পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার : ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’ এই আপ্তবাক্য জন্মের পর থেকে শুনলেও বাস্তবতা হলো ‘শিক্ষাই ভাঙছে জাতির মেরুদন্ড’। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত, আপোষকামিতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি অনৈতিকতা, অপেশাদারী মানসিকতা, অর্থের প্রতি লোলুপতাই মূলত এ জন্য দায়ী। প্রাক-প্রাথমিক স্কুলের শিশুদের কাঁধে-পিঠে যে ধরনের বইয়ের ব্যাগ চাপানো হয় তাতে শিক্ষার শুরুতেই শিক্ষার্থীদের মেরুদন্ড বেঁকে যাচ্ছে। পরবর্তীতে সেটা হয় নানা রোগ-ব্যাধির কারণ। কোচিং-টিউশনি এবং স্কুল-কলেজের লাগামহীন বেতন-ফি শিক্ষার্থীদের বাবা-মা তথা পরিবারের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙে দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা খাতে এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ঠেকানোর লক্ষ্যে অসংখ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে। কিন্তু ‘সর্ষের ভিতরেই ভূত’ থাকায় কোনো পদক্ষেপই কাজে আসছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর অবস্থা এখন ওপেনসিক্রেট। এদিকে শিশু শিক্ষার্থীদের মেরুদ- রক্ষায় এগিয়ে এসেছে উচ্চ আদালত। স্কুলে যাওয়া শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ ভাগের এক ভাগ সমান ওজনের বইয়ের ব্যাগ কাঁধে দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। এর অধিক ওজনের ব্যাগ বহনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
অনস্বীকার্য হলো জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে সুশিক্ষা অপরিহার্য। সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার পদ্ধতি, পরিবেশ ও যে কোনো অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা রোধের বিকল্প নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিয়ম রোধ যেন ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের জন্য গত ৮ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভর্তি নীতিমালা জারি করেছে। এতে ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ এমপিওভুক্ত, আংশিক এমপিওভুক্ত, এমপিও-বহির্ভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি ফরমের জন্য সর্বোচ্চ ২শ’ টাকা নিতে পারবে। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে গ্রাম পর্যায়ে ৫শ’ টাকা, পৌর (উপজেলা) এলাকায় এক হাজার টাকা, পৌর (জেলা সদর) এলাকায় দুই হাজার টাকা গ্রহণ করা যাবে। ঢাকায় সর্বোচ্চ ৫ হাজার ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরে এ ফি তিন হাজার টাকার বেশি হবে না। ঢাকা শহরের আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিও-বহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীর ভর্তির সময় মাসিক বেতন-সেশনচার্জ-উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উন্নয়ন খাতে ৩ হাজার টাকার বেশি আদায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাস্তব চিত্র একেবারেই উল্টো। আইন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামাফিক বেতন নির্ধারণ ও ফি আদায় করা হয়। শিক্ষালয়গুলোর নৈরাজ্যকরতার কবলে পড়ে অতিষ্ঠ অভিভাবকরা মাঝেমধ্যে প্রতিবাদী হলে শিক্ষাপ্রশাসনের টনক নড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা শুধুমাত্র ‘বিজ্ঞপ্তি’ জারি করছে। মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘দায়সারা’ তৎপরতার কারণেই শিক্ষা খাতে দিন দিন নৈরাজ্য বেড়েই চলছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণে ঢাকার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি’র কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এ নৈরাজ্য বন্ধে মন্ত্রণালয় দু’চারটি হাক-ডাক দিয়েই কার্যত সমাধা করেছে। গত বছরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত ফি ফেরত দেয়ার নির্দেশনার কতটুকু কার্যকর হয়েছে তা সবার জানা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধিক ফি-বেতন এবং পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে চার/পাঁচগুণ অর্থ আদায় করে তার একটি অংশ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পকেটে নিয়মিত যায়। শুধু তাই নয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালসহ অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ‘দুর্নীতি’ হচ্ছে। এ অপকর্মে সিন্ডিকেট হয় ছাত্রলীগ, বিভাগীয় শিক্ষক এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। নিয়মমাফিক পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি দৃশ্যমান হলেও রেজাল্ট দেয়ার আগেই পরীক্ষা দেয়া দুর্বল ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ‘ভর্তির নিশ্চয়তা দিয়ে’ এক লাখ থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত টাকা নেয়া হয়। এটা ঘটে পর্দার আড়ালে। ভর্তি পরীক্ষাই যাই করুক তাদের নামও টাকার বিনিময়েই প্রথম তালিকায় টানিয়ে দেয়া হয়। ‘রেজাল্ট ভালো’ যোগ্যতায় তারা ভর্তি হন। এ টাকা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কিছু নেতা, বিভাগীয় শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির অন্ধ আওয়ামী লীগার এবং গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ার পরও ছাত্রভর্তির ডিজিটাল সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দেয়ায় ‘টিকতে’ পারেননি। পরবর্তীতে সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজারগুলোতে গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি নীতিমালা না থাকায় ব্যাঙের ছাড়ার মতো গজিয়ে উঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হর্তাকর্তারা ভর্তি ফি আদায়ে ‘দানবীয় ভূমিকায়’ অবতীর্ণ হয়েছে। প্লেনার্সারি শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা ফি আদায় করা হয়। বছরের পর বছর এই নৈরাজ্য চললেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পুরোপুরি নীরব। অথচ তদারকি করলে শিক্ষা ক্ষেত্রের এই নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বাস্তবতা হলো শিক্ষা ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের নৈরাজ্য শিক্ষা অর্জনের পরিবেশকে বিঘিœত করে। আগামীর নাগরিক শিক্ষার্থীদের মনে ‘নেতিবাচক’ ধারণা সৃষ্টি দেয়। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক নষ্ট করে। যে শিশু শিক্ষা জীবনের প্রথম দিনেই দেখেন ঘুষের মাধ্যমে তাকে ভর্তি হতে হয়েছে। তার বাবা-মা কষ্ট করে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিয়েছেন; সেই শিক্ষার্থী কখনোই শিক্ষককে সম্মান জানাতে আগ্রহী হন না। মনের অজান্তেই শিক্ষকদের ওপর তার মধ্যে এক ধরনের ঘৃণার জন্ম নেয়।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশে যে ছোটখাটো অনিময়-দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা হচ্ছে তার মূলে রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য। বড় দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের প্রসঙ্গ বাদ। নাগরিকদের মধ্যে মোটামুটি যারা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। বা যাদের মাসিক আয় কম তারা বাসা ভাড়া, মাসিক খাওয়া-দাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচের পর ছেলেমেয়েদের পড়াতে গিয়ে ‘ঠেকে যান’। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে উপরি খান, অবৈধ পথে আয় করেন এবং নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য হন। সৎ, নীতিবান ও কর্মনিষ্ঠা থেকে রাষ্ট্রে বসবাস করা নাগরিকদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে দুই সন্তানের পরিবারের কর্তার যদি মাসিক আয় ৪০ হাজার হয়; তাহলে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা তার খবর হয় থাকা খাওয়ায়। থাকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। একজন শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় প্রতি মাসে স্কুল-কলেজ (ভেদে কোটিং টিউশনিসহ) খরচ হয় ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা। যাদের দুই সন্তান তাদের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য খরচ প্রতিমাসে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা করতে হয়। এই আয় কেউ করেন বৈধ পথে, আবার কাউকে করতে হয়ে অবৈধ পথে। প্রয়োজনের তাগিদে কাউকে কাউকে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হতে হয়। আবার কাউকে কাউকে নীতির কাছে ‘সমঝোতা’ করতে হয়। বছরের শুরুর আগে যে ভর্তির প্রতিযোগিতা হচ্ছে; তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে চলছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভর্তির সুযোগ পেলে কত টাকা ফি দিতে হয়; আবার ভর্তির সুযোগ না পেলে কত হাজার টাকা খবর করে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে হয় সে চিন্তায় অনেক বাবা-মায়ের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অথচ পরিকল্পনা করে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে প্রয়োজনে চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার বাজেট বৃদ্ধি করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। অন্যায়ভাবে যারা অতিরিক্ত ফি আদায় করছে আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের লাগাম টেনে ধরা যায়। অথচ সংশ্লিষ্টরা সেদিকে দৃষ্টি না দেয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রের নৈরাজ্য চলছেই। দেশের মানুষের নীতি-নৈতিকতা, সততা, কর্মনিষ্ঠা সবকিছুর মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।