চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইসলামের প্রথম বাণী ‘ইকরা’ বা পড়ো। ৬১০ খৃস্টাব্দে মক্কার হেরা গুহায় জিব্রাইল (আ.) এর মাধ্যমে ঐশী বজ্র কণ্ঠে অনুরণিত হয়েছিলো এ বাণী। সে ঐশীধ্বনি মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রথম অনুপ্রেরণা। কাল-কালান্তরে এই একটি মাত্র শব্দতরঙ্গ জ্ঞানচর্চায় মুসলিমদের উতলা করে তোলেছে। প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রতিটি মুসলিম হ্রদয়ে। ইসলাম জ্ঞানচর্চায় যেটুকু গুরুত্বারোপ করেছে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্ম ও মতবাদ এতোটা গুরুত্বারোপ করেনি। ইলম বা জ্ঞানের গুরুত্বে ও মাহাত্ম্যে কুরআন ও হাদীসে প্রচুর উদ্ধৃতি রয়েছে। পার্থিব কোনো সম্পদ বৃদ্ধির দুআ আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা.) কে শেখাননি। শিখিয়েছেন একমাত্র জ্ঞানবৃদ্ধির দুআ। আল্লাহ বলেন : আর আপনি বলুনÑহে আমার প্রভু আপনি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন। (সূরা ত্বায়াহা : ১১৪)। প্রতিটি মুসলিম নর-নারীকে জ্ঞানার্জনে উদ্বেলিত করতে রাসূল (সা.) বলেন : ইলম তথা জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরজ। (ইবনে মাজাহ : ২২৪)।
রাসূল (সা.) জ্ঞানার্জনের চেতনা মুসলিমদের মধ্যে এমনভাবে জাগিয়ে তোলেছিলেন যে, তরুণ বৃদ্ধ ও নর-নারী সকলের মধ্যে জ্ঞান-চর্চার চেতনা উজ্জীবিত হয়েছিলো। ফলে তারা শুধু একটি হাদীসের জন্য একমাসের পথ পাড়ি দিয়ে মদীনা থেকে সুদূর সিরিয়ায় গমন করতেন। জ্ঞানের জন্য তারা আন্দালুস বা স্পেন থেকে খুরাসান পর্যন্ত চষে বেড়াতেন। সাহাবাগণ রাসূল (সা.) থেকে জ্ঞানাহরণের জন্য পালাক্রমে একজন সাহাবী সাংসারিক কাজকর্ম করতেন আরেকজন রাসূল (সা.) থেকে জ্ঞান আহরণ করে অপরজনকে জানাতেন। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) খেয়ে না খেয়ে রাসূল (সা.) থেকে জ্ঞানাহরণের জন্য মসজিদে নববীর একপাশে দিনাতিপাত করতেন।
এভাবে ইলম চর্চার ফলে জাহেলীয়াতে নিমজ্জিত একটি জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমগ্রবিশে^র অনুকরণীয় এক জাতিতে পরিণত হয়েছিলো। মুসলিমগণ তাফসীরুল কুরআন, হাদীস ও তার ব্যাখ্যা, সাহিত্য ও অলংকার শাস্ত্র, আরবী ভাষাবিজ্ঞান, ফিক¦াহ শাস্ত্র সহ অন্যান্য ধর্মদর্শনে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি জাগতিক সকল বিদ্যায় বিস্ময়কর অবদান রেখে গেছেন। আবহাওয়া বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, আইনবিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, রসায়নবিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে মুসলিমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। জ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় তাদের পদচারণা ছিলো সরব।
অস্ত্রোপচার বিদ্যায় আবুল কাসেম জাহরাভীর ‘আত-তাসরীফ’ চোখের ব্যাধি ও তার উপশমে আবুল কাসেম মাওসিলীর ‘আল মুন্তাখাব ফি ইলাজিল উয়ূন’ রসায়নে জাবের বিন হায়্যানের ‘কিতাবুর রহমাত’ ‘কিতাবুত-তাজমী’ ‘সুন্দুকুল হিকমা’ ও ‘রিসালাহ ফিল কিমিয়া’ বিজ্ঞানী আর-রাজীর ‘কিতাবুল হাজার’ ‘কিতাবুল আকসীর’ ‘কিতাবুদ-তাদবীর’ ও ইবনে আব্দুল মালেক আল-খাওয়ারেজমী আল-কাসী-এর ‘আয়নুস-সানাহ’ জ্যোতির্বিদ্যায় আল-বাত্তানীর ‘কিতাবুল জিয’ আবু মা’শার আল জাফরের ‘জিজ আবী মা’শার’ মহাবিজ্ঞানী আল-বিরুনীর ‘কানূনে মাসউদী’ বীজগণিতে উমর খৈয়ামের ‘কিতাবুল জাবর’ আল-কারখীর ‘আল-কাফী ফিল হিসাব’।
এল জেব্্রা খ্যাত মূসা আল-খাওয়ারিজমীর ‘হিসাবুল জাবরি ওয়াল মুকাবালাহ’ চিকিৎসাবিদ্যায় আবু আলী ইবনে সীনার ‘আল কানূন ফিত্তিব’ আলী ইবনে রাব্বানের ‘ফিরদাউসুল হিকমাহ’ বিজ্ঞানী আর-রাজীর ‘আল-কিতাবুল মানসূরী’ ‘আল কিতবুল হাভী’ ‘আল জুদারী ওয়াল হাসবাহ’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ফারাবীর ‘সিয়াসাত’ ‘আরা’ ও ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দামা’ ইতিহাস শাস্ত্রে কালবীর ‘জামহারাতুন-নাসাব’ ওয়াকেদীর ‘আল-মাগাযী’ বালাযুরীর ‘ফুতুহুল বুলদান’ তাবারীর ‘তারীখুল রুসুল ওয়াল-মুলূক’ আরবের হিরোডাটাস খ্যাত আল-মাসউদীর ‘মিরআতুয-যামান’ জাহাবীর ‘তারীখুল ইসলাম’ ইবনে আসাকিরের ‘তারীখে মাদীনাতে দিমাশক’ স্পেনীয় মনীষী ইবনে খালদূনের ‘তারীখে ইবনে খালদূন’ সহ মুসলিমদের শতশহস্র জ্ঞানগ্রন্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিমদের উজ্জ্বল স্মারক বহন করে চলছে। এসকল জ্ঞানখণ্ড আরবী থেকে লাতিন ও ইংরেজীতে অনূদিত হওয়ার পর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। (বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, লেখক মুহাম্মাদ নুরুল আমীন)।
সুতরাং মুসলিমরাই বিশ^সভ্যতার প্রথম ও প্রকৃত দীপাধার। আজকের আধুনিক বিশে^র উন্নতি ও চোখ ধাঁধানো উৎকর্ষের নেপথ্যে রয়েছে মুসলিম মনীষীদের অদম্য জ্ঞানসাধনা ও নিরলস বিদ্যাচর্চা। একথা পাশ্চাত্য ও ইউরোপের বহু গবেষক অকপটে স্বীকার করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।