Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চট্টগ্রামে আলোচনায় শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা

ফিরে দেখা ২০২২

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পাঁচ বছরের শিশু আলিনা ইসলাম আয়াত। তাকে অপহরণ করে খুনের পর লাশ ছয় টুকরো করা হয়। বস্তা ভরে সে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে ও খালে। চিপস কিনতে গিয়ে নিখোঁজ হয় শিশু মারজান হক বর্ষা। তিনদিন পর তার বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয় গলির মুখে একটি নালা থেকে। তাকে ধর্ষণের পর খুন করে লাশ বস্তায় ভরে নালায় ফেলে দেওয়া হয়।
সাত বছরের শিশু কন্যা হোসনে আরা আক্তার ইলমাকে দেয়ালে মাথা ঠুকিয়ে হত্যা করা হয়। গর্ভধারিণী মায়ের সহযোগীতায় নিস্পাপ এই শিশুকে খুন করেন মায়েরই পরকীয়া প্রেমিক। বিরিয়ানি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ধর্ষণের পর শ^াসরোধে খুন করা হয় সাত বছরের শিশু সুরমা আক্তারকে।
চলতি ২০২২ সালে চট্টগ্রামে আয়াত, বর্ষা আর ইলমাদের মতো অনেকে শিশু নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও নির্যাতনের নির্মম শিকার হয়েছে অনেক শিশু-কিশোর। চলতি বছর নগরীতে নয়টি খুনের ঘটনা ঘটে। জেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে তার দ্বিগুণ। শিশুর প্রতি ভয়ানক সহিংসতার ঘটনা বছরজুড়েই ছিল আলোচনায়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই, এলিট বাহিনী র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে এসব নিষ্ঠুরতায় জড়িতদের অনেকে ধরা পড়েছে। রহস্য উদঘাটন হয়েছে কয়েকটি আলোচিত শিশু খুনের। তবে বেশিরভাগ খুনের রহস্য উদঘাটন হয়নি, ধরা পড়েনি খুনিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক অস্থিতরা, নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক কলহ বিরোধে শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীদের কঠোর সাজা দ্রæত নিশ্চিত না হওয়ায় অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পরিচিত জন, প্রতিবেশি, স্বজন, সহপাঠী এমনকি মায়ের হাতেও সন্তান খুনের ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিপণের দাবিতে কিংবা ধর্ষণের ঘটনা চাপা দিতে খুন করা হয়েছে কয়েকটি শিশুকে।
দেশজুড়ে আলোচিত শিশু খুনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-আয়াত খুনের ঘটনা। নগরীর ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকায় গত ১৫ নভেম্বর আয়াতকে অপহরণ করা হয়। এই ঘটনার দশ দিন পর পিবিআই মূল আসামি আবির আলীকে পাকড়াও করে। আবির স্বীকার করে আয়াতের দাদার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করতে শিশুটিকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। আবিরের বাবা দীর্ঘদিন আয়াতদের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। আবিরের জন্ম বেড়ে ওঠাও সেখানে। হঠাৎ বড় লোক হয়ে যেতে আবির এই ভয়ানক কাÐ করে, যা ছিল পূবর্ পরিকল্পিত। হত্যার পর লাশ ছয় টুকরো করে কিছু নগরীর বে-টার্মিনাল এলাকায় সাড়রে আর কিছু অংশ সাগর তীরের একটি খালে ফেলে দেয়া হয়।
পরে পিবিআই খাল থেকে মাথা, হাতসহ কিছু খÐিত অংশ উদ্ধার করে আবিরের দেখানো মতে। আবির আলী জানিয়েছে খুনের পর লাশ গুম করে আয়াতের দাদার কাছে মুক্তিপণ দাবি করে ফোন করার কথা ছিল। এ জন্য সে একটি সিমও জোগাড় করে। তবে কুড়িয়ে পাওয়া ওই সিম লক হয়ে যাওয়ায় সে আর ফোন করতে পারেনি। এরমধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে পিবিআই। পিবিআই জানায় শিশুকে অপহরণ ও খুনের এই পরিকল্পনা করার আগে সে নিয়মিত ভারতীয় টিভি সিরিয়াল সিআইডি ও ক্রাইম পেট্রল দেখেছে। খুব শিগগির আয়াত হত্যা মামলার চার্জশিট দেবে পিবিআই।
গত ২৪ অক্টোবর নগরীর জামাল খান এলাকায় গলির দোকানে চিপস কিনতে গিয়ে নিখোঁজ হয় শিশু মারজান হক বর্ষা। তিনদিন তার লাশ উদ্ধার করা হয় গলির মুখে একটি নালা থেকে। ওই রাতেই পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গ্রেফতার করে মুদি দোকান শ্যামল স্টোরের কর্মচারী লক্ষণ দাশকে (৩০)। সে লোহাগাড়া উপজেলার উত্তর পদুয়া গ্রামের ফেলোরাম দাশের ছেলে। স্বীকার করে একশ টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে মুদি দোকানের পেছনে গুদামে নিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে। শিশুটি ধর্ষণে রক্তাক্ত হয়ে গেলে তাকে গলা টিপে হত্যা করে।
তার আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পোর্ট কলোনির ৮ নম্বর সড়কের মুখে একটি পরিত্যক্ত একতলা বাড়ির ভেতর থেকে সুরমা আক্তার নামে সাত বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বড়পোল এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক মো. কাউছারের মেয়ে। দীর্ঘ এক মাসের প্রচেষ্টায় পুলিশ ওই ঘটনায় জড়িত এক রিকশা চালককে পাকড়াও করে। গ্রেফতার ওসমান হারুন মিন্টু স্বীকার করেন ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে বিরিয়ানি খাওয়ানোর লোভ তাকে তুলে নেয়। পরে পোর্ট কলোনির পরিত্যক্ত বাসাটিতে পালাক্রমে ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করেন।
গত ১৫ জুন হাটহাজারীর বুড়িশ্চরে ঘরে হানা দিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় সাড়ে তিন বছরের শিশু মুহাম্মদ ওয়ালিদকে। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা ওয়ালিদের মা ইসরাত জাহান। তবে এখনও ওই শিশু খুনি কারা তা জানতে পারেনি পুলিশ। নিস্পাপ শিশুটি কেন খুনিদের টার্গেট হলো তাও এখনও অজানা। ২৮ এপ্রিল জেলার লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর এলাকায় ১১ বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। মো. সোহান নামে ওই শিশু মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল। এই ঘটনার রহস্যও জানা যায়নি। ১৯ আগস্ট রাউজান সদরে পাঁচ মাস বয়সী শিশু জাহান চৌধুরীর এবং ২৫ অক্টোবর সীতাকুÐের কদমরসুল এলাকায় তিন মাসের আরো এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনারও কোন ক‚ল-কিনারা হয়নি।
১৫ অক্টোবর নগরীর বন্দর থানার কলসিদীঘির পাড় জালাল কলোনীর একটি বাসায় শিশু ইলমাকে হত্যা করা হয়। সন্তানকে হত্যা করে লাশ বাসায় রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়রা মা বিউটি আক্তারকে আটক করে পুলিশে দেয়। পরে পিবিআই বিউটির পরকীয়া প্রেমিক মো. মনিরুল মোল্লা ওরফে মনির হোসেনকে পাকড়াও করে। মনির খুনের দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। মনির স্বীকার করে বিউটির সাথে তার পরকীয়া সম্পর্ক ছিল। বিউটি মনিরকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মনির তার সাত বছরের কন্যা সন্তান থাকায় বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না। বিউটির পরামর্শে সে শিশু ইলমাকে খুন করে।
গত ৫ মার্চ জেলার বোয়ালখালী উপজেলার দরণদ্বীপে মাদরাসার ছাত্র মালেকুল মাশফিকে (৭) গলা কেটে হত্যা করা হয়। তদন্তে পিবিআই নিশ্চিত হয় এই খুনের সাথে তার তিন সহপাঠী জড়িত। প্রতিহিংসার বশে তাকে খুন করে গলা কাটা লাশ মাদরাসার স্টের রুমে রেখে দেয় তারা। সম্প্রতি নগরীতে কয়েকটি শিশু অপহরণ ও চুরির ঘটনাও ঘটে। অপহৃত শিশুকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর বায়েজিদ এলাকায় একটি বাসা থেকে ইব্রাহিম হোসেন রাফাত নামে নয় বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। শিশুটির বাবা কার্ভাড ভ্যান চালক আর মা একটি কারখানায় চাকরি করেন। তিন বছরের ছোট ভাইসহ বাসায় একা ছিল রাফাত। রাতে বাসায় ফিরে তার মা খাটের ওপর গলায় গামছা পেছানো ছেলের লাশ দেখতে পান। এই ঘটনার এখনও কোন ক‚ল-কিনারা হয়নি।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আয়াত

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ