Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আয়াতুল কুরসি : মুমিনের রক্ষাকবচ

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২১, ১১:৪৬ পিএম

আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন মাজীদ মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য নাযিল করেছেন। আল কোরআনের প্রতিটি সুরা, প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ মুমিনের জন্য মহাউপকারী। আল কোরআনের স্বাভাবিক পঠন, আমল, হিফজ এবং আয়াতের মর্ম বাস্তব জীবনে পালনের মাধ্যমে ইহ ও পারলৌকি জীবনে সমুহকল্যাণ লাভ করা মুমিনের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। কোরআন মাজিদের প্রত্যেকটি সুরার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আবার প্রত্যেকটি সুরার মধ্যস্থিত কিছু কিছু আয়াতের বিশেষ ফযিলত রয়েছে। তেমনিভাবে পবিত্র কোরআনের সর্ববৃহৎ সুরা আল বাক্বারার ‘আয়াতুল কুরসি’ বিশেষ ফযিলতপূর্ণ আয়াত। মুহাক্কিক ওলামায়ে কেরাম, প্রখ্যাত তাফসিরবিদগণ ‘আয়াতুল কুরসির’ অগণিত ফায়েদা বর্ণনা করেছেন। তাদের ব্যাখ্যা মতে ‘আয়াতুল কুরসি’ হল মুমিনের জন্য রক্ষাকবচ। তাঁরা রাসুল (সা.) এর এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদিস বর্ণনার মাধ্যমে এ অভিমত পেশ করেছেন।

হযরত আবু যর জুনদুব ইবনে জানাদাহ (রা.) বলেন, একদিন আমি নবী (সা.)-এর কাছে এলে তাকে মসজিদে বসা দেখি এবং আমিও গিয়ে তার কাছে বসি। এরপর নবী (সা.) বলেন, হে আবু যর! নামাজ পড়েছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, ওঠো, নামাজ পড়ো। আমি উঠে নামাজ পড়ে আবারও গিয়ে বসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে তখন বলেন, মানুষ শয়তান থেকে এবং জিন শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষও শয়তান হয় নাকি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজ সম্বন্ধে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, এটা একটি উত্তম বিষয়। তবে যার ইচ্ছা বেশি অংশ নিতে পারে এবং যার ইচ্ছা কম অংশ নিতে পারে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আর রোজা? তিনি বললেন, এটি একটি উত্তম ফরজ এবং তা আল্লাহর কাছে অতিরিক্ত হিসেবে জমা থাকবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সাদকা? তিনি বললেন, এটা বহুগুণ বিনিময় আদায়কারী। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! কোন দান সবচেয়ে উত্তম? তিনি বললেন, অল্প সংগতি থাকতে বেশি দেয়ার সাহস করা এবং দুস্থ মানুষকে গোপনে সাহায্য-সহযোগিতা করা। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! সর্বপ্রথম নবী কে? তিনি বললেন, হজরত আদম (আ.)। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি কি নবী ছিলেন? রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনকারী নবী ছিলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! রাসুল কতজন ছিলেন? তিনি বললেন, তারা হলেন তিনশত দশ এরও কিছু বেশি। তবে অন্য সময় রাসূল (সা.) বলেছিলেন, তারা ছিলেন তিনশত পনের জন। এরপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার প্রতি সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন কোন আয়াতটি নাজিল হয়েছে? রাসূল (সা.) বললেন, ‘আয়াতুল কুরসি।’ (সুনানে নাসায়ি)।

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত উবাই বিন কাব (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উবাই বিন কাবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার দৃষ্টিতে কোরআন মাজিদের কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুআল হাইয়্যুল কাইয়্যুম তথা ‘আয়াতুল কুরসি’। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত দিয়ে তাঁর বুকে মৃদু আঘাত করে বলেন, আবুল মুনজির! এই জ্ঞানের কারণে তোমাকে মোবারকবাদ। (মুসলিম, হাদিস : ১৩৯৬)।

রাবীকুলের শিরোমনি, সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক রমজান মাসে যাকাতের সম্পদ পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন। তখন দেখতে পেলাম একজন আগন্তুক সদকার মাল চুরি করছে। তখন আমি আগন্তুকের হাত ধরে ফেললাম এবং বললাম, আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব। তখন আগন্তুক বলল, আমি খুব অভাবী আর আমার অনেক প্রয়োজন। তার এ কথা শুনে দয়া করে তাকে ছেড়ে দিলাম। পরদিন সকালে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল তোমার অপরাধী কী করেছে? আমি জবাব দিলাম, হে আল্লাহর রাসুল, লোকটি অনেক অভাবী তাই তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অবশ্যই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে। পরদিন আমি আবার অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন সে আবারও চুরি করতে এলো। তখন তাকে পাকড়াও করে বললাম, এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব। সে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি খুব অভাবী, আমার পরিবার আছে, আমি আর আসব না। তখন আমি তাকে দয়া করে এবারও ছেড়ে দিলাম। পরদিন আবারও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল তোমার অপরাধী কী করেছে? আমি এবারও জবাব দিলাম, হে আল্লাহর রাসুল, লোকটি অনেক অভাবী তাই তাকে দয়া করে ছেড়ে দিয়েছি। এবারও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অবশ্যই সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে আর সে আবার আসবে। তৃতীয় দিনও আমি চোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। যখন সে আবারও চুরি করতে এলো তখন তাকে পাকড়াও করে বললাম, এবার অবশ্যই আমি তোমাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে নিয়ে যাব, তুমি বারবার ওয়াদা করছ আর চুরি করতে আসছ। তখন সে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে এমন কিছু কথা বলে দেব, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাকে কল্যাণ দান করবেন। আমি বললাম, সেগুলো কী? তখন সে বলল, যখন ঘুমাতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমাবে। তাহলে আল্লাহ তোমার জন্য একজন পাহারাদার নিযুক্ত করবেন যে তোমার সঙ্গে থাকবে আর কোনো শয়তান সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে আসতে পারবে না। এটা শুনে আবু হুরায়রা (রা.) তাকে ছেড়ে দিলেন। পরদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার অপরাধীর কথা জানতে চাইলে তিনি আগের রাতের কথা বলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদিও সে চরম মিথ্যাবাদী; কিন্তু সে এই কথা সত্য বলেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু হুরায়রা (রা.) কে আরো বলেন, তুমি কি জানো সে কে? আবু হুরায়রা (রা.) বললেন, না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে হচ্ছে শয়তান। (সহিহ বুখারি: হাদিস: ২৩১১)।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি বস্তুরই চূড়া আছে। কুরআনের উচু চূড়া হল ‘সূরা আল-বাক্বরাহ’। এতে এমন একটি আয়াত আছে যা কুরআনের আয়াতসমূহের প্রধান। তা হল ‘আয়তুল কুরসী’। (জামে তিরমিজি: হাদিস: ২৮৭৮)।

হযরত উবাই ইবন কা‘ব (রা.) থেকে বর্ণিত, তাঁর এক খেজুর রাখার থলি ছিল। ক্রমশ খেজুর কমতে থাকত। এক রাতে সে পাহারা দেয়। হঠাৎ যুবকের মতো যেন এক জন্তু! তিনি তাকে সালাম দেন। সে সালামের উত্তর দেয়। তিনি বলেন, তুমি কী? জ্বিন নাকি মানুষ? সে বলে: জ্বিন। উবাই (রা.) বলেন, তোমার হাত দেখি। সে তার হাত দেয়। তার হাত ছিল কুকুরের হাতের মতো আর চুল ছিল কুকুরের চুলের মতো। তিনি বলেন, এটা জি¦নের সুরত। সে (জন্তু) বলে: জ্বিন সম্প্রদায়ের সাথে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। তিনি বলেন, তোমার আসার কারণ কী? সে বলে: আমরা শুনেছি আপনি সাদকা পছন্দ করেন, তাই কিছু সদকার খাদ্যসামগ্রী নিতে এসেছি। সাহাবী বলেন, তোমাদের থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? সে বলে: সূরা বাকারার এই আয়াতটি (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুআল হাইয়্যূল কাইয়্যূম)। যে ব্যক্তি সন্ধায় এটি পড়বে, সকাল পর্যন্ত আমাদের থেকে পরিত্রাণ পাবে। আর যে ব্যক্তি সকালে এটি পড়বে, সন্ধা পর্যন্ত আমাদের থেকে নিরাপদে থাকবে। সকাল হলে তিনি রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন এবং ঘটনার খবর দেন। রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘খবীস’ সত্য বলেছে।’ (সহীহুত তারগীব: হাদিস: ৪১৮)।

ইমাম নাসাঈ (রহ.) আবূ উমামা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি প্রতি ফরয সালাত শেষে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছু বাধা হবে না। (সহীহ আল জামে: হাদিস: ৬৪৬৪)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তুমি বিছানায় শুতে যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে। তাহলে সর্বদা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন হিফাযতকারী থাকবে এবং সকাল হওয়া অবধি তোমার নিকট শয়তান আসতে পারবে না। (সহীহ বুখারী: হাদিস: ৩২৭৫)।

‘আয়াতুল কুরসি’ এর ফযিলত প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বিভিন্ন গ্রন্থে মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন, তিনি বলেন, ‘সত্যতার সাথে যদি তুমি আয়াতুল কুরসী সে সময় পড় তাহলে তাদের কর্মকান্ড বাতিল হয়ে যায়, কারণ তাওহীদ শয়তানকে তাড়ায়। মানুষ যদি শয়তানী চক্রান্ত স্থানে সত্যতার সাথে ‘আয়াতুল কুরসী’ পড়ে, তাহলে তা (যাদু-মন্ত্র) নষ্ট করে দেয়। (কিতাব: ‘আল ফুরক্বান বাইনা আওলিয়াইর রহমান ওয়া আওলিয়াইশ শাইত্বান’)।

‘আয়াতুল কুরসি’ মুমিনের রক্ষাকবচঃ
‘আয়াতুল কুরসি’ পবিত্র কোরআনের অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ আয়াত। এটি মুমিনের রক্ষাকবচ। মুমিন ব্যক্তি জ্বিন শয়তানের সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য এটির উপর যথেষ্ট আমল করে ও উপকৃত হয়। এ ছাড়াও এ আয়াতের আমল আমলকারীকে আল্লাহপাক জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দেন। এ আয়াত পাঠ কারী ব্যক্তির প্রাণত্যাগ আসানের সহিত হয়ে থাকে। এ আয়াতের আমলের ফলে বান্দাহ সকল প্রকার বালা মুসিবত থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। এ আয়াতের নিয়মিত আমলকারী ব্যক্তি ব্যবসা বানিজ্য চাকুরী বা কর্মক্ষেত্রে হিংসা বিদ্বেষ প্রসুত নানাবিধ ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকে। বুযুর্গানে দ্বীন বলেন, কোন ব্যক্তি যদি সফরের পূর্বে ‘আয়াতুল কুরসি’ পাঠ করে আল্লাহপাক ঐ ব্যক্তি পথিমধ্যের অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে হেফাজত করেন।

পরিশেষে, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে ‘আয়াতুল কুরসির’ উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখকঃ মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়খালী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ