Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অপরিহার্যতা

ইয়াসমিন নূর | প্রকাশের সময় : ২৬ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২১ এএম, ২৬ নভেম্বর, ২০২২

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে দিনকে দিন বেড়ে চলেছে মানুষের চাহিদা। সেই অনুপাতে বাড়েনি চাহিদা পূরণের ক্ষমতা। অবশ্য উল্টোটাও হতে পারে! অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ক্ষমতা ঠিকই আছে কিন্তু মানুষের চাওয়াটাই বাড়াবাড়ি রকমভাবে বেড়ে গেছে। সম্ভবত শেষ কথাটাই বেশি সত্যি। কেননা মানুষ যখন গ্যাস, বিদ্যুত, যানবাহন সুবিধা বন্চিত ছিল তখনও তার জীবন সংকুলান হত। বললে অত্যুক্তি হবে না, বর্তমানের তুলনায় বরং একটু বেশিই শান্তিময়, সচ্ছল, হৃদ্যতাপূর্ণ জীবন ছিল তখন। তবে এখন তেমনটা যে একেবারেই দেখা যায় না, এমন বলাটা ভুল। অবশ্য এমনটা কেবল তাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারা সব অবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা যখন চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে বসি তখন না-পাওয়ার তালিকাটা এতো বড় হয়ে যায় যে, পাওয়ার তালিকা করার আর জায়গাই অবশিষ্ট থাকে না।

অথচ গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে সুবিবেচনার সাথে যদি এ তালিকা তৈরি করা হতো তাহলে প্রাপ্তির তালিকা এতো বড় হতো যে, স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে যেত! বিশ্বাস না হলে বিনামূল্যে পাওয়া স্রষ্টা প্রদত্ত অমূল্য সম্পদ বাতাস গ্রহণ অর্থাৎ দম নেয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখে দেখুন! এবার নিশ্চয়ই উল্লিখিত দাবি অস্বীকার করার বা তার যথার্থতা উপলব্ধি না করার কোনো উপায় রইল না! এমনিভাবে কাজের সময় একটি হাত বেঁধে বা চোখ দু’টো বন্ধ রেখে পরীক্ষা করে দেখা যায়, আমরা কতটা প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছি। সময়ের চাহিদা পূরণে ব্যস্ত আমরা স্রষ্টার দেয়া এমনি অসংখ্য অনুগ্রহ থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি বলেই কৃতজ্ঞতা নামক বোধটি আমাদের মধ্যে উদয়ই হয় না। এ সম্পর্কেই পবিত্র কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে : তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করলে এর সংখ্যা গুণে শেষ করতে পারবেনা। (সুরা-ইব্রাহিম : আয়াত-৩৪)
অথচ বাস্তবতার সাক্ষ্যমতে কৃতজ্ঞতা বিষয়টি মানুষের জন্য খুবই লাভজনক। আর মানুষ তো স্বভাবতই লাভের দিকে বেশ আকর্ষণবোধ করে। এমতাবস্থায় সে যদি কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে লাভের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারত তাহলে তা প্রকাশে মোটেই কার্পণ্য করতো না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কারো কাছ থেকে উপকার পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে উপকারী তার প্রতি খুশি হয়। পরবর্তীতে প্রয়োজন দেখা দিলে সোৎসাহে এগিয়ে আসে। অপরদিকে কৃতজ্ঞতাবোধের অভাবে উপকারী উপকার লাভকারীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয় এবং পরবর্তীতে তার কোন কাজে আসতে উৎসাহ বোধ করে না।
মোদ্দাকথা, কৃতজ্ঞতাবোধ একে অন্যকে সহযোগিতার তথা মানব সেবার বা মানব কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। একথা সত্য যে, মানুষ মানুষের উপকার করতে পারে না। সে উপলক্ষ মাত্র। কল্যাণসাধন তো করেন স্রষ্টা স্বয়ং! তাই বলে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পথ বন্ধ হয়ে যায় না; বরং এতে মানুষে মানুষে সৌহার্দ-সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ববোধ দৃঢ় হয়। কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে মানুষের কাছ থেকে যদি এতটা ভালো ফল প্রকাশ পায় তো স্রষ্টার নিকট থেকে এর প্রতিদানে কি পাওয়া যেতে পারে! এমনি কৌতুহল ঘুচাতেই সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআন মাজীদে আমাদের জ্ঞাতার্থে বলেছেন : যদি তোমরা শোকর আদায় কর তবে আমি নিশ্চয়ই তোমাদের নিয়ামত বাড়িয়ে দেব। (সুরা-ইব্রাহীম : আয়াত ৭) অন্যত্র তিনি বলেন : অচিরেই আল্লাহ শোকর-আদায়কারীদের প্রতিদান দেবেন। (সুরা আলে-ইমরান : আয়াত-১৪৪)
স্রষ্টার পক্ষ থেকে ‘নিয়ামত বাড়িয়ে দেয়া’ বা ‘প্রতিদান’-এর পরিমাণ বিষয়ে আমাদের প্রশ্ন তোলা উচিৎ নয়। কেননা তিনি তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার থেকে কখন, কাকে কতোটা দান করবেন তা তিনিই জানেন। তবে এ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া মুশকিল নয়। আমাদের আশপাশের বা পরিচিতজনের মধ্যে এমন দু’এক জনকে পাওয়াই যায় যারা কিছু দিন আগেও মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছিল! পরবর্তীতে কোন না কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে খুব অল্প সময়ের মধ্যে চোখে পরার মত ঐশ্বর্যশালীও হয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এদের মধ্যেই কেউ কেউ এমনও আছে যে সারাজীবন সকল অবস্থাতেই আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল, ছিল কৃতজ্ঞ!
শুধুমাত্র আর্থিক টানাপোড়েনের ক্ষেত্রেই নয় বরং সবধরনের বিপদাপদ, দূর্ঘটনা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। কেননা আল্লাহর প্রতিটি ক্রিয়াকলাপেই বান্দার জন্য কোন না কোন মঙ্গল লুকায়িত থাকে। এ সম্পর্কে স্বয়ং রাসুলে কারীম (সা.) বলেছেন : মুসলমান ব্যক্তির উপর কোন দুঃখ, কষ্ট-যাতনা, দুর্ভাবনা বা উদ্বেগ, কোন দুশ্চিন্তা, যে কোন রকম কষ্ট, কোন রকম শোক আসলে এমনকি একটি কাঁটা বিধলেও তা দ্বারা আল্লাহ তা’আলা ঐ ব্যক্তির গুণাহ্ মাফ করে দেন। (বুখারি)।
আল্লাহ্ পরম দয়ালু বলেই তাঁর প্রিয় বান্দাদের পরকালীন কষ্ট লাঘবের জন্য ইহকালে অল্প বিস্তর কষ্ট প্রদান করে থাকেন। আমরা জানতে-অজানতে যে সমস্ত পাপ করে থাকি তা যদি তিনি নিজগুণে তথা পার্থিব জীবনে বিপদাপদ প্রদানের মাধ্যমে না ঘুচাতেন তাহলে পরকালীন চিরস্থায়ী জীবন তো শাস্তি ভোগের জন্যই বরাদ্দ থাকতো। আর সেই শাস্তি যে কতটা ভয়াবহ তা প্রকাশ পায় মহান আল্লাহর সেই বাণীতে যাতে তিনি বলেছেন : যারা আমার আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে অগ্নিতে দগ্ধ করবই, যখনই তাদের চামড়া দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সুরা-নিসা : আয়াত-৫৬)
সুখের কথা এ শাস্তি ঈমানদার তথা পার্থিব জীবনে উত্থান-পতনের মধ্যে বেঁচে থাকা বান্দাদের জন্য নয়, এ শাস্তি তাদের জন্যই যারা একচেটিয়াভাবে সুখভোগই করে যায়। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন : মুমিন ব্যক্তির অবস্থা শস্য গাছের অবস্থা স্বরূপ। শস্য গাছকে বাতাসের ঝাপটা একবার নত করে ফেলে দেয়, আর একবার (অপরদিকের ঝাপটা) দাঁড় করিয়ে দেয়, এভাবে বিভিন্ন দিনের বাতাস তাকে বিভিন্ন দিকে ফেলে দেয় (কিন্তু বাতাসে তার মূল উৎপাটিত হয় না। তেমনি মুমিন ব্যক্তিও বিভিন্ন রকম আপদ-বিপদের দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকে। কিন্তু আল্লাহর গযবে সমূলে ধ্বংস হয় না।) পক্ষান্তরে মুনাফেকের অবস্থা বৃহৎ বট বৃক্ষের মতো, বাতাসের ঝাপটায় কমই আক্রান্ত হয়, কিন্তু যখন আক্রান্ত হয় তখন সমূলে উৎপাটিত হয়ে যায়। (বুখারি)
অতএব, জীবনের সমস্ত বিপদাপদ বা প্রতিকূল অবস্থায়ও মানুষের পক্ষে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাঁর প্রশংসাকীর্তন করা কর্তব্য। অবশ্য রহস্যময় স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নেয়ার মানসে তাদেরকে নানা অবস্থার সম্মুখীন করেন। অর্থাৎ সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম বলবৎ রাখেন না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটান। এ কারণেই তাঁর অনেক প্রিয় বান্দাকে তিনি ইহকালীন জীবনেও সুখ-শান্তি দান করে থাকেন আবার পরকালেও তার জন্য সাফল্যময় জীবন নির্ধারণ করে রাখেন। এ বিষয়ে আল্লাহ্ বলেন: যে কোন নারী বা পুরুষ ইমানদার হয়ে নেক আমল করবে আমি তাকে (দুনিয়াতে) শান্তির জীবন এবং (আখেরাতে) তার আমলের উত্তম প্রতিফল দান করবো। (সুরা-নাহল : আয়াত-৯৭)
এক্ষেত্রেও বান্দার অপরিহার্য কর্তব্য হলো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। কেননা বান্দার জন্য আল্লাহর এ প্রতিদানের অঙ্গীকার তার আমলের উপরই নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে সে যদি দুনিয়িাবী সুখ-স্বাচ্ছন্দকে নিজের কৃতিত্ব মনে কোরে আত্ম-অহংকারের বশবর্তী হয় তাহলে সে নিজের অমঙ্গলই ডেকে আনবে। অতএব, অনুকূল-প্রতিকূল যে অবস্থাতেই থাকি না কেন, প্রতিটি মুহূর্তেই অল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের কাছে এ কর্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম বিধায় সর্বজ্ঞাতা স্রষ্টা এ বিষয়টিকে আমাদের জন্য অপরিহার্য করার মানসে ঘোষণা দেন : আর তোমরা আমার নিয়ামতের শোকর আদায় কর এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (সুরা-বাক্বারাহ্ : আয়াত-১৫২)
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এ তাগিদ বারবার এসেছে যাতে এ থেকে মানুষ বিমুখ না থাকে। আমরা যদি স্রষ্টা প্রদত্ত নিয়ামত সম্পর্কে উদাসীন না হতাম তাহলে হয়তো তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশেই আমাদের অধিকাংশ সময় ব্যয় হতো। এতোটা নাই-বা করলাম নিদেনপক্ষে ঘুম থেকে জেগে, ঘুমাতে যাওয়ার আগে এবং আনন্দ উপভোগের সময় তো আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাই উচিৎ।
কেননা আল্লাহ্ প্রদত্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অক্ষুন্ন অবস্থায় পেয়ে ঘুম থেকে জাগা এবং ঘুমাতে যেতে পারা বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। অথচ আমাদের জানা মতে এমন অনেকেই আছে যারা অঙ্গহানির কারণে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে আছে, যদিও কোন না কোন উপলক্ষের মাধ্যমে আল্লাহ্ তার সুব্যবস্থা করেই দেন। তথাপি তার দিকে তাকিয়ে আমাদের সৌভাগ্য উপলব্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েই যায়। অতএব সর্বাঙ্গীন সুস্থতা তো বটেই শুধুমাত্র নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলার ক্ষমতাটুকু থাকার জন্যই মানুষের কর্তব্য মহান আল্লাহর প্রতি অকুন্ঠচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কেননা একটা শ্বাসের উপরই তো নির্ভর করে সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা, উজ্জল ভবিষ্যৎ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ