Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

| প্রকাশের সময় : ৩ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম


শুক্রবার আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ২০২২।১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর ক্যারিবিয়ান দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী সরকারবিরোধী মিরাবেল ভগ্নিত্রয়কে সেনা সদস্যরা ধর্ষণ ও হত্যা করেন। এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় নারী সম্মেলন এই হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে ২৫ নভেম্বরকে ‘নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিরোধ দিবস’ঘোষণা করে।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপ মতে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।
জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামী কিংবা তার পরিবার বা উভয়ের দ্বারা নির্যাতিত হন।পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর ধর্ষণের মামলা ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১০ হাজার ৪০৮টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০২০ সালে প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৪৯ শতাংশ মামলা ছিল ধর্ষণের। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে এই হার ৪৮। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৫২৩টি। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি কল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪, যৌন নির্যাতন ২৬৮, ধর্ষণের হুমকি ৩১ এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগে ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫ এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি কল আসে।এছাড়াও বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে সাতজন নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সাত শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উন্নত-অনুন্নত সব দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র আরও অমানবিক। দিবসটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন সংগঠন আজ নানা কর্মসূচি পালন করবে।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা অনস্বীকার্য।ইসলামে নারী নির্যাতনের স্থান নেই।নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রিয়া নবী (সা) সর্বদা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে মানুষ! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করো না। তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সবসময় খেয়াল রেখো।নারী-পুরুষের যুগলযাত্রার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে খোদায়ী খেলাফতের শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল।সে যাত্রায় আদম ও হাওয়া (আ.) ছিলেন সহযাত্রী। তাঁদের ভালোবাসায় ভরা সেই ছোট্ট সংসারই পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি, সৌন্দর্য আর উন্নয়নের ভিত্তি। কিন্তু তাঁদের সন্তান হিসেবে আমরা সাংসারিক জীবনের আদর্শকে ধরে রাখতে পারিনি। তাই পৃথিবী সীমাহীন জৌলুসের মধ্যেও তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে, সংসার হয়ে উঠছে আগ্নেয়গিরি।
নারী-পুরুষের আন্তরিক সম্পর্ক যেখানে খোদার ধরণীকে প্রেমপূর্ণ ও শান্তিময় করে তোলার কথা, সেখানে বিদ্বেষী ভাব আজ লেলিহান শিখার মতো জ্বলছে। মহান আল্লাহর কঠোর নির্দেশ উপেক্ষা করে নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। আর ইসলামই নারীর সর্বোচ্চ অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় আলোচিত বিষয় নারী নির্যাতন। বাংলাদেশসহ বিশ্ব মিডিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতিদিনই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও অহরহ ঘটে চলেছে নারীর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন। নিঃসন্দেহে নারীর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য প্রতিরোধে ইসলামই একমাত্র ভরসার স্থল।
ইসলামে নারীর মর্যাদা:- ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান। আলাদা আলাদা করে বলতে গেলে ইসলামই দিয়েছে নারীকে মায়ের মর্যাদা। স্ত্রী মর্যাদা ও পারস্পরিক সুসম্পর্ক, বোনের যথাযথ অধিকার এবং কন্যার প্রতি দায়িত্ব পালনের অধিকার সংরক্ষণ সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে ইসলাম। কোরআনে নারীর অধিকার রক্ষায় আল্লাহ ঘোষণা দেন-অর্থ হে নবি! ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা মুমতাহিনা : আয়াত ১২)
নারীর যত প্রতিবন্ধকতা:-আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার নামে নারীকে অগ্রসর ভাবা হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে মর্যাদা সম্মান ও নিরাপত্তায় বরং নারীরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। আধুনিকতার নামে নারীরা সম্মান মর্যাদায় পিছিয়ে যাচ্ছে। অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এবং বহু ক্ষেত্রে তারা নির্যাতিত হচ্ছে। আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা নারীর কল্যাণে সেভাবে পাশে দাঁড়াতেও ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে নারীরা এখনও এসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেনিম্নে কারণ গুলো উল্লেখ করা হয়েছে-
১. নিরাপদে ঘুরতে বের হতে পারে না। ২. পাচারের শিকার হয়। ৩. জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য হয়। ৪. অহরহ যৌন হয়রানির শিকার হয়। ৫. গর্ভবতী নারীও স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ও ননদদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পায় না। ৬. যৌতুকের বলি হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়। ৭. স্বামী ও পিতার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ৮. অধিকাংশ নারীই পায় না তার ন্যয্য মোহরানার অধিকার। ৯. ঝুঁকিপূর্ণ গৃহপরিচারিকার কাজ থেকে মুক্তি পায় না কোমলমতি শিশুকন্যা। ১০. শ্রমের সঠিক মূল্যয়ন পেতেও ব্যর্থ নারীরা। ১১. আধুনিক সভ্যতাই উচ্চ মর্যাদার নামে নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। ১২. কৌশলে ধর্মীয় অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে নারীকে। ১৩. স্বাধীনতার নামে ইসলামের সবচেয়ে ঘৃনিত কাজ তালাকের অপব্যবহারের বলি হচ্ছে নারীরা।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকাই সঠিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ।কেননা ইসলামই নারীর শিক্ষা অর্জনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। এমনকি ইসলামি শরিয়াতের সীমার মধ্যে থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে পুরুষের মতো শ্রম-সাধনা করায় নারীর সমান অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছে ইসলাম।নারীদের ওপর যেসব কারণে নির্যাতন করা হয়, সেগুলো কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। যেমন যৌতুকের দাবি না মেটানো, স্বামীর মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনের সেবায় ত্রুটি করা, তরকারিতে লবণ বা তেল কম-বেশি হওয়া ইত্যাদি। শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারীদের জন্য এ ধরনের কার্যকলাপ মুসলিম পরিচয়ের অযোগ্যতা প্রমাণ করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমানিত করতে পারে না, তাকে অন্যের কাছে হেয় করতে পারে না। এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) ‘তাকওয়া এখানে’ বলে তিনবার নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করেন। তারপর রাসুল (সা.) বলেন, একজন মুসলমানের কাছে অন্য মুসলমানের জীবন, সম্মান ও সম্পদ অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ।’ (সহিহ মুসলিম)।
পরিশেষে বলতে চাই, মুসলিম উম্মাহর উচিত, নারী প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সব হক যথাযথভাবে আদায় করা। নারীকে মর্যাদা দেওয়া। নারীর মর্যাদা রক্ষায় কুরআন-সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করা।আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহসহ সবাইকে নারীর প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদায় ইসলামের বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন। তাই নারী নির্যাতনের বিপক্ষে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ