Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

টেকসই উন্নয়নে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে : সিপিডি

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আইনের শাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, সমতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বলেছে সংস্থাটি। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে জাতিসংঘের ব্যবসা বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা ইউএনসিএডির (আঙ্কটাড) প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব সুপারিশ তুলে ধরেন সিপিডির সম্মানীয় রিসার্চ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেছেন, উন্নয়ন এখন আর প্রবৃদ্ধি নির্ভর নয়। যারা প্রবৃদ্ধির সূচকের ভিত্তিতে উন্নয়ন মাপেন তারা পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, উন্নয়ন হতে হবে সবার জন্য। যেখানে সবার অংশগ্রহণ থাকতে হবে। বঞ্চনা কমাতে হবে। আইনের শাসন ও মানুষের জন্য সমৃদ্ধি আনতে হবে। একইসঙ্গে পরিবেশের সুরক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, যারা ‘গণতন্ত্র আগে না উন্নয়ন আগে’ বলে বিতর্ক করছেন তারা উন্নয়নের আধুনিক ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। কেননা, সমতা যদি না থাকে তাহলে সেটা উন্নয়ন নয়।
সিপিডি’র এই গবেষক জানান, বিশ্বের বহু দেশ এখন এলডিসি থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে।
এর পিছনে দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো- এলডিসিভুক্ত দেশগুলো যে পরিমাণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল তা পায়নি, অথবা পেলেও ব্যবহার করতে পারেনি। এতে তারা হতাশ। অন্যদিকে, যেসব দেশ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তাদের মধ্যেও অবসাদ এসেছে। দ্বিতীয়টি হলো- এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশও একটি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। এর পরের স্তর হচ্ছে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এই স্তরে পৌঁছাতে হলে মাথাপিছু আয়কে ৪ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। অথচ বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের কথা বলছে, তার আন্তর্জাতিক কোনো মানদ- নেই। এটা বাংলাদেশেরই তৈরি।
দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশকে পুষ্টি, শিক্ষা, সাক্ষরতা বৃদ্ধি, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু হ্রাসে উন্নতি করতে হবে। প্রবৃদ্ধির দিকে নজর না দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নত হলেই উৎপাদনশীলতা বাড়বে, আর উৎপাদনশীলতা বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কতটুকু উন্নয়ন গতি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে সেটা দেখতে হবে। শ্রমঘন শিল্পায়ন, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, তৈরি পোশাক ছাড়াও কর্মসংস্থানের নতুন খাত সৃষ্টি হয়েছে কিনা সেটা দেখতে হবে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্যতা দেখতে হবে। কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।  
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। মূল প্রবন্ধে আঙ্কটাড-এর প্রতিবেদন থেকে জানানো হয়, ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ বিবেচিত হবে। ২০২৪ সালে এই তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে। আর ২০২৭ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ।
নিয়ম অনুসারে, কোনো দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা উন্নয়ন কাজে দাতা সংস্থাগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অনুদান কিংবা ঋণ দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত এবং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার এবং গ্রেস পিরিয়ড ভিন্ন ভিন্ন থাকে। স্বল্পোন্নত দেশ অনুদান বা ঋণ বেশি পেয়ে থাকে।
১৯৭১ সালে বিশ্বের দেশগুলোকে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নতÑএই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে জাতিসংঘ। বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় রয়েছে ৪৮টি দেশ। প্রতি তিন বছর অন্তর এ তালিকা পর্যালোচনা করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। যেসব দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে, কমিটি সেসব দেশের নাম উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইকোসক) কাছে পাঠায়। পরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এর চূড়ান্ত অনুমোদন ও ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে সিডিপির সর্বশেষ বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত নির্ধারণ করা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে তিন বছর ধরে সামষ্টিক মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৪২ ডলার অর্জন করা। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে এক হাজার ৪৬৫ ডলার। দ্বিতীয় শর্তে গুরুত্ব পেয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। এর মধ্যে আছে অপুষ্টি দূর করা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, শিশুদের স্কুলে ভর্তির হার বাড়ানো এবং বয়স্ক শিক্ষার হার। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ উন্নতি করে তা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের মানদ-ে ৬৬-এর মধ্যে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৬৩। পরের শর্তটি হলো অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানো। সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উন্নতি করছে। এ ক্ষেত্রে অর্জনের খুব কাছাকাছি বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মানদন্ডে ৩৬ প্রয়োজন, বাংলাদেশের রয়েছে ৩৩। সরকার আশা করছে, ২০১৭ সালের মধ্যেই অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমানোর সূচকে মানদ- পূরণ করা সম্ভব হবে। এই তিনটি শর্তের মধ্যে যেকোনো দুটি শর্ত পূরণ করে পর পর দুই মেয়াদে (ছয় বছর) তা ধরে রাখতে পারলেই একটি দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে। অন্য দুটি শর্ত পূরণ করতে না পারলেও শুধু মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ করলেও বা দুই হাজার ৪৮৪ ডলারে উন্নীত হলেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করতে পারবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা হাতছাড়া হওয়ার পাশাপাশি বিদেশি ঋণের সুদহার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত কোনো দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এসব সুযোগ-সুবিধা তিন বছরের জন্য অব্যাহত রাখা হয়, যাতে হঠাৎ করেই ওই দেশের উন্নয়ন ও বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে। এই তিন বছরে দেশটি প্রস্তুতি নিতে পারে। সে অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ২০২৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা দেশগুলোর জন্য বেশ কিছু সুপারিশও করেছে আঙ্কটাড। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি স্বল্পোন্নত দেশ প্রবাসী আয়ের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। প্রবাসী আয় গরীব বাংলাদেশীদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয় উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রপ্তানির ক্ষেত্রে জিএসপি হাতছাড়া হলে যাতে কোনো সংকট দেখা না দেয়, সে জন্য আগে থেকেই নীতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। উৎপাদন খরচ কমিয়ে এবং অবকাঠামো খাতে বাড়তি বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি অর্জন করা সহজ হতে পারে। এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। কারণ, স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে জিএসপি ভোগ করছে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য।
স্বল্পোন্নত কয়েকটি দেশে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশে কাক্সিক্ষত বৈদেশিক বিনিয়োগ আসছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মধ্যে অ্যাঙ্গোলায় বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৩৫২ শতাংশ। এ ছাড়া মিয়ানমারে ১৯৮ শতাংশ, লাইবেরিয়ায় ৮৫ শতাংশ, নেপালে ৭৪ শতাংশ এবং লাওসে ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশ, গিনি, গিনি বিসাউ, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া ও সুদানেও বেড়েছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। তবে এই সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে বুরুন্ডি, কিরিবাতি, গাম্বিয়া, ভুটান ও বুরকিনা ফাসোতে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টেকসই উন্নয়ন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ