হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী
সভ্যতার উষালগ্ন থেকে মানুষের নিরন্তর প্রয়াস উন্নয়ন অভিমুখী। উন্নয়নের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে ব্যবহার করছে, চেষ্টা করছে তার উপর উত্তরোত্তর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে। মাটি, পানি, খনিজ সম্পদ, জলবায়ু, গাছপালা, জীবজন্তু, ফলমুল ইত্যাদি সবই এই প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্তর্গত। এ কথা বাস্তব সত্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় আজ অনেক গুণ বেশি। তাই মার্কিন অর্থনীতিবিদ Arthur Lewis সত্তরের দশকে উন্নয়নকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে মানুষের পছন্দ বা বাছাই (Options) করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এক সময় মানুষ পায়ে হেঁটে অথবা গাধা-ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতো। আজ রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, উড়োজাহাজ ইত্যাদির যে কোনটাতে সে কম সময়ে যাতায়াত করতে পারে দূরে কিংবা নিকটে। মানুষের এই যে পছন্দ বা বাছাই করার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা তা কেবল প্রকৃতি ও পরিবেশকে (extensive) বিস্তৃত ও নিবিড়ভাবে (intensive) ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে। মানুষের নিরন্তর উন্নয়ন প্রচেষ্টার আরেক নাম হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের নানা রকম (diverse) ব্যবহার। অথচ আমরা জানি, প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রকৃতি ও পরিবেশ টিকে থাকে। মানুষের উন্নয়ন প্রচেষ্টা যখন এই নিয়ম ভঙ্গের কারণ হয় অথবা এই নিয়মে বাধা সৃষ্টি করে তখন পরিবেশের ভারসাম্য বিঘিœত হয়। মানুষের জীবনযাপনের অনুকূল পরিবেশ তখন প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, নিকট অতীতে পর্যন্ত মানুষ প্রায় সব উন্নয়ন কৌশল ও কর্মসূচিতে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথাই চিন্তা করতো। প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর সে কৌশল ও কর্মসূচির কী প্রভাব পড়বে সেটা নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না। আজ পরিবেশের কথা বিবেচনা করে উন্নয়নকে কীভাবে পরিবেশসম্মত বা পরিবেশবান্ধব (Enveronment-Friendly) করা যায় সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। অন্য কথায় এমন উন্নয়ন কৌশল ও কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে যা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না এবং ক্ষতিগ্রস্ত করলেও যতটুকু সম্ভব কম করবে যার ফলে এমন পরিবেশ বজায় থাকবে যা শুধু এই প্রজন্মের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্যও থাকবে নিরাপদ ও অনুকূল। পরিবেশসম্মত বা পরিবেশবান্ধব এই উন্নয়নকেই বলা হয় টেকসই উন্নয়ন বা Sustainable development| । জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) গভর্নিং কাউন্সিলের ১৯৮৯ সালের ১৫/১২ সিদ্ধান্তে টেকসই উন্নয়নের ধারনাকে নিম্নোক্তভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। কাউন্সিলের মতে, Sustainable development is development that meeds the nees of the present without compromising the ability of the future generations to meet their own needs and does not imply in any way encroachment upon national sovereignty
সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে বিগত এক দশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে এবং এখনও তা একই ব্যাপ্তি ও গতিতে অব্যাহত আছে। বক্ষ্যমান নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে এ সবের আংশিকও উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে উন্নয়ন কী ভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে, কীভাবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পরিবেশ সমস্যা কতটুকু প্রাসঙ্গিক এসব বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্তভাবে এখানে আমরা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
একথা সর্বজনবিদিত যে পৃথিবীতে জনসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা। ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিতে ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। শিল্প-কারখানারও ব্যাপক প্রসার ঘটছে। এসবের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও শিল্পবর্জ্য। যেখানে অন্য কোন উৎস থেকে শক্তি আহরণ সম্ভব নয়, সেখানে পুড়ছে কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি। ফলে বন উজাড় হচ্ছে, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক গ্যাসের মাত্রাও বাড়ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর। বৃষ্টি কমছে, ভূমিধস বাড়ছে, মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের ব্যাপকতা। তবে মনে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বহুবিধ কারণও এই সার্বিক আত্মঘাতী প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
শিল্প-কারখানা, যানবাহন ও অন্যান্য উৎস থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, বিভিন্ন প্রকার শিল্পজাত পণ্য ও রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন, শিল্পবর্জ্য, কয়লা ও তেলের মত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-অক্সাইড ও তথাকথিত ক্লোরোফ্লোরোকার্বনস (CECS) নামক গ্রিন হাউস গ্যাস সমূহের অনুপাত বাতাসে ক্রমান্ব^য়ে বাড়ছে। বাতাসে এসব গ্যাসের আধিক্যের সরাসরি শিকার হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু। ধারণা করা হচ্ছে যে, প্রচুর গ্রিন হাউস গ্যাস বাতাসে জমা হওয়ার ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বিগত অর্ধ শতাব্দীতে প্রায় ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ২০০০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি এবং বর্তমান পদ্ধতি ও হারে জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যদি জ্বালানি ব্যবহার আরও বাড়ে তবে সেই অনুপাত ৮০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বিশ্বের এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পিছনে শিল্পায়িত উন্নত বিশ্ব মূলত দায়ী হলেও এর কুফল কিন্তু উন্নত ও অনুন্নত সব দেশকেই কম-বেশি ভোগ করতে হবে। কেননা জলবায়ু একটা বৈশ্বিক সম্পদ। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে অনাবৃষ্টি, মরুকরণ, বন উজাড়করণ, ভূমিধস ইত্যাদি আরও বেড়ে যাবে। ফলে প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে কৃষির উপর নির্ভরশীল গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর যারা বাঁচার তাগিদে অনন্যোপায় হয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশকে আরো ব্যাপক ও নিবিড়ভাবে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির আরো একটা ভয়াবহ কুফল হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি যা ইতোমধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুভূত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বিশ্বের অনেক নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবে যার ফলে অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ, জীবজন্তু এমনকি মানুষের আবাসস্থলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (CECS) নামক যে গ্রিন হাউস গ্যাস আছে তার প্রভাব প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানবজাতির জন্যে আরও মারাত্মক। কেননা এটা বাতাসের অজোন স্তরকে (Ozone Layer) ক্ষতিগ্রস্ত করে। অজোন হলো বাতাসের Stratosphere স্তরে বিরাজমান এক প্রকার অক্সিজেন যা সূর্য্য থেকে নির্গত ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মিকে (UV-B) পৃথিবীতে আসতে বাধা প্রধান করে। এই রশ্মি মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারসহ নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির জন্ম দেবে, অনেক প্রজাতির প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ যেমন-বাঁধাকপি, মটরশুটি ইত্যাদি ও জলজ প্রাণিকুল যেমন- মাছ এই রশ্মি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ১৯৮৭ সালে গৃহীত Montreal Protocol on Substances that Deplete the Ozone Layer যা ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে CECS -র উৎপাদন ও ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমানোর জন্য অনুরোধ জানায়। এখানে উল্লেখ্য যে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, রেফ্রিজারেটর, এয়াররোসল প্রভৃতি সামগ্রীতে এই CECS-র ব্যবহার রয়েছে। তাছাড়া মানুষের তৈরি বিভিন্ন গ্যাস যেমন-সালফারডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড ইত্যাদি বাতাসের সংস্পর্শে আসার ফলে অম্ল (Acid) তৈরি হয় যা পরে অম্লবৃষ্টির (Acid Rain) মাধ্যমে পৃথিবীতে ফিরে আসে। এই অম্লবৃষ্টি প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি সাধন ছাড়াও মানবদেহ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
তবে স্বস্তির বিষয় এই যে, বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে উল্লেখিত সমস্যাবলী এখনও প্রকট আকার ধারণ করেনি। তার অর্থ অবশ্য এই নয়, আমরা এই সমস্যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও নিরাপদ দূরত্বে আছি। কেননা একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যাবে, বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। গত ২০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ৯০ লক্ষ লোক নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার ২০১০ সালের ২০ জানুয়ারি সংখ্যার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীসমূহের পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ায় নৌচলাচল, সেচ ও মৎস্য উৎপাদনে দারুণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। নদীর গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় বর্ষাকালে বন্যার তীব্রতাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৯ সালের BARC রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ২০০৪ সালের প্রধান প্রধান বন্যায় বাংলাদেশে যথাক্রমে ১২, ১৪, ২০, ২২, ৩০, ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশে বন উজাড়করণের হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যে কোন দেশের তুলনায় অনেক বেশি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চলে যেখানে বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ বনাঞ্চল ছিল তা বর্তমানে তো নেই বরং এ পরিমাণ ৮/১০ শতাংশে নেমে এসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন উজাড়করণ হার যেখানে (-) ০.৩ শতাংশ সেখানে আমাদের দেশে হার বার্ষিক (-) ৩.৩ শতাংশ। বাংলাদেশে নির্মাণ ও যাতায়াত খাত শিল্প-কারখানা স্থাপন, বাসস্থান নির্মাণ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ইত্যাদি প্রসারের সাথে সাথে ইটের চাহিদাও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে নতুন নতুন ইটখোলা সৃষ্টি হচ্ছে যা একদিকে চাষযোগ্য জমি ও উর্বর মাটি নষ্ট করছে, অন্যদিকে ইট পোড়াতে প্রচুর কাঠ ব্যবহারের ফলে বনজঙ্গল উজাড় হচ্ছে, ইটের ভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণে অবদান রাখছে। অথচ আমরা জানি, এই বন উজাড়করণের ফল খুবই মারাত্মক। কেননা এর ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়। ভূমিধস বাড়ে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে যায়, মাটির পানিধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায় ও উর্বরতা নষ্ট হয়। তাছাড়া, রাজধানীসহ বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে যানবাহন থেকে নিসৃত কালো ধোঁয়ায় বায়ু দূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। পলিথিন ব্যাগের ব্যবহারও ইতোমধ্যে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে যা অনতিবিলম্বে নিষিদ্ধ করার কথা অনেকে ভাবছেন। বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন। প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না।
উন্নয়নের নামে ভূমি ও পানির মতো মৌলিক প্রাকৃতিক উপাদানকেও মানবজাতি কীভাবে যে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার বর্ণনা দেয়া সত্যিই দুরূহ। বাড়তি জনসংখ্যার আবাসনের জন্য একদিকে চাষযোগ্য জমি, পাহাড় ইত্যাদি রূপান্তরিত হচ্ছে মানুষের আবাসস্থলে, অন্যদিকে সবুজ বিপ্লবের নামে ভূমি সাশ্রয়ী প্রযুক্তির যেমন- উচ্চ ফলনশীল ধান, সেচ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার-বৃদ্ধির ফলে মাটির নিচের পানির স্তর বিশেষ করে গভীর/অগভীর নলকূপ ব্যবহারের কারণে ক্রমশ নেমে যাচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধের যথেষ্ট ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত হচ্ছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী বিভিন্ন প্রজাতির পোকা-মাকড়, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ অবলুপ্ত হচ্ছে, দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির ফসলের মিশ্র চাষের পরিবর্তে বার বার একই প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল ফসল ব্যবহারের (Monoculture) কারণে জমির উর্বরতা ও কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে এতে উৎপাদন খরচও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে সবুজ বিপ্লব রূপান্তরিত হয়েছে ‘ধূসর বিপ্লবে’। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও উত্তরবঙ্গের মরুকরণ-এসবই হচ্ছে মানবসৃষ্ট তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রমের কয়েকটা মোটা দাগের কুফল।
এদিকে অতীতে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য উন্নয়ন ইত্যাদির উদ্দেশ্যে সারা বিশ্বে যে বড় বড় পানিধারা ও বাঁধ নির্র্মাণ করা হয়েছে তার প্রভাব এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেননা এসব উচ্চাকাক্সক্ষী বহুমুখী প্রকল্প গ্রহণের ফলে একদিকে কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে, লক্ষ লক্ষ একর চাষযোগ্য জমি পানির নিচে ডুবে গেছে। অন্যদিকে ভূমিধস, বন উজাড়করণ, মরুকরণ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত হ্রাস ইত্যাদির কারণে জীববৈচিত্র্যে পড়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং প্রকল্প এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনেও এসেছে ব্যাপক অশুভ পরিবর্তন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের উপর কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তা আজ সবারই জানা। এদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যেসব নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাতে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে এতে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা চিৎকার শুরু করেছেন। ভারত কিন্তু তাতে কান দিচ্ছে না। আমাদের দেশের কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প ও Flood Action Plan (FAP) এর আওতায় সারা বাংলাদেশের নির্মিত অনেক বাঁধ, সøুইচগেট, পোল্ডার এসব আত্মঘাতী প্রকল্পের কয়েকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ষাটের দশকের প্রথম দিকে USAID-এর সহায়তায় ৪৮ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ১৪৫ বছর সুফল পাওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৩৬ বছরে সেই প্রকল্প শ্বেত হস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম এই প্রকল্প মাঝে মধ্যে মাত্র ৩০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে না। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি বিদ্রোহের মূল কারণ এই পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প যার কারণে এক লক্ষ উপজাতি বাস্তুহারা হয়েছিল। FAP এর আওতায় নির্মিত ঢাকা মহানগরীর অকেজো বন্যা নিরোধক বাঁধ, বিল ডাকাতিয়ার সুদীর্ঘ জলাবদ্ধতা, মেঘনা-ধনাগোদা বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের ক্রমবর্ধমান ব্যর্থতা, যমুনার পশ্চিম তীরে রক্ষাবাঁধের উপর্যুপরি ভাঙন ইত্যাদি এসব উন্নয়ন প্রকল্পের শুধু অসাড়তাই প্রমাণ করে। উন্নয়নের নামে মানব সৃষ্ট এসব প্রকল্প প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করা ছাড়াও বহুবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এসব বিবেচনায় এনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০০০ বাঁধের সমন্বয়ে নির্মিতব্য ভারতের (Sardar Valley Project) জনগণের প্রতিরোধের মুখে স্থগিত রাখা হয়েছে। আসার কথা বাংলাদেশেও ইদানীংকালে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ু দূষণকারী ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, ডিজেল ও পেট্রোলের পরিবর্তে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার, বেবিটেক্সি, টেম্পো ইত্যাদি যানবাহনের আমদানি নিষিদ্ধকরণ, বনায়ন বৃদ্ধি ও পাহাড় কাটা রোধকরণ, বুড়িগঙ্গা দখল ও দূষণকারী স্থাপনা উচ্ছেদকরণ ইত্যাদি এই সচেতনতা বৃদ্ধির পরিচায়ক।
পরিশেষে বাংলাদেশে কীভাবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে কয়েকটি পরামর্শ উপস্থাপন করা যেতে পারে। ১. দক্ষতার সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং কয়লা ও তেলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। ২. ডিজেল ও পেট্রোলের পরিবর্তে যানবাহনে সিএনজি গ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৩. শিল্প-কারখানা স্থাপন, গৃহায়ন ও রাস্তাঘাট নির্মাণে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে করে পরিবেশ দূষিত না হয় এবং এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ৪. শিল্পবর্জ্য re-cycling-এর ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানির পরিবর্তে মাটির উপরিভাগে পানির ব্যবহার বৃদ্ধি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধের পরিমিত ব্যবহার এবং দেশীয় বিভিন্ন জাতের ফসলের মিশ্র চাষ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি উদ্যোগে এসব বিষয়ে কৃষকের সচেতনতা বাড়াতে প্রচারকার্য জোরদার করতে হবে। ৬. সামাজিক বনায়ন বাড়াতে হবে এবং এর সুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। যত বেশি সম্ভব গাছের চারা রোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তা বড় করে বনাঞ্চলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। ৭. নদনদী, খালবিল, হাওড়-বাঁওড়, জলমহাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়সমূহ বিনষ্ট করা যাবে না এবং এসবের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্য মধ্যস্বত্বভোগীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। ৮. পরিবেশ আইন সংযোজন ও সংশোধন করে পরিবেশ দূষণকারীদের শাস্তির বিধান চালু করতে হবে। ৯. করাতকল বিধিমালা ২০১২-এর সংশোধন করে করাতকল স্থাপনে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে পাশাপাশি অবৈধ করাতকল উচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে হবে। ১০. National Environmental Managerment Action plan (NEMAP)এর আওতায় মন্ত্রণালয় সমন্বয়ের পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে করে সরকারি কোন সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ না হয়। ১১. বাংলাদেশে কোন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা ঠিক হবে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।