মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
‘আমার বাবা মারা যান ২০০৯ সালে। তিনিই বলে গিয়েছিলেন যে আমাদের মা থাকেন পাকিস্তানের করাচি শহরে, আর আমাদের জন্মও হয়েছিল করাচিতেই। বাবা আরো বলেছিলেন - যদি পারো তোমরা অবশ্যই তোমাদের আসল মা-কে খুঁজে বের করো,’ বলছিলেন উম্মি মুরসালিনা - এখন ডেনমার্কের বাসিন্দা। তার আগে তিনি থাকতেন বাংলাদেশে তার বাবার সাথে।
তিনি আর তার ছোট বোন উম্মি তসলিমা যখন একেবারেই শিশু - তখন অত্যন্ত বেদনাদায়ক এক পরিস্থিতিতে তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন মুরসালিনার বয়স চার, তসলিমার দুই। উম্মি তসলিমা এখন বাংলাদেশেই থাকেন। বাবার মুখে মায়ের হারিয়ে যাবার এই গল্প শোনার আগে তারা কিছুই জানতেন না যে তাদের মা কে, বা তিনি কোথায় আছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে এ বছরের অক্টোবর মাসে এই দুই বোন তাদের সেই হারানো মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছেন।
বাবা মারা যাবার পর দুই বোন তাদের খালার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তাদের শিশু বয়সের একটি ফটো - যাতে তাদের মা-কেও দেখা যাচ্ছে। "তখন থেকেই আমরা চাইছিলাম কীভাবে মা-কে খুঁজে বের করবো, কীভাবে তার স্পর্শ পাবো, তাকে আদরযত্ন করবো।" কিন্তু অনেক বছর পর্যন্ত তারা জানতেও পারেননি যে তাদের মা আদৌ জীবিত আছেন কিনা। উম্মি তসলিমা বলছিলেন, তাদের জন্য এটা ছিল এক গভীর দুঃখের ব্যাপার যে শৈশব থেকেই তারা মায়ের স্নেহস্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাদের মা-ও তার দুই মেয়ের কথা মনে হলেই চোখের পানি ফেলতেন। ‘কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই দাদী-নানী হয়েছি। আমরা বুঝি যে সন্তান হারানোটা একজন মায়ের জন্য কতটা বেদনার। তাই এখন আমাদের একটা সুযোগ পাওয়া উচিত যাতে আমরা মা কে দেখতে পারি, তার সাথে কিচুটা সময় কাটাতে পারি।’
চমন আরা বলছেন, তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দেন ১৯৬৭ সালে মোহাম্মদ মুসলিমের সাথে। সেসময় মুসলিম থাকতেন করাচিতে এবং পাকিস্তানের বিমান সংস্থা পিআইএতে চাকরি করতেন। ‘বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে দেখিনি, তবে বিয়ের পর আমরা পরস্পরকে ভালোবেসেছিলাম।’ চমন আরা বলছিলেন, তাদের বিবাহিত জীবন ভালোভাবেই চলছিল এবং তাদের তিনটি কন্যাসন্তান হয়।
উনিশশ' একাত্তর সালে যখন বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে - তখন তাদের বড় মেয়ের বয়স তিন, মেজো মেয়ের বয়স দুই এবং সবচেয়ে ছোট মেয়েটি তখনও বুকের দুধ খায়। চমন আরা তখন আবারও গর্ভবতী। ‘১৯৭১ সালের আগে আমি কয়েকবার ঢাকা গিয়েছি, তবে আমাকে করাচি ফিরে আসতে হয়েছিল কারণ মুসলিম তখনো সেখানে চাকরি করছেন।’ চমন আরা বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালে ঈদুল আজহার পর নির্বাচন হয়ে গেছে। সে সময়টাতেই মুসলিমের বড় ভাইয়ের কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম এলো। তাতে খবর ছিল, বড় ভাই একটা গুরুতর দুর্ঘটনায় পড়েছে এবং তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, মুসলিমকে তার পরিবার নিয়ে ঢাকা যেতে হবে।’
মুসলিম তক্ষুণি ঢাকায় যাবার ব্যবস্থা করলেন। ‘দু-একদিনের মধ্যেই আমরা ঢাকা পৌঁছালাম। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সেখানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। মুসলিমের বড় ভাই ও তার পরিবার আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। সেখান থেকেই আমার দুর্ভাগ্যের শুরু। আমি এমন অবস্থায় পড়লাম যা আমি কখনো ভাবতেই পারিনি।’
চমন আরা বলছিলেন, তিনি ঢাকায় ছিলেন এক মাসের মত। সেটা ছিল একটা খুব কঠিন সময়। "মুসলিমের পরিবার আমার ওপর অত্যাচার করতো। তারা বলতো, আমাদের এখান থেকে চলে যাও। যে মুসলিম আমাকে খুবই ভালোবাসতো - সে এখন আমার কথা শুনতেই চাইতো না। আমি জানি না কেন।" চমন আরাকে তার দুই মেয়ের থেকে আলাদা করে ফেলা হলো। তার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ভারতে উত্তর প্রদেশে - যেখান চমন আরার মায়ের দিকের আত্মীয়স্বজনরা থাকতো।
"মুসলিম আমাকে সেখানে ফেলে রেখে চলে গেল, তবে বললো যে কিছুদিন পরই সে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।" চমন আরা বলছেন, প্রথম কিছু দিন তার মায়ের আত্মীয়স্বজনরা তার সাথে ভালো ব্যবহারই করেছিলেন। কিন্তু চমন আরা যে ভারতে থাকছেন, তার সাথে কোন পাসপোর্ট বা কাগজপত্র কিছুই ছিল না। তিনি সেখানে যাবার সময়ই গর্ভবতী ছিলেন, এবং কিছুকাল পর ভারতেই তার পুত্রসন্তানের জন্ম হয়।
দুটি শিশুকে নিয়ে চমন আরা কীভাবে চলবেন বুঝতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে তাকে তারই এক দূরসম্পর্কীয় চাচার বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে জীবন শুরু করতে হলো। "আমার চাচা চাইতেন না যে আমি বাইরের লোকের বাড়িতে কাজ করি। আমাকে প্রতি মাসে ভারতীয় মুদ্রায় চার রুপি করে দেয়া হতো।" ভারতে থাকার সময় একে একে তার ছোট মেয়ে এবং নবজাত পুত্রসন্তান - দুজনেই মারা গেল। "মুসলিম মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি লিখতো। আমিও জবাব দিতাম। সে আমাকে সান্তনা দিতো। কিন্তু আট বছর সে আমাদের দেখতে আসেনি। আমার আত্মীয়স্বজনরা এ নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। আমিও কান্নাকাটি করতাম।"
জুলফিকার আলি ভুট্টো যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী - তখন তার সাথে দেখা করেন চমন আরা-র মা। তার চেষ্টায় ভারতে পাকিস্তানী দূতাবাসের কর্মকর্তারা চমন আরার খোঁজ করে সাথে দেখা করেন। এর পর নতুন পাকিস্তানি পাসপোর্ট পেলেন চমন আরা এবং তিনি পাকিস্তানে গিয়ে পৌঁছালেন। চমন আরা বলছিলেন, পাকিস্তানে থাকার সময়ও মুসলিম তাকে চিঠি লিখতেন।
"আমি তার চিঠি যত্ন করে রাখতাম। কিন্তু একদিন বৃষ্টিতে ভিজে সব চিঠি নষ্ট হয়ে গেল। তার পর ধীরে ধীরে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমি তার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু মুসলিম কোন যোগাযোগ করতো না। এভাবে কতদিন চলতে পারে?" কিছুকাল পর চমন আরার আত্মীয়স্বজনরা তাকে আবার বিয়ে দিয়ে দিলেন।
দ্বিতীয় বিয়ের পর চমন আরার আরো পাঁচটি সন্তান হয়। তারা সবাই এখন বড় হয়েছে, বিয়ে করে ছেলেমেয়ের বাপ-মা হয়েছে। তিনি বলছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ের পর তার জীবন সুখেরই ছিল। স্বামী, সন্তান আর সংসার নিয়ে তার ছিল ব্যস্ত জীবন। কিন্তু প্রথম দুটি মেয়েকে হারানোর দুঃখ তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। প্রতিবার নামাজ পড়ার পর তিনি তাদের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করতেন। কিন্তু অনেক বছর পর একদিন ঘটলো সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। "একদিন ওয়ালিউল্লাহ মারুফ আমাদের বাড়িতে এলো। সে আমার পুরোনো ছবি দেখলো। তার পর বললো, আমার সেই দুই মেয়ে জীবিত আছে এবং তারা আমাকে খুঁজছে।"
উম্মি মুরসালিনা বলছিলেন, তার বাবা তাকে তার মায়ের গল্প বলার কয়েকদিন পরই মারা যান। "হয়তো এই গোপন কথাটা বলার জন্যই তিনি বেঁচে ছিলেন। তার শরীর তখন খুবই খারাপ - তাই আমি তার সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারিনি। কিন্তু এসব শুনে আমার মন অস্থির হয়ে উঠলো, আমি ছোটবোন উম্মি তসলিমাকে ব্যাপারটা বললাম।"
এ গল্প শোনার পর দুই বোন মিলে তাদের মায়ের জন্য অনেকক্ষণ ধরে কাঁদলেন। "আমাদের মন বলছিল যে মা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন, এবং তার সাথে আমাদের দেখা হবেই। কিন্তু আমাদের কাছে মায়ের কোন ছবি বা কোন পরিচয়পত্র কিছুই ছিল না।" উম্মি মুরসালিনা বলছিলেন, "একদিন আমি সাহস করে আমার দাদীকে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি আমার মায়ের দুটো পুরোনো ফটো বের করে দিলেন। তখন থেকেই আমরা মায়ের খোঁজ শুরু করলাম।" "আমার মেয়ের জামাই নিয়াতুল্লাহ কাজি এই অনুসন্ধানে সাহায্য কললো। সে পাকিস্তানে নানা জনের কাছে মায়ের ছবি পাঠালো, অনেকের সাথে কথা বললো।"
নিয়াতুল্লাহ কাজি কয়েক বছর ধরে নানাভাবে চেষ্টা করলেন, কিন্তু চমন আরার কোন খোঁজ পেলেন না। অবশেষে তিনি যোগাযোগ করলেন ওয়ালিউল্লাহ মারুফের সাথে। ওয়ালিউল্লাহ মারুফ পাকিস্তানে খ্যাতি পেয়েছেন সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া স্বজনদের পুনর্মিলন ঘটানোর কারণেই। মারুফ বলছেন, "নিয়াতুল্লাহ কাজি সামাজিক মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করে আমাকে চমন আরার ঘটনাটি বলেছিলেন। তখন আমি আমার নিজের উদ্যোগে অনুসন্ধান শুরু করি।" "সামাজিক মাধ্যমে আমার নিজের পাতায় আমি চমন আরার ঘটনাটি লিখলাম, এবং তার সন্ধান দিতে লোকজনের সাহায্য চাইলাম।"
সামাজিক মাধ্যম থেকে নানা হাত ঘুরে এই গল্প হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপগুলোতে পৌঁছালো। এই গ্রুপগুলোর একটিতে ছিলেন চমন আরার ভাগ্নে সৈয়দ ইরফান - তিনি এই গল্প পড়ে জানালেন যে এটি তারই খালার গল্প - এবং তিনি জীবিত আছেন। ওয়ালিউল্লাহ মাসুদ এর পর দেখা করলেন সৈয়দ ইরফানের সাথে। সেখানে কথা বলে তিনি জানলেন চমন আরার পরিবারের খবর। দেখা গেল, চমন আরার পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য আর মুসলিম তার দুই মেয়েকে বাংলাদেশে থাকার সময় যে গল্প বলেছিলেন - তা সবই ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে।
উম্মি মুরসালিনা আর উম্মি তসলিমা তাদের মায়ের যে ছবি পেয়েছিলেন তা দেখানো হলো চমন আরার আত্মীয়স্বজনকে। তারা সবাই বললেন, এ তো চমন আরারই ছবি, তবে অনেক বছর আগের। তখন ঠিক করা হলো টেলিফোনে মা আর মেয়েদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়া হবে। অবশেষ ভিডিও কলে মা আর মেয়েরা পরস্পরকে দেখতে পেলেন - পাঁচ দশক পর।
উম্মি তসলিমা বলছিলেন, তার মাকে ভিডিও কলে দেখে তিনি এক গভীর প্রশান্তি অনুভব করেছিলেন। চমন আরাকে তার দুই মেয়ে জানালেন - মুসলিম মারা গেছেন ২০০৯ সালে। চমন আরা তার প্রাক্তন স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বলছিলেন, "আমার মেয়েরা যখন বলছে যে তাদের বাবা আর নেই তাহলে নিশ্চয়ই খবরটা ঠিক। কিন্তু আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে মুসলিম এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আমি জানি না কেমন এমন মনে হচ্ছিল।"
চমন আরা বলছেন, এখন প্রতিদিনই তার দুই মেয়ের সাথে কথা হয়। তাদের একজন বাংলাদেশে, আরেকজন ডেনমার্কে থাকেন। "আমার দুই মেয়েই বলে আমাকে বাংলাদেশে যেতে। আমিও আমার মেয়েদের দেখতে চাই তাদের জড়িয়ে ধরতে চাই। কিছুদিন আগে আমি ওমরাহ করার জন্য পাসপোর্ট করিয়েছিলাম। এখনো ওমরাহ করতে যাওয়া হয়নি। তবে আমি এখন আমার মেয়েদেরকে দেখতে চাই।"
চমন আরা বলছেন, তার দুই মেয়েই বলেছে যে তারা খুবই শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছে। "আমার এক মেয়ের জামাই বলছে তারা অনেক চেষ্টা করে আমাকে খুঁজে বের করেছে এবং তারা চায় আমার সাথে এখনই দেখা করতে। আমার মনে হয় আমি এখনি উড়ে চলে যাই, কিন্তু ওয়ালিউল্লাহ মারুফ বলেছে আমাকে একটা ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। আমি যখন আগেরবার গিয়েছিলাম তখন কোন ভিসার সিস্টেম ছিল না।"
তিনি বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ভিসা দেবার অনুরোধ জানাচ্ছেন। "আমার বয়স হয়েছে - কবে মারা যাবো তার কোন ঠিক নেই। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার মেয়েদের দেখতে চাই" - বলেন চমন আরা। সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।