Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

টায়ার থেকে কংক্রিট : বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশি গবেষক মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ২:৩৬ পিএম

গাড়ি বা যানবাহন থেকে ফেলে দেওয়া ব্যবহার অযোগ্য টায়ারকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পুনঃব্যবহার করে কংক্রিট তৈরি করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তরুণ গবেষক ও প্রকৌশলী মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম। মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম স্বনামধন্য আরএমএইটি বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।তার সাথে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মোহাম্মদ আবদুল অদুদ।
তার এই উদ্ভাবন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বের ৪০০ টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সংবাদ, বৈজ্ঞানিক সাময়িকী এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে সরাসরি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম, যেমন দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান, দ্য ডেইলি মেইল, ফোর্বস, এডভোকেটস, দা এডভার্টাইজার, নিউ এটলাস , নিউক্যাসল হেরাল্ড, দ্য ক্যানবেরা টাইমস, দা টাইমস, অস্ট্রেলিয়ান এসোসিয়েটেড প্রেস, দ্য কুরিয়ার ইত্যাদি এই গবেষণা প্রকাশ করে। এখন পর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, জাপান,স্পেন, জার্মানি, সুইডেন, গ্রীস, ইতালি, ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৮.৬ কোটি শ্রোতাদের আকর্ষণ করেছেএই উদ্ভাবন, যার বিজ্ঞাপন মূল্য প্রায় ৩.১ মিলিয়ন ডলারের সমান।
মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমার পিএইচডি গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন পরিত্যক্ত এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ম্যাটেরিয়ালস গুলোকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ ব্যবহার উপযোগী কংক্রিট তৈরী করা। আমি গবেষণার শুরুতে মনোযোগ দেই পরিত্যক্ত টায়ারের দিকে এবং দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আমি একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করতে সমর্থ হই - যা পরবর্তীতে সফল ভাবে বাস্তবায়ন করি। আমি চিরাচরিত কোর্স এগ্রেগেটেকে (ইট বা পাথরের টুকরোকে) সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যক্ত টায়ারের রাবার দিয়ে প্রতিস্থাপন করে স্ট্রাকচারাল গ্রেড কংক্রিট তৈরী করা সম্ভব।পূর্বে অধিক পরিমানে রাবার দিয়ে কংক্রিট তৈরী করা সম্ভব হলেও তা বিল্ডিং স্ট্রাকচারাল কাজে লাগানো যেত না। আমার এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বিগত কয়েক দশকের এই সীমাবদ্ধতাকে নিয়ে কাজ করতে নতুন দিক উন্মোচন করবে আশা করি।"
গবেষক মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলামের পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার গুনারীতলা গ্রামে।তিনি প্রথম বারের মতো প্রচলিত কংক্রিট ব্যবহৃত ইট বা পাথরের টুকরোকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করেছেন ব্যবহার অযোগ্য টায়ারের রাবার দ্বারা, যা টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব কংক্রিট তৈরির পাশাপাশি ক্রর্মবধমান এবং চক্রাকার অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে । তার উদ্ভাবিত কংক্রিট আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বিল্ডিং কোড সমূহের নির্দেশনা পূরণ করায় বিশ্বে দারুনভাবে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে - যা কংক্রিট গবেষণায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিগত কয়েক দশক ধরে পুরাতন টায়ারের রাবার দিয়ে স্টাকচারাল কংক্রিট তৈরি করার চেষ্টা করে আসছিলেন পৃথিবীর সকল গবেষকগণ। এই প্রথম গবেষক এবং প্রকৌশলী মোহাম্মদমুমিন উল ইসলাম আবিষ্কার করে দেখিয়েছেন – চিরাচরিত ইট বা পাথর ছাড়াই সম্পূর্ণরূপে পুরাতন টায়ার দিয়ে স্ট্রাকচারাল কংক্রিট তৈরি করা সম্ভব।
এই তরুণ গবেষক জানান, সাধারণতঃ কংক্রিট তৈরি করা হয়ে থাকে সিমেন্ট, বালু, ইটের খোয়া বা পাথরের ছোট টুকরোর সংমিশ্রণে।কিন্তু বালু ও ইট বা পাথরের খোয়া ব্যবহারের কারণে দিন দিন পৃথিবী থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমান কমে যাচ্ছে।এর প্রধান কারণ হলো পানির পর কংক্রিট হলো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ম্যাটেরিয়ালস। সভ্যতার ক্রমাগত উন্নতির সাথে সাথে কংক্রিটের ব্যবহারও বেড়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। যা একসময় পৃথিবীতে বালু , ইটের বা পাথরের তীব্র সংকট তৈরী করবে। এছাড়া এভাবে প্রাকৃতকি সম্পদ ক্রমাগত ব্যবহারের কারণে পরিবেশও একসময় তার ভারসাম্য হারাবে। তাই, বিগত কয়েক দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষকগণ কংক্রিট তৈরিতে বালু, ইট বা পাথরের বিকল্প মেটেরিয়াল আবিস্কারের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলামের মতে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত ভাবে। যানবাহন বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে ব্যবহৃত নষ্ট হয়ে যাওয়া গাড়ির টায়ার। জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় বিলিয়ন টন নষ্ট অথবা ব্যবহারের অযোগ্য টায়ার পৃথিবীতে নতুন ভাবে যোগ হচ্ছে প্রতবছর, যা ফেলে দেয়া হচ্ছে।আবার ফেলে দিতে গিয়ে পরিবেশকে দারুণভাবে নষ্ট করা হচ্ছে। নষ্ট টায়ার দিয়ে জমি ভরাট করার কারণে ক্রমাগত আবাদযোগ্য এবং বসবাসযোগ্য ভূমির পরিমান কমিয়ে আনছে। সইে সাথে বনায়ন ধ্বংস হচ্ছে অপ্রত্যাশতি ভাবে। টায়ার আগুনে পুড়ানোর কারণে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক বিষাক্ত গ্যাস - যা মানব স্বাস্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতকর এবং পরিবেশের জন্য চরম বিপরর‌্যয়কর। এতো বিশাল পরিমান নষ্ট টায়ার মজুদ করে রাখাটা অনেক ব্যয়বহুল। মজুদকৃত নষ্ট টায়ার বিভিন্ন মশা এবং ইঁদুর বাহিত রোগ ছড়ানোর অভয়ারণ্য হিসাবে কাজ করে থাকে। মজুদকৃত নষ্ট টায়ারে আগুন ধরে গেলে তা নিভানো প্রায় একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এবং আগুনের প্রভাব চারপাশের পরিবেশ মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।তাই বিশ্বের সকল উন্নত দেশে পরিত্যক্ত টায়ার পুনর্ব্যবহারের উপর জোর দিয়ে আসছে , যা পরিবেশের জন্য একদকি থেকে যেমন উপকারী তেমনি টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতা বিবেচনা করে পৃথিবীর সকল গবেষকগণ পরিত্যক্ত টায়ারকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পুনর্ব্যবহারের চেষ্টা করে আসছেন গত কয়েক দশক ধরে। গবষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা ছিল পরিত্যক্ত টায়ারকে কাজে লাগিয়ে কংক্রিট তৈরি করা।
এই প্রথম পিএইচডি গবেষক এবং প্রকৌশলী মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম গবেষণা করে সফলভাবে এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আবিস্কার করেন, যা কংক্রিট থেকে ইট বা পাথরের টুকরোর পরিবর্তে পরিত্যক্ত টায়ারের রাবার দিয়ে স্ট্রাকচারাল কংক্রিট তৈরি করা সম্ভব।তার এই বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ল্যাব এ পরীক্ষার মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়েছে এবং তা সফলভাবে সকল আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড কোডের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলী পূরণ করেছে। তার এই উদ্ভাবন বিশ্বের অন্যতম নামকরা বৈজ্ঞানিক জার্নাল "রিসোর্সেস, কনসারভেশন এন্ড রিসাইক্লিং" এ প্রকাশিত হয়েছে।
তরুণ এই গবেষকের বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় মাদারগঞ্জ থানার ২০০৩- ২০০৪ বর্ষে গুনারীতলা স্কুল থেকে ৮ম শ্রেনীতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে মেধাতালিকায় ১ম স্থান অর্জনের মাধ্যমে। তিনি বিএন স্কুল এন্ড কলেজ, চট্রগ্রাম থেকে ২০০৬ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন এ+ সহ চট্রগ্রাম বোর্ডে মেধাতালিকায় ১৭ তম এবং একই কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসিতে এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ২০১৩ সালে তিনি খুলনা প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)থেকে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন।
তিনি মালয়েশিয়ান গভর্নমেন্ট ফুল স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার্স অব ইঞ্জিনিয়ারিং সাইন্স সম্পন্ন করেন ২০১৬ সালে এবং পরবর্তীতে ২০১৯ সালে, ফুল স্কলারশিপ নিয়ে মাস্টার অফ ফিলোসফি ডিগ্রী সম্পন্ন করেন বিশ্বের অন্যতম প্রসিদ্ধ ইউনিভার্সিটি দা ইউনিভার্সিটি অফ এডিলেড, অস্ট্রেলিয়া থেকে। ২০১৯ সালেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ পান তার পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য। তিনি বর্তমানে ফাইনাল বর্ষের পিএইচডি গবেষকআর এম এই টি বিশ্ববিদ্যালয়,অস্ট্রেলিয়া।
দুই ভাইয়ের মাঝে মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলাম বড় এবং তার ছোট ভাই মো. মুহাইমিন - উল - ইসলাম একজন মেরীন ইন্জিনয়ার এবং আমেরিকার সনামধন্য বিশ্ববিদ্দালয়ে পিএইচডি করছেন ফুল স্কলারশিপ নিয়ে। জনাব মোহাম্মদ মুমিন উল ইসলামের সহধর্মিণী আফসানা জেরীন নীলা কুয়েট থেকে বিএসসি ইন ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন ফুল স্কলারশিপ নিয়ে।

 

প্রবাস জীবন বিভাগে সংবাদ পাঠানোর ঠিকানা
[email protected]



 

Show all comments
  • Atique ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:৪৮ পিএম says : 0
    দেশের মুখ উজ্জ্বল করে,এগিয়ে যাও আগামীর পথে, অনেক অনেক দোয়া ও অহর্নিশ শুভ কামনা রইলো প্রিয় ভাতিজা।
    Total Reply(0) Reply
  • Atique ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৬:৪৮ পিএম says : 0
    দেশের মুখ উজ্জ্বল করে,এগিয়ে যাও আগামীর পথে, অনেক অনেক দোয়া ও অহর্নিশ শুভ কামনা রইলো প্রিয় ভাতিজা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সাফল্য


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ