গুলিস্তানের বিস্ফোরণে নিহত ১৬ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে
রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিক বাজার এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এ
৫ বছরের ছোট্ট শিশুকে নিয়ে শিশুর বাবা-মা হাসপাতালে আসেন চিকিৎসা পরামর্শ নিবেন বলে। শিশুটি দিন দিন ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং প্রায়ই ক্লান্ত অনুভব করছে। জিজ্ঞেস করা জানা গেল, ইদানিং তার পানির পিপাসা বেড়ে গেছে। সব শুনে দ্রুত ইউরিন টেস্টসহ অন্যান্য কিছু পরীক্ষা শেষে দেখা গেল, শিশুর রক্তে গ্লূকোজের মাত্রা ১৫ মিলিমোল/ লিটার। ইউরিন টেস্টে অধিক পরিমাণে সুগারের উপস্থিতি পাওয়া গেল। অর্থাৎ, শিশুটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
জন্মের পর যেকোন বয়সেই ডায়াবেটিস হতে পারে। এটি বয়স্কদের রোগ এই ভ্রান্ত ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে উক্ত ঘটনাটিই যথেষ্ট। ডায়াবেটিস শিশুদের অন্যতম কমন হরমোন জনিত সমস্যা। বিশ্বব্যাপি অন্যান্য বয়সের পাশাপাশি শিশুদের এই রোগে আক্রান্তের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন-এর তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বব্যাপি ১,৩৫,০০০ (১ লক্ষ ৩৫ হাজার) শিশু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যাটি প্রতি ১ লক্ষে ৩ থেকে ৪ জন। সমস্যা হলো; বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও এই রোগ সম্পর্কে নানান ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে এবং শিশুদের যে এই রোগ হতে পারে অনেকে তা মানতেই নারাজ। এই অসচেতনতা নিরসনে বিশ্বব্যাপি প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর সারাবিশ্বে ডায়াবেটিস দিবস পালন করা হয়, যার এবছরের প্রতিপাদ্য ‘এডূকেশন টু প্রোটেক্ট টুমোরো’, যার বাংলা অর্থ ‘আজকের সচেতনতা, আগামীর সুরক্ষা’।
শিশুদের সাধারণত ৩ ধরণের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। ৯০ শতাংশেরও বেশি শিশু ‘টাইপ ওয়ান’ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ইনসুলিন হরমোনের অভাবে এটি হয়। আক্রান্ত রোগীর দেহে বিশেষ কয়েকটি অটো-অ্যান্টিবডিস অগ্ন্যাশয়ের বিটা-সেল ধ্বংস করার ফলে প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ১ বছর বা ততোর্ধ্ব যেকারোই এই রোগ হতে পারে। শতকরা ১০ ভাগ শিশু ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। সাধারণত বয়োসন্ধিকালীন সময় থেকে এই রোগ হতে পারে। যাদের অতিরিক্ত ওজন, ঘাড়ে অ্যাকান্থোসিস নিগ্রিক্যানস বা কালচে ছোপ আছে, যেসব নারীদের পিসিওএস আছে, যাদের সরীরের সক্রিয়তা কম ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস রয়েছে এবং নিকট আত্মীয়দের টাইপ টু ডায়াবেটিস রয়েছে তারা এই রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীকে বলা হয় মনোজেনিক ডায়াবেটিস। এই বিশেষ ও বিরল ধরণটি শতকরা ১-৬ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়। জন্মের প্রথম বছর থেকে পরিলক্ষিত হলে এটিকে নিউন্যাটাল ডায়াবেটিস মেলিটাস বলা হয়।
বয়স ও ধরণভেদে ডায়াবেটিসে লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেমন; অতিরিক্ত পিপাসা বা ক্ষুধা, ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া, ওজন কমতে থাকা, অল্পতে ক্লান্ত হওয়া, ঘন ঘন বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ দেখা দেওয়া ইত্যাদি। আবার ২৫-৩০ শতাংশ রোগী ডায়াবেটিক কিটো-অ্যাসিডোসিস নিয়ে প্রথম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারে, যা ডায়াবেটিস জনিত গুরুতর একটি জটিলতা। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক যথাযথ চিকিৎসা না করা গেলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এই রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটি ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট টিমের উপস্থিতি প্রয়োজন, যেখানে থাকবে; একজন শিশু হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ, নার্স এডুকেটর, সমাজসেবক এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশ নিশ্চিতে শিশুকে পরিমাণ মতো সুষম ও ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার প্রদান করতে হবে। যেকোন বয়সের রোগীরই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মমাফিক জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
টাইপ ওয়ান-এর একমাত্র চিকিৎসা ইনসুলিন। রোগীর বয়স, আর্থিক অবস্থাসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে ইনসুলিনের ধরণ ও মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে একটা সময়ে গিয়ে রোগীর থাইরয়েড ও সেলিয়াক ডিজিজের ঝুঁকি বাড়তে পারে। তবে বাকি দুই ধরণের ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তবে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে কখনো কখনো ইনসুলিনের প্রয়োজন হতে পারে।
ডায়াবেটিসের জটিলতা দুই প্রকার হতে পারে; ইমিডিয়েট ও লং-টার্ম। ডায়াবেটিক কিটো-অ্যাসিডোসিস বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া গুরুতর দুটি জটিলতা। অন্যদিকে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে উচ্চ-রক্তচাপ, হাই-কোলেস্টেরল, লিভারে চর্বি জমে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া রয়েছে মাইক্রো ও ম্যাক্রোভাস্কুলার জটিলতা, যেমন; রেটিনোপ্যাথি, নেফ্রোপ্যাথি, নিউরোপ্যাথি এবং কার্ডিওভাস্কুলার ঝুঁকি ইত্যাদি।
সুতরাং, ডায়াবেটিসের সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে, ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, নিজে শিক্ষিত হতে হবে, অন্যকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। একইসাথে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত শরীরচর্চা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুকে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে থেকে নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ ও অন্যান্য পরীক্ষা, ঔষধের মাত্রা নির্ধারণ এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর ফলোআপে থাকতে হবে। সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই শিশুদের পূর্ণ বিকাশ ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: সিনিয়র কনসালটেন্ট, পেডিয়াট্রিক্স অ্যান্ড নিওনেটোলজি, এভারকেয়ার হসপিটাল ঢাকা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।