হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : ‘গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে’- এ ধরনের একটি কথা বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে প্রচলিত রয়েছে। এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কও হচ্ছে। বিশ্লেষকরা যেসব ব্যাখ্যা ও যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন, তাতে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে সরকার ‘উন্নয়ন আগে গণতন্ত্র পরে’ এমন একটা নীতি নিয়ে চলছে। দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ধামাচাপা দিয়ে সাড়ম্বরে বড় বড় প্রকল্পের কাজ ধরে উন্নয়নের নিশান উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য মানুষকে বোঝানো, গণতন্ত্র¿ কিছু না, উন্নয়নই আসল কথা। তবে বিশ্লেষকরা গণতন্ত্র আগে বলার পাশাপাশি নিদেনপক্ষে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এসব কথা সরকারের ভালো লাগার কথা নয়। সরকার কানও দিচ্ছে না। বিরোধিতাও করছে না। কারণ হচ্ছে, বিশ্লেষকদের কথা উড়িয়ে দেয়ার কিছু নেই। তাদের কথা যুক্তিযুক্ত। সরকারও তা বোঝে। বুঝলেও তাদের কথা না শোনার কারণ, সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়া নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অত্যন্ত বিতর্কিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ পরিচালনা করছে। সরকার এটা তার সবচেয়ে বড় একটি দুর্বলতা। যদি যথাযথ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হতো, তবে ‘গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে’ Ñ এ ধরনের অনর্থক তত্ত্ব ও বিতর্কের সৃষ্টি হতো না। গণতন্ত্রের মধ্যে থেকেই উন্নতি হতো। সরকার তার দুর্বলতা ঢাকতে এবং জনগণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার জন্যই উন্নয়নকে সামনে তুলে ধরছে। জনগণ যাতে মনে করে, বাহ্, বেশ উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়নই তো দরকার! গণতন্ত্রের দরকার কি! সরকার জনগণকে এমন একটি ধারায় অভ্যস্ত করতে চাচ্ছে। এ অভ্যস্ততা হয়তো সরকারের জন্য সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। তবে সরকার যখন চিরস্থায়ী নয় এবং যখন তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে, তখন হয়তো টের পাবে, সাময়িক আরামের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কী ক্ষতিই না হয়ে গেছে বিশ্লেষকদের কথার সার অংশ এটিই। সেন্টার ফল পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে বলে বিতর্ক করছেন, তারা উন্নয়নের আধুনিক ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কারণ, সমতা যদি না থাকে তাহলে সেটা উন্নয়ন নয়।’ মূল কথা এটিই। তবে সরকার তা মানবে কেন? সরকার তো তার দুর্বলতা কোথায় তা সত্যসত্যই জানে। উন্নয়ন সমহারে হচ্ছে না, অসমহারে হচ্ছেÑ এদিকে তার নজর দেয়ার দরকার নেই। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উন্নয়ন চিত্র দেখিয়েই বলা হচ্ছে উন্নয়ন হচ্ছে। এই উন্নয়ন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের পকেটে পর্যন্ত তাকে হাত দিতে হয়েছে। চলতে-ফিরতে, খাইতে-নাইতেসহ প্রায় সবকিছুতেই ভ্যাট বসিয়ে দিয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সেবামূলক সব প্রতিষ্ঠানের বিল গোচরে-অগোচরে বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ সরকারের ‘প্রশাসন’কে তো ঠিক রাখতে হবে! ঠিক রাখতে বেতন দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে দিতে হয়েছে। বাড়তি এই অর্থ আসবে কোত্থেকে? জনগণের পকেট ছাড়া তো গতি নেই! কাজেই তাদের পকেট কাটো! এতে জনগণের কী অসুবিধা হচ্ছে, তা দেখার দরকার নেই। প্রশাসন ঠিক তো সব ঠিক! প্রশাসনের মাথা আগে ঠিক রাখতে হবে। এসবই সরকারকে করতে হয়েছে এবং হচ্ছে, শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য।
দুই.
আমরা উন্নতি করছিÑ এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর উন্নয়ন ছাড়া গতিও নেই। এক জায়গায় থেমে থাকা মানে তলিয়ে যাওয়া। কেউ থেমে বা তলিয়ে যেতে চায় না। প্রত্যেক মানুষকেই জীবিকার তাগিদে উন্নয়নের পেছনে ছুটতে হয়। এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, উন্নয়নটা কীভাবে হচ্ছে? এটা সার্বিক বা গোষ্ঠীগতভাবে হচ্ছে কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, উন্নয়নটা হচ্ছে গোষ্ঠীগতভাবে। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ যখন দেখে তার চারপাশের কিছু মানুষ শনৈশনৈ উন্নতিতে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে তাদের জীবন চালাতেই হুতাসনের মধ্যে থাকতে হচ্ছে, তখন সহজেই বুঝতে পারে, উন্নতিটা একপেশে হয়ে যাচ্ছে। পার্থক্যটা আকাশ আর পাতালের সমান। অথচ উন্নতি হওয়ার কথা সমহারে, সুষমভাবে। অনেকটা পিরামিড আকারে। নিচ থেকে উন্নতি হতে হতে উপরের ধনিক শ্রেণি পর্যন্ত। অন্যদিকে ধনিক শ্রেণির উন্নতির রেশ নিচের দিকে ধাবিত হবে। তা না হয়ে উন্নতির চিত্রটি হয়ে গেছে উল্টো পিরামিডের মতো। ধনিক শ্রেণি উন্নতি করে ফুলেফেঁপে উঠেছে। নিচের দিকে মানুষ ক্রমেই শুকিয়ে চোঙ্গাকৃতির মতো চুপসে যাচ্ছে। আমাদের উন্নতিটা এখন এভাবেই হচ্ছে, যেখানে সমতা বা আনুপাতিক হার বলে কিছু নেই। এ কথাই বলেছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে সরকার হয়তো বলতে পারে, মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। সমতা হয়নি কোথায়? এ কথার যুক্তি দিতে গেলে শুভংকরের বিশাল একটা ফাঁক ধরা পড়বে। এ নিয়ে অনেক কথাই বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশে যে প্রায় চার কোটি বেকার রয়েছে, তার আয়টি হচ্ছে কীভাবে? যে বেকার, তার আয়ই তো নেই। গড় করে যে আয় ভাগ করে দেয়া হলো, তা তো তার পকেটে নেই। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মাথাপিছু আয়ের বিষয়টি ‘হাওয়াই মিঠাই’ ছাড়া কিছু নয়। অনেকটা স্বপ্নে মিষ্টি খাওয়ার মতো। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মাথাপিছু আয়ের হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এ স্তরে পৌঁছাতে হলে মাথাপিছু আয়কে ৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলছে, তার আন্তর্জাতিক কোনো মানদ- নেই। এটা বাংলাদেশেরই তৈরি।’ অর্থাৎ সরকার কাগজেকলমে যা ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছে, তাই ধরে নেয়া হচ্ছে। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি বা মানদ- নেই। মানদ- হচ্ছে, সরকারের ঘোষণা বা ইচ্ছা। বলা হচ্ছে, ২০১৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি)-এর তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বিবেচিত হবে। ২০২৪ সাল নাগাদ এই তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। এ জন্য বাংলাদেশকে তিনটি লক্ষ্যÑ মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার মধ্য থেকে অন্তত দুটিতে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। আমরা যদি মাথাপিছু আয়ের কথা বিবেচনা করি, তাহলে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশ বা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে মাথাপিছু গড় আয় হতে হবে ৪ হাজার ডলারের বেশি। এখন এই আয় ১৪৬৫ ডলার। আগামী সাত-আট বছরে বাস্তবিকই কি তা তিন গুণ করা সম্ভব? যেখানে বর্তমান মাথাপিছু আয় নিয়েই যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে? হ্যাঁ, যেহেতু কোনো মানদ- নেই এবং সরকার তার ইচ্ছা মতো ঘোষণা করে দিতে পারেÑ এ হিসেবে তা সম্ভব। চার হাজার কেন, পাঁচ-ছয় হাজার বা তার বেশিও ঘোষণা করে দিলেও কে হিসাব করতে যাবে? মানুষ কেবল শুনবে তার মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলার হয়েছে। আর পকেট হাতড়ে ডলার খুঁজবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্র যদি ধরা হয়, তবে দেশের কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান দ্রুত করা ছাড়া বিকল্প নেই। একদিকে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে, আরেক দিকে বছরের পর বছর ধরে চলমান বেকারত্বের হার কমাতে হবে। আগামী ছয়-সাত বছরে দেশের কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করা কি সম্ভব? আমরা ভালো করেই জানি, আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে এখন চরম মন্দাবস্থা চলছে। শিল্প কারখানা চালু হওয়ার পরিবর্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন কারখানা প্রতিষ্ঠা করে গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না। শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। এ পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে, তবে কীভাবে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হব? সরকারের প্রবণতা অনুযায়ী কাগজে-কলমে বা কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই-এর মতো হতে পারব, বাস্তবে তা হতে পারব না। কাগজে-কলমে যদি সরকার এখনই ঘোষণা করে দেয় আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি, তাতে কী আসবে যাবে! বিশ্লেষকরা কিছু দিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে, তারপর থেমে যাবে। অন্যদিকে সরকার তার উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে বলবে আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে আমাদেরকেই ক্ষমতায় থাকতে হবে।
তিন.
ক্ষমতায় কে থাকল বা না থাকল, সেটা বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন কতটা হচ্ছে এবং কীভাবে হচ্ছে। এটা কি শুধু কাগজে-কলমে হচ্ছে নাকি, টেকসইভাবে হচ্ছে। দেখার বিষয় এটাই। সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা পেছনে ঠেলে সরকার হয়তো ঘোষণা দিয়ে সাময়িক বাহবা নিতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও পড়তে পারে। ঘোষণা আর বাস্তবের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান হলে উন্নয়নের ফানুস চুপসে যেতে বেশি সময় লাগবে না। সরকারের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি রয়েছে যে, যা উন্নয়ন হচ্ছে তার সবই সে করেছে। বস্তুত সরকারের একার পক্ষে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বেসরকারি খাত ও ব্যক্তি উদ্যোগ। সরকারি উদ্যোগে রাস্তাঘাট আর কিছু বড় প্রকল্প বা স্থাপনা নির্মাণ করলে চেহারা ভালো দেখা যায় ঠিকই, তবে তা সার্বিক উন্নয়নের প্রতীক নয়। আমাদের দেশের মানুষের অর্থনীতির কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে দেখা যাবে, সাধারণ মানুষের হাতে স্বচ্ছন্দে চলার মতো অর্থকড়ি নেই। খুবই টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। একদিক টান দিলে, অন্যদিক উদাম হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যদি এমন হতো, মানুষ তার অভাব মিটিয়ে জীবনযাপন করে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছে, তাহলে সেটাই হচ্ছে উন্নয়নের মূল সূচক বা সাসটেইনঅ্যাবল ডেভেলপমেন্ট। এখন অবস্থা অনেকটা এমন, সরকার কিছু মানুষের উন্নতিকে সূচক হিসেবে ধরে উন্নয়নের কথা বলছে। অর্থনীতির হিসাবে বাংলাদেশ হয়তো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তবে কতটুকু উন্নয়ন গতি নিয়ে বের হচ্ছে, তা কিন্তু প্রচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে। শঙ্কার বিষয়টি এখানেই। এখন দেখা যাবে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে বাংলাদেশ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে সুদবিহীন বা ন্যূনতম সুদের বিনিময়ে যে ঋণ ও সহযোগিতা পেত, তা আর পাবে না। কারণ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হলে রপ্তানি ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়াসহ দাতা সংস্থাগুলোর ঋণ ও সহায়তা কম পাওয়া যায়, পেলেও তার সুদের হার হয় বেশি। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে বিশ্বের সব দেশের উন্নতি নিয়ে তিনটি শ্রেণিতে একটি তালিকা করে। শ্রেণি তিনটি হচ্ছে, স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল এবং উন্নত। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ ও সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। এ তালিকায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ঠাঁই পায়। গত বছর ঘোষণা দেয়া হয় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ তালিকা থেকে বের হতে বাংলাদেশের সময় লেগেছে প্রায় ৪৫ বছর। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হতে যে তিনটি কারণ রয়েছে তার মধ্যে মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। বাকি দুটি সূচক মানব সম্পদের উন্নয়ন (৬৬ পয়েন্টের মধ্যে ৬৩) ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি (৩৬ পয়েন্টের মধ্যে ৩৩) কমানোর ক্ষেত্রে নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জন বা অতিক্রম করতে পারেনি, তবে কাছাকাছি রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে হলে তিনটি সূচককেই নির্ধারিত পয়েন্ট অর্জন বা অতিক্রম করতে হবে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ শুধু মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এই বৃদ্ধির মধ্যে ব্যাপক ফাঁক থাকলেও উন্নতির ক্রেডিট নেয়ার জন্য এটুকু মানা যায়। আমরা বলছি না, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশে পরিণত হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব শ্রেণিতে ওঠার জন্য যে টেকসই উন্নয়ন দরকার তা হচ্ছে কিনা। বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিলে, এ ধরনের উন্নয়ন গতি অত্যন্ত ধীর হিসেবেই পরিলক্ষিত হয়। আমরা জানি, দেশে বিনিয়োগের চিত্র খুবই করুণ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যে হারে হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। ব্যাংকে লাখ লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। গত এক দশকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার হওয়ার খবর ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চুরি হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাংকে লুটপাট, অনিয়ম, দুর্নীতি ব্যাপক হারে চলছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ধনিক শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ত্রাহি অবস্থা। এ পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক বছরে দেশ প্রকৃত অর্থে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে, এটা ভাবা বেশ দুষ্করই বটে। অবশ্য ক্রেডিট নেয়ার জন্য শূন্যে দাঁড়িয়ে সরকার ঘোষণা দিয়েই দিতে পারে। দিলে কে তা চ্যালেঞ্জ করতে যাবে? আর ভুক্তভোগী জনগণেরইবা কি আসে যায়!
চার.
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে উন্নতি করতে চায় না। তবে উন্নতি করতে চাইলেও সবাই তা পারে না। সক্ষমতার একটা পর্যায় পর্যন্ত সে থেমে থাকে। এক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করতে পারে রাষ্ট্র ও সরকার। এখন সরকার যদি উন্নয়নের ফাঁপা হিসাব দেখায়, তবে ওই ব্যক্তিকে উন্নতির ফোকরে পড়ে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তার কথা বলারও উপায় থাকে না। সরকার যখন কঠোর হয়ে ওঠে এবং জনগণকে দাবিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার সাথে পৃথিবীর কোনো শক্তিই কুলিয়ে উঠতে পারে না। আমাদের সরকার জনগণের সাথে অনেকটা এরকম আচরণই করছে। সরকার যা বলছে, তার সাথে দ্বিমত থাকলেও বলার উপায় নেই। সরকার এখন উন্নয়নের পেছনে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এই দৌড়াতে গিয়েই অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তা বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক, বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখাচ্ছে। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ, বিনাভোটে নির্বাচিত সরকার তার ক্ষমতায় থাকার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। এটা করতে গিয়েই অর্ধসত্য থেকে শুরু করে অনেক মনগড়া তথ্যও তুলে ধরছে। সরকারের এ চাতুরি যারা বোঝার তারা ঠিকই বোঝে। গণতন্ত্রকে পেছনে ফেলে উন্নয়নের ফানুস উড়ানোর এই নীতির মাধ্যমে আর যাই হোক টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়ন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দুটোকেই সমানভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি কখনই ফলপ্রসূ হতে পারে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।