Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীনতা ও বিজয়ের তাৎপর্য

ড. মো. কামরুজ্জামান | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:১২ এএম

ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্বের সকল মানুষই আল্লাহর গোলাম বা বান্দা। আর আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকল মানুষ সমান ও স্বাধীন। তাই কোনো মানুষকে অধীনস্ত দাস মনে করা সমীচীন নয়। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষই স্বাধীন সত্তার অধিকারী। ইসলাম এ স্বাধীনতাকে মানুষের জন্মগত অধিকার বলে মনে করে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে স্বাধীন করেই সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকটি মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীনভাবেই জন্মগ্রহণ করে। নবীজি (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেকটি নবজাতক তার স্বভাবধর্মে জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে বিভিন্ন আদর্শে শৃঙ্খলিত করে ফেলে।’ (বুখারী ও মুসলিম)। আল্লাহ মানুষকে তার চিন্তা ও কর্মে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। তিনি কাউকেই পরাধীন করে সৃষ্টি করেননি। আর তিনি পরাধীনতা পছন্দও করেন না। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ঈমান আনার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। অথচ ইচ্ছা করলেই তিনি সকলকে ঈমানদার বানিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু এটা তিনি মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন: ‘তোমার প্রতিপালক চাইলে বিশ্ববাসী একযোগে ঈমানদার হয়ে যেতো (কিন্তু তিনি তা করেননি)। তবে তুমি কি তাদের ঈমানদার বানাতে শক্তি প্রয়োগ করবে?’ (সূরা ইউনুস: ৯৯)। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আল্লাহ ইচ্ছা করলেই বিশ্বের সকল মানুষ মুমিন হয়ে যেতো; সবাইকে তিনি ঈমানদার বানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি এটা করেননি এবং চাননি। বরং তিনি চেয়েছেন, যাতে মানুষ বুঝে শুনে ঈমান আনয়ন করে। ইসলাম মানুষের দাসত্ব করাকে যেমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ঠিক তেমনি কাউকে দাসত্বে আবদ্ধ করাকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সুতরাং স্বাধীনতা হলো মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা অনুমোদিত। এ অনুমোদনের ফলে একজন নাগরিক আইনসিদ্ধ সকল কাজ করার অধিকার লাভ করে থাকে। ইসলামের শাশ্বত কালিমা হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এ কালিমা ঘোষণার অর্থই হলো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া। এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই একজন মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। সে পরাধীনতার সকল নাগপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সে মানবরূপী দানবের দানবীয় প্রভুত্ব থেকে বেরিয়ে আসে। সে মানবরচিত সকল দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করে। একই মানুষ অন্য আরেকজন মানুষের দাসত্ব করবে, এটা ইসলাম সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘হে মানবসকল! তোমরা শুধুমাত্র তোমাদের প্রভুরই দাসত্ব করো, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন! জেনে রাখো! তিনি ছাড়া দাসত্বের উপযোগী অন্য কেউ নন’ (সুরা হুদ: ৮৪ )। কিন্তু যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষের উপর শাসনের নামে শোষণ করেছে। শাসকেরা ক্ষমতার অন্তরালে নিজেদেরকে প্রভুর আসনে বসিয়েছে। নমরুদ-ফেরাউন নিজেদের প্রভু দাবি করেছে। (সুরা নাযি›আত: ২৪)। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এ শাসকবৃন্দ সীমাহীন দানবীয় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে। তাদের মনগড়া আইনের দ্বারা জনগণকে বন্দি করে রেখেছে। বর্তমান যুগকে উন্নতি ও অগ্রগতির যুগ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এ যুগেও প্রভুত্বের সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। আমেরিকা থেকে সুদূর বাংলাদেশ। সকল শাসকের মাঝেই ভয়ানক এক প্রভুত্বকামী মানসিকতা বিরাজ করছে। অন্যদের নিজের অধীন এবং অন্য রাষ্ট্রকে করদরাজ্য বানানোর দানবীয় ঔদ্ধত্য এখনও চলমান রয়েছে। তারা তাদের ক্ষমতাবলে দুর্বলদেরকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ রাখার হীন মানসিকতা অব্যাহতভাবে প্রদর্শন করে চলেছে ।

ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আগমনের সময় প্রবল ক্ষমতাধর ছিল রোম এবং পারস্যের শাসকরা। তাদের রচিত আইন ছিল নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ। নিষ্ঠুর এবং নির্মম আইন দ্বারা জনগণের স্বাধীনতাকে তারা রুদ্ধ করে রেখেছিল। এ সময়টি গোটা বিশ্ব অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল নির্দিষ্ট কতক গোষ্ঠি কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ছিল প্রভাবশালীদের পৈতৃক সম্পত্তি। বাকস্বাধীনতা ছিল ভূলুণ্ঠিত। মানুষের রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ধর্মনীতি ছিল দাসত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ। এক কথায়, বিশ্ব মানবতা তখন ক্রীতদাসে রূপান্তরিত হয়েছিল। উপমহাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ১৭৫৭ সালে এ উপমহাদেশকে ব্রিটিশরা তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করে। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়। ফলে স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষেরা মুক্তির চেতনায় জেগে ওঠে। বঞ্চিত মানুষের আন্দোলনে ব্রিটিশদের গোলামির দেয়াল ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি ব্রিটিশদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে থাকে। তারা বাঙালি জাতির শিকড়ে কুঠারাঘাত করে। তারা সাত কোটি বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হানে। তারা জনগণকে পরাধীনতার শিকলে বন্দি করে। ফলে বাঙালি জনতা তাদের ভাষা রক্ষায় আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বাধিকার আন্দোলনে তারা রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ বাংলায় নতুন করে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ নয় মাস অবধি চলমান থাকে। জালিমশাহী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির পরাজয় ঘটে। অর্জিত হয় চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা। মুক্তিকামী জনতা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভ করে। জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

প্রত্যাশিত এ বিজয়টি ছিল সাত কোটি বাঙালির জন্য অত্যন্ত গৌরবের। গৌরবগাঁথায় ভরা এই বিজয় তাই বিশ্ব ইতিহাসে স্বর্ণালি অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। মনে রাখা দরকার, কোনো বিজয় যখন জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হয়; তখন তার প্রকৃত লক্ষ্য ব্যাহত হয়ে পড়ে। আরো মনে রাখা দরকার, বিজয়ীরা যখন নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েন; বিজিত দেশটি তখন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। আর বিজয়টা তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে যায়। ইসলাম এসব নীতিভ্রষ্টতাকে সমর্থন করে না। ইসলামে নীতিহীনতার স্থান নেই। ইসলাম সামগ্রিকভাবে মানবতাবাদী এক আদর্শের নাম। এ আদর্শ চিরস্থায়ী সমতার নীতিতে বিশ্বাসী। বড়-ছোটোতে এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। বর্ণবাদী কৌলিন্য ইসলামে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এসব নীতিবাক্য ইসলাম শুধুমাত্র বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের শিখন ও পঠন হিসেবে ইসলাম এটাকে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে । মহানবী (সা.) কর্তৃক দাসত্ব প্রথা উচ্ছেদই তার জ্বলন্ত নিদর্শন। তিনি শুধু দাসত্ব প্রথাকে উচ্ছেদই করেননি; বরং তিনি দাসকে সন্তানের মর্যাদা প্রদান করেছেন। দাসকে তিনি ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। দাসকে সেনা কমান্ডার নিযুক্ত করে পৃথিবীতে এক জ্বলন্ত ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আধুনিক যুগে দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলাকে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী প্রসিদ্ধ এক নেতা। অথচ, মহানবী (সা.) কৃষ্ণবর্ণের হাবশী দাস বেলালকে (রা.) মসজিদে নববীর প্রধান মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করেছিলেন। আর এ নিয়োগটা ছিল আজ থেকে ঠিক ১,৪৫১ বছর আগে। তিনিই বিশ্বে সর্বপ্রথম সাদাকালোর ব্যবধান দূর করেছিলেন। তিনি আরব-অনারবের কৌলিন্য প্রথার বিলোপ সাধন করেছিলেন। তিনি (সা.) ঘোষণা করেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নাই, অনারবের উপার আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নাই। কেউ কারো উপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।’ (বুখারী) ইসলামের সাম্যবাদী এ বাণী বিদ্যুৎবেগে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গোটা আরবে অভাবনীয় এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আরবের ধনী-গরিব সবাই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। এটা ছিল মূলত ইসলামের সামগ্রিক সৌন্দর্য ও স্বাধীনতার সুফল। স্বাধীনতার এ সুফল দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল রোম এবং পারস্যে। আরবের আকাশ প্রাচীর ভেদ করে এটা আছড়ে পড়েছিল সুদূর আফ্রিকা ও ইউরোপের আকাশে। এ উপমহাদেশও তার বাইরে ছিল না। শ্রেণী বৈষম্যে জর্জরিত ভারতের মানুষ দলে দলে আশ্রয় নিয়েছিল ইসলামের ছায়াতলে। তারা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে দীক্ষিত হয়েছিল বৈষম্যহীন ইসলামী আদর্শের পতাকা তলে।

অবশ্য এ স্বাধীনতা অসীম ও বল্গাহীন নয়। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। এর মৌলিক অর্থ হলো, ন্যায় ও কল্যাণের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে মননশীলতা ও মুক্ত চিন্তা। স্বাধীনতা মানে নিজের মতো অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া নয়। কারো চলার পথ বন্ধ করার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা মানে সত্য ও সুন্দরের কথা বলা; সৃজনশীলতা প্রচার করা। স্বাধীনতার অর্থ অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। স্বাধীনতা মানে অসুন্দরকে বর্জন করা।

ইসলাম স্বাধীনতা ও বিজয়কে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। একইভাবে দেশাত্মবোধকে সমভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছে। দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধকে ঈমানের অঙ্গ ঘোষণা করা হয়েছে। নবী জীবনের স্বভাবে দেশপ্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাঁর জন্মভূমি মক্কাকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। তিনি স্বজাতি কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে মদিনা পানে হিজরত করেন। হিজরতকালে তিনি বারবার পিছনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলছিলেন: ‘হে আমার স্বদেশ! হে আমার প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা! তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। তুমি আমার কাছে সমস্ত স্থান থেকে অধিক প্রিয়। কিন্তু আমাকে তোমার লোকেরা এখানে থাকতে দিল না। তারা আমাকে তোমায় ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে।’ (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)।

তিনি হিজরত করে মদিনায় বসবাস শুরু করেন। মদিনাকেও তিনি নিজ মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন। আর এ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষায়ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ইসলাম রক্ষায় যেমন ছিলেন নিবেদিত, তেমনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায়ও ছিলেন সমান আন্তরিক। নিম্নোক্ত হাদিস তারই প্রমাণ বহন করে। আনাস (রা.) বলেন: ‘একবার খায়বার অভিযানে আমি নবীজির সাথী ছিলাম। অভিযান শেষে আমরা মদিনার দিকে ফিরছিলাম। এমন সময় ওহুদ পাহাড় আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো। নবীজির মুখে তখন আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ওহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে আর আমরাও ওহুদ পাহাড়কে ভালবাসি।’ (বুখারী ও মুসলিম)। মদিনার সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত হলো পরিখা খনন। ৬২৭ সালে বহিঃশত্রু কর্তৃক মদিনা আক্রান্ত হলে তিনি মদিনাকে রক্ষার সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। দাসত্ব থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া সালমান ফারসীর (রা.) পরামর্শ ক্রমে তিনি মদিনার তিনদিকে পরিখা খনন করেন। তিনি মাতৃভূমি পাহারার জন্য বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘মাতৃভূমি রক্ষার জন্য এক রাত পাহারায় থাকা ধারাবাহিকভাবে এক মাস রোজা ও নফল নামাজ আদায় করা থেকে উত্তম।’ (মুসলিম) ‘একদিন সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকা হাজার দিনের মঞ্জিল পার হওয়া অপেক্ষা উত্তম।’ (তিরমিজি) এছাড়া তিনি মদিনার শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। (সূরা ইবরাহিম: ৩৫) এসমস্ত বর্ণনা এটাই প্রমাণ করে যে, যেকোনো শত্রু কর্তৃক দেশ আক্রান্ত হলে সে আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি নাগরিকের ঈমানী দায়িত্ব।

স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশপ্রেমের পাশাপাশি ইসলাম বিজয় সম্পর্কে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআনে ‘বিজয়’ নামে দুটি সূরা উল্লেখিত হয়েছে। একটির নাম হলো সুরা ‘আল ফাতহ’ বা বিজয়। আর অন্যটির নাম হলো সুরা ‘আন নছর’; যার অর্থ বিজয় কিংবা মুক্তি। কোনো দেশের বিজয় পরবর্তী করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কেও ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছে। ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, দেখবেন মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করছে। তখন আপনি আপনার রবের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করুন! আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন! নিশ্চয়ই তিনি তওবা কবুলকারী।’ (সূরা নছর: ১-৩)। ‘যখন আমি তাদেরকে পৃথিবীর নেতৃত্ব (স্বাধীনতা, বিজয় ও ক্ষমতা) প্রদান করি তখন তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, সৎকাজে আদেশ প্রদান করে এবং অসৎ কাজে নিষেধ প্রদান করে।’ (সূরা হাজ্জ: ৪১)। নবীজি (সা.) মক্কা থেকে বিতাড়িত হলেন। ১০ বছর মদিনায় অবস্থান করলেন। তিনি ১০ বছর পরে বিজয়ীবহর নিয়ে মক্কা নগরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি বিজয় মিছিল বের করেননি। কোনো শোভাযাত্রারও আয়োজন করেননি। গান ও বাজনা বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করেননি। গর্ব-অহংকার কিংবা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেননি। মক্কায় প্রবেশের সময় মহানবী (সা.) একটি উটের পৃষ্ঠে আরোহণ অবস্থায় ছিলেন। তাঁর চেহারা ছিল নিম্নগামী। মক্কায় প্রবেশ করে তিনি সর্বপ্রথম উম্মে হানির ঘরে প্রবেশ করেন। আট রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি মসজিদে হারামে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন: ‘হে মক্কাবাসী! তোমরা আমার উপর, আমার পরিবারের উপর এবং আমার সাথীদের উপর এতদিন যাবত অত্যাচার চালিয়েছো। আজ আমি তোমাদের সকলের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলাম। আজ তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন। তোমাদের উপর কোনো প্রতিশোধ নেয়া হবে না।’ (সুনানে বায়হাকী ৯/১৮)

এতে বুঝা গেল যে, ইসলামে স্বাধীনতা ও বিজয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের স্বাধীনতা ও বিজয় অর্জন আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় নেয়ামত। এ নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। কারণ, বান্দা যদি নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আল্লাহ সেই নেয়ামত অনেকগুণে বৃদ্ধি করে দেন। অপরপক্ষে বান্দা যদি ঐ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে তাহলে আল্লাহ কঠিন শাস্তি প্রদান করেন (নেয়ামত তুলে নিয়ে যান)। (সূরা ইবরাহিম: ৭)। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। কিন্তু দেশনায়ক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার মূল চেতনা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও কাজ স্বাধীনতার মূল স্পিরিটকে ম্রিয়মান করে তুলেছে। বিজয়ের মূলনীতি এখন নিভৃতে-নিঃশব্দে ক্রন্দন করছে। দেশ অপরাজনীতি আর দুর্নীতির করালগ্রাসে নিপতিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ বার বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ অবস্থার মূল কারণ হলো, স্বাধীনতার চেতনাকে অমান্য করা। আল্লাহ প্রদত্ত বিজয়কে নিজের হীন স্বার্থে ব্যবহার করা। সময় এসেছে আমাদের বিজয়ের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গিকে জাতীয়ভাবে তুলে ধরা। এক্ষেত্রে গোটা জাতির উচিত নবী অনুসৃত নীতি অনুসরণ করা।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীনতা ও বিজয়ের তাৎপর্য
আরও পড়ুন