষুধাতুর ও ধর্ষিত পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরি।”
আমাদের বোঝা উচিত যে আমরা যদি আরাকানে জন্মগ্রহণ করতাম বা অন্য কোনো দেশের সংখ্যালঘু নাগরিক হতাম সম্ভবত আমাদেরকেও রোহিঙ্গাদের মতো একই পরিণত ভোগ করতে হতো। অসহায় রোহিঙ্গারা জাতিসংঘ বা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে জান বাঁচানোর সাহায্য পাবার নিষ্ফল আশায় সমুদ্রের পানে তাকিয়ে আছে। বাংলার কবি ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা যেন রোহিঙ্গা জনগণের বর্তমান অবস্থাকেই তুলে ধরা হয়েছে। কবি লিখেছেনÑ
“বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে
বুঝি মৌসুমি হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,
বুঝি কুয়াশায় জোছনা মায়ায় জাহাজের পাল দেখে
আহা পেরেশান মুসাফির দল দরিয়া কিনারে জাগে তকদিরেÑ
নিরাশার ছবি এঁকে।”
আমাদের দেশের একশ্রেণির লোক নিজেদেরকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বলে দাবি করে থাকে। অথচ তারা নিজেদের সন্তানদের বিদেশে রেখে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে মরিয়া। তারা বাংলাদেশের বাইরে যে কোটি কোটি বাঙালি আছে তাদের অধিকার নিয়ে কখনো কথা বলে না।
এমনকি অন্য জাতি কর্তৃক গণহত্যার শিকার হলেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। রোহিঙ্গাদের ভাষা অনেকটা বাংলা ভাষার মতো। চেহারাও বাঙালিদের মতো। হতে পারে রোহিঙ্গারা বাঙালি জাতির একটি গোত্র। মোঘল আমলে ফারসি-যখন এদেশে রাষ্ট্রভাষা ছিল তখন আরাকানের এই রোহিঙ্গারাই বাংলা ভাষার চর্চা করে আমাদের মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল। মহাকবি আলাওল, দৌলতকাজী প্রভৃতি বাংলা ভাষার প্রাচীন কবিদের বাসস্থান ছিল এই আরাকান। এক্ষেত্রে ‘বাঙালি ওয়ালা’দের উচিত ছিল রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে তার মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখা। কিন্তু তারা তা করছেন না। আসামের বাঙালিরা যখন বোড়ো ও অহমদের হাতে গণনিধনের শিকার হয় তখনও তারা তার প্রতিবাদ করেন না। তাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ শুধু মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি এবং জাতিকে আধুনিক সভ্যতা থেকে দূরে রাখার জন্য।
রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে তারা তাদেরকে সাময়িক আশ্রয় দিতেও রাজি নয়। তারা প্রায়শ বলে থাকেন রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত। এমনকি জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের তারা অর্থনৈতিক কারণে আসছে এমন কথা বলতেও দ্বিধা করেন না। সরকার বলছে, তারা কিছু কিছু রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এ দাবিকে আমি সঠিক বলে মনে করি না। মানবিক কারণে কাউকে যদি আশ্রয় দেওয়া হতো তবে পুরো নৌকার মুখ ঘুরিয়ে মিয়ানমারের বধ্যভূমিতে ফেরত পাঠানো হতো না। অন্তত নৌকা থেকে বেছে বেছে শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হতো। তাই মনে হয়, সেসব রোহিঙ্গাই শুধু কোনো রকমে বাংলাদেশে আসতে পারছে যারা সীমান্ত রক্ষীদের চোখে পড়ছে না অথবা যারা টাকা দিয়ে দালালদের ম্যানেজ করতে পারছে। বর্তমান আমলে দালাল যে কারা তা সবাই জানে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি পরিদর্শক দল রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করতে আরাকান পরিদর্শন করেছেন। তবে কফি আনানের আরাকান ভ্রমণের সময়েও রোহিঙ্গাদের ওপরের দমন-নিপীড়ন একটুও কমেনি। রাখাইন বা আরাকান রাজ্যে গণহত্যা চলেছে। অথচ কফি আনান গণহত্যা শব্দটি ব্যবহার না করতে সবাইকে সতর্ক হতে বলেছেন। শুধু গণহত্যা নয়, আরাকানে চলছে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে চির নির্মূল করার অভিযান। তাই তো রোহিঙ্গা পুরুষদের সাথে সাথে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদেরও নিধন করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময়েও গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিবাহ ও সন্তান নিতে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে বহু পূর্ব থেকে। রোহিঙ্গারা যাতে বিনা চিকিৎসায় ও অনাহারে মারা যায় সে জন্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোকে আরাকানে ঢুকতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। নোবেল জয়ী সুচির দিকে এক সময়ে রোহিঙ্গারা তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সেটি ছিল মারাত্মক ভুল। কারণ সুচি নিজেও উৎকট বর্মি জাতীয়তাবাদী এবং তিনি মিয়ানমারের মুসলিম বিদ্বেষী বর্মি সেনাবাহিনীর হাতের ক্রীড়নক। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগদের জুলুমের পেছনে ইন্ধন আছে এশিয়ার আর একটি মুসলিমবিদ্বেষী রাষ্ট্রের। এই রাষ্ট্রটি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের উচ্ছেদ অভিযানের আর একটি কারণ হলো আরাকানের সম্পদ। প্রায় ২৫ হাজার বর্গমাইলের আরাকান রাজ্যটি একটি উপকূলীয় এলাকা। এটির স্থলভূমি ও স্থলভূমির প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ সমুদ্র এলাকা তেল ও গ্যাস সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মিয়ানমারের সরকার ভাবছে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করতে পারলে তারাই হবে এই সম্পদ এবং এখানকার কৃষিজ, বনজ, নদী ও মৎস্য সম্পদের একমাত্র মালিক।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাকা- বন্ধের জন্য জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সোচ্চার। মিয়ানমার সরকার সেদিকে কোনো কর্ণপাত করছে না এবং রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান অব্যাহত রেখেছে। আর যদি অত্যাচারী মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সরকার গণহত্যা বন্ধ রাখেও তাতেও রোহিঙ্গাদের তেমন লাভ হবে না। কারণ মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের নির্মূলে বদ্ধপরিকর। তারা আবারো নানা অজুহাতে এ নির্মূল অভিযান চালাবে। এদিকে বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের স্থায়ী আশ্রয় দেবে না নানা কারণে। তাই রোহিঙ্গা গণহত্যা সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো আরাকানে একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যে রাষ্ট্র বর্মিদের আরাকান জয়ের পূর্বে ছিল। মহাকবি আলাওল সে রাষ্ট্রটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘সূচারু রোসাঙ্গ স্থান, নানা জাতি শোভমান।’
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।