Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামের দৃষ্টিতে শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আতিকুর রহমান নগরী : প্রতিনিয়ত আমরা কারো না কারো কাছ থেকে উপকৃত হয়ে থাকি। কেউ আমাদের উপকার করেছে, সেই উপকার সম্পর্কে যে আমরা সচেতন তা ওই ব্যক্তিকে অবহিত করার এবং তাতে আনন্দ প্রকাশ করার একটি উপায় হলো শুকরিয়া আদায় বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। উপকারের কৃতজ্ঞতা/প্রকাশের জন্য আমরা আমাদের ভাষায় ‘ধন্যবাদ’ বলে থাকি। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় নিজ নিজ ভাষায় উপকারী লোককে ধন্যবাদ বলে। ইসলামে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আমরা প্রায় সবাই আমাদের জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ও অসুবিধার সম্মুখীন হই। সুসময় ও দুঃসময় তথা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্তায়ালাকে স্মরণ করা ও আমাদের দুর্বলতা ও শক্তি সবসময় তাঁর কৃতজ্ঞ হওয়াই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু কেউ প্রশ্ন করতে পারে : একজন দরিদ্র মানুষ তার দারিদ্র্যের জন্য কেন আল্লাহ্তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে?
প্রকৃতপক্ষে, দারিদ্র্য কঠিনতম পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটি, যা দ্বারা আল্লাহ্তায়ালা একজন দরিদ্র মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। তিনি দেখেন, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে কিনা। যদি সে কৃতজ্ঞ হয় তাহলে তার পুরস্কার মহানবি মুহাম্মাদ ((সা.))’র এই বাণীতে ঘোষিত হয়েছে : “বিত্তবানের পাঁচশত বছর পূর্বে বিত্তহীন জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (তিরমিযি : ২৩৫১; রিয়াযুস সালেহীন : ৪৮৭)
কুরআন : আমরা যদি আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি তাহলে তিনি আমাদের প্রতি তাঁর কল্যাণ বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ্তায়ালা বলেন : “যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর”। [সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭]   
আল্লাহ্তায়ালার আমাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন নেই, পক্ষান্তরে তাঁর কৃতজ্ঞ হলে আমাদেরই কল্যাণ। আল্লাহ্তায়ালা বলেন- ‘আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল স্বীয় কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর সে অকৃতজ্ঞ হলে তো আল্লাহ্অভাবমুক্ত প্রশংসিত’। (সূরা লুকমান ৩১:১২)
আল্লাহ্তায়ালা মু’মিনদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তার বিনিময়ে তাদেরকে তাঁর স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে- ‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো ও অকৃতজ্ঞ হয়ো না’। (সূরা লুকমান ২:১৫২)
হাদিসের দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা : আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন- ‘যে কেউ মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহ্রও কৃতজ্ঞ হয় না’। (তিরমিযি/১৯৫৫; আবুদাউদ/৪৮১১)
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের কৃতজ্ঞ হওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝানোর জন্য এর থেকে অধিক প্রাঞ্জল ও অর্থপূর্ণ বিবৃতি আর হতে পারে না।
আয়েশার বর্ণনায় পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রিয়নবী (সা.) রাতে দীর্ঘ সময় ধরে সালাত আদায় করতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করছেন : মহানবী (সা.) রাতে এতো দীর্ঘ সময় নিয়ে সালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পাগুলো ফুলে যেত। আমি বললাম : ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি এরকম কেন করছেন, অথচ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আপনার পূর্বাপর সমস্ত পাপরাশি ক্ষমা করে দিয়েছেন?’ তিনি বললেন : ‘আমি কি আল্লাহ্র কৃতজ্ঞ বান্দা হতে পছন্দ করব না?’ (সহিহ বুখারি ৬/৩৬১)
কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন সম্পর্কে ইসলাম যা বলে : আল্লাহ্তায়ালা আমাদের প্রতি যে নেয়ামত ও কল্যাণ দান করেছেন, তার জন্য শুধু তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের তারিফ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন ওই সমস্ত লোকের কৃতজ্ঞ হতে যারা আমাদের উপকার ও কল্যাণ করবে। একজন বান্দার নিকট যেমন ‘হাম্দ’ (প্রশংসা) একটি কাম্য, অনুরূপ তার নিকট কাম্য ‘তাশাক্কুর’ (কৃতজ্ঞতা)। ইসলাম ধর্মের নির্দেশ : মানুষ আল্লাহ্তায়ালার প্রশংসা (হাম্দ) করবে এবং মানুষের কৃতজ্ঞ হবে যারা আমাদের কল্যাণ করে।
কৃতজ্ঞতা অনুগ্রহ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে : আল্লাহ্তায়ালা বলেন : ‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তাহলে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর’। (সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭) অতএব, আমাদের জীবনে বৃহত্তর আকারে আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহ ও কল্যাণপ্রাপ্তির জন্য সকাল-সন্ধ্যার যিক্রসমূহে আল্লাহ্তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব।  
উপকারের জবাব : উসামা বিন যায়েদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন- ‘যে কেউ তার প্রতি কল্যাণকারী ব্যক্তিকে ‘জাযাকুমুল্লাহ্ খায়রান’ (আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন) বলবে, সে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে’। (তিরমিযি : ২০৩৬)
তবে, কারো দ্বারা আমাদের কোনো উপকার সাধিত হলে আমরা ধন্যবাদ বলে আমাদের কৃতজ্ঞতার অনুভূতি প্রকাশ করি। সত্যি বলতে, কোনো উপকারের বিনিময় উপকার দেওয়া খুব জরুরি। তথাপি, প্রতিটি উপকারের বিনিময় একই ধরনের উপকার করা মানবজাতির জন্য প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে আমাদের মৌখিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন- ‘কোনো পুরস্কার দিতে তোমার হাত যদি সংকীর্ণ হয় তাহলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তোমার জিহ্বাকে যথেষ্ট লম্বা করো’।
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিবরণ অনুযায়ী একটি উপকারের বিনিময়ে একইভাবে কোনো উপকার করা অপরিহার্য। আসলে আমরা যে শব্দটির অনুবাদ ‘উপকার’ করছি তা হলো ‘আতা’, যার মানে প্রদান করা। আমাদের ভাষায় আমরা এটাকে ‘আতিয়া’ও বলে থাকি। যদি একটি উপকারের বিনিময়ে অন্য একটি উপকার করা সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে তার তারিফ করা উচিত। অর্থাৎ আমাদের এমন কিছু বলতে হবে যা থেকে আমাদের আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকটিত হয় এবং উপকারী ব্যক্তিটি খুশি হয়। এর জন্য ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ বলতে হবে অথবা তার জন্য দুআ করতে হবে। একটি হাদিসে উল্লেখ আছে- ‘যে প্রশংসা করল সে কৃতজ্ঞ হলো’।
কৃতজ্ঞতা আল্লাহ্ তায়ালার শাস্তি দূরীকরণে সাহায্য করে : আল্লাহ্তায়ালার অনুগ্রহ ও নেয়ামত সম্বন্ধে অজ্ঞতা আমাদের জন্য তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে অন্তরাল হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি, আল্লাহ্তায়ালা যদি আমাদেরকে আমাদের অবহেলার জন্য শাস্তি দেন তাহলে সেই অধিকার তাঁর আছে। পবিত্র কুরআনে তিনি বলছেন : ‘যদি আল্লাহ্মানুষকে তাদের কৃতকর্মের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভূপৃষ্ঠে চলমান কাউকে ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর যখন সে নির্দিষ্ট মেয়াদ এসে যাবে তখন আল্লাহর সব বান্দা তাঁর দৃষ্টিতে থাকবে’। (সূরা ফাতির-৩৫:৪৫)
একই সময় আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় বলে দিয়েছেন, আর তা হলো তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। তিনি বলছেন- ‘তোমাদের আযাব দিয়ে আল্লাহতায়ালা কী করবেন যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। আর আল্লাহ হচ্ছেন সমুচিত মূল্যদানকারী সর্বজ্ঞ’। (সূরা নিসা ৪:১৪৭) সুতরাং, আমাদের উপর আল্লাহ্তায়ালার প্রতিটি নেয়ামতের বিনিময়ে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য আমাদের হৃদয় পরিষ্কার করব।
প্রিয়নবী (সা.) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.)’র হাত ধরে বলেন, ‘হে মুআয! আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি, আল্লাহ্র শপথ, আমি তোমাকে ভালোবাসি’।
মুআয! তোমাকে আমার উপদেশ : প্রত্যেক সালাতের পরে এই দুআটি পড়তে ভুলো না, ‘আল্লাহুম্মা আ’ইন্নি আলা যিক্রিকা ওয়া শুক্রিকা ওয়া হুস্নি ইবাদাতিকা অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! তোমার স্মরণ, তোমার কৃতজ্ঞতা ও উত্তমরূপে তোমার ইবাদত প্রতিষ্ঠায় আমাকে সাহায্য করো। (মুসনাদ আহ্মাদ : ৫/২৪৫; আবুদাউদ : ১৩০১ ও নাসায়ি : ১২৮৬)
যে শুকরিয়া আদায় তথা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আল্লাহতায়ালার রহমতের কাছাকাছি করে দেয়, যে কৃতজ্ঞতা দারিদ্র্য দূর করে, যে শুকরিয়া আদায় আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক প্রীতির বন্ধন তৈরি করে। সেই কৃতজ্ঞতার প্রতি আমরা যতœবান হবো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ