Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

২ মাসে ১০ নিখোঁজ : উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছেই

| প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:১২ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। উদ্বিগ্ন রাজধানীর অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। উদ্বিগ্ন দেশের মানুষ। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর কঠোর নিরাপত্তা, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর ও গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারির পরেও বনানী থেকে একই সাথে চার যুবক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আবার নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে অভিজাত এলাকার বাসিন্দাদের। গত ১ ডিসেম্বর চারজন নিখোঁজের ঘটনার পর আরো ৬ জনের নিখোঁজের তথ্য মিলেছে। সর্বশেষ গতকাল পাবনা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর মোট নিখোঁজের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০-এ। এরা  ‘গুম’ হয়েছে নাকি স্বেচ্ছায় ‘আত্মগোপন’ করেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূরখান লিটন বলেন, আমাদের উদ্বিগ্নতার কারণ প্রতিদিনই কেউ না কেউ নিখোঁজ হচ্ছে। কারও লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কারো কারো কোনো হদিস মিলছে না। কেউবা ফিরে এসে আর কোনো কথা বলছে না। আবার কিছু যুবক নিখোঁজ হয়েছে যাদেরকে আমরা পরবর্তীতে আবিস্কার করেছি গুলশানের হলি আর্টিজানে। ৮জন (পাবনার ঘটনা ব্যতিত)  নিখোঁজ হওয়ার ধরণ একই রকম উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও সময় আসেনি এদের সম্পর্কে বলার- এরা নিখোঁজ নাকি অপহৃত হয়েছে তা আমরা কেউ জানি না। এমনকি আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও জানে না। নূরখান লিটন বলেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উচিত অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে সঠিক তথ্য বের করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর  ড. এএসএম আমানউল্লাহ বলেন, আমার ধারনা নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ অনেকেই ভয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে এ বিষয়ে রিপোর্ট করেনি, গোপন রেখেছে। তিনি বলেন, এসব ঘটনার পেছনে শক্তিশালী কোনো ‘রিক্রুটমেন্ট গ্রুপ’ কাজ করছে। যাদেরকে আমাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনী চিহ্নিত করতে পারেনি। নিখোঁজের এসব ঘটনা সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য ‘ভয়াবহ নিদর্শন’ উল্লেখ করে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, গুলশানের ঘটনার পর রাষ্ট্র বা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সুদুরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা আমরা দেখিনি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও এখন আর এ সম্পর্কে আলোচনা করেন না। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে একটা আত্মসন্তুষ্টি ভাব বা গরিমা চলে এসেছে। তাদের ভাবখানা এমন যেনো সবকিছু কন্ট্রোল করে ফেলেছে।
জানা গেছে, গত দুই মাসে রাজধানী থেকে নিখোঁজ হয়েছে আট ব্যক্তি। এদের সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারছে না আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এর মধ্যে ১ ডিসেম্বর এক সাথে নিখোঁজ হয়েছে চার তরুণ। ২৯ নভেম্বর নিখোঁজ হয় একজন ও সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর নিখোঁজ হয় আরো একজন। এর আগে গত ২৪ ও ১৪ অক্টোবর দুইজন নিখোঁজ হয়। আমাদের পাবনা জেলা সংবাদদাতা জানান, পাবনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ দুই ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় পৃথক দু’টি জিডি করা হয়েছে। এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্র নিখোঁজের ঘটনায় কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতংত-উৎকন্ঠা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এরা আদৌ  নিখোঁজ নাকি অপহরণের শিকার অথবা  কোন জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ। নিখোঁজ ছাত্ররা হলো, রংপুরের কাউনিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোহাম্মদ সুরুজ্জামানের পুত্র জাকির হোসেন। সে পাবনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। অপরজন একই জেলার  রংপুর নগরীর শালবন মিস্ত্রিপাড়ার নুরুল  আলম সরকারের পুত্র তানভীর আহমেদ তনয়। এরা দু’জনই এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। এদের মধ্যে ১ ডিসেম্বর সকালে বাড়ি থেকে ট্রেনে করে পাবনা মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ফেরার পথে জাকির হোসেন এবং ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় তানভীর আহমেদ তনয় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে নিখোঁজ হন।
পুলিশ সূত্র জানায়, সর্বশেষ ঢাকা থেকে সর্বশেষ যে দু’জন নিখোঁজ হয়েছে তারা হলো, ইমরান ফরহাদ (২০) ও সাঈদ আনোয়ার খান (১৮)। এই দু’জনের মধ্যে ইমরান ফরহাদ কেয়ার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। সাঈদ বাড়িতে পড়াশোনা করে এ বছর ওলেভেল পাশ করেছে। নিখোঁজ দু’জনের পরিবারের পক্ষ থেকে বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৃথক দু’টি জিডি করা হয়েছে। এর আগে গত ১ ডিসেম্বর বনানী এলাকা থেকে এক সঙ্গে চার তরুণ নিখোঁজ হয়। তারা হলো, সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসাইন খান পাভেল, মোহাম্মদ সুজন ও মেহেদী হাওলাদার। এদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের কোন সন্ধান পায়নি পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজের বিষয়গুলো আমাদের নজরে এসেছে। এরা কিভাবে নিখোঁজ হয়েছে এবং কোথায় আছে তা জানার চেষ্টা চলছে।
গত ১ ডিসেম্বরের বনানী মসজিদে নামাজের জন্য বের হন সাফায়াত। এরপর আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। তার সঙ্গে ওইদিন ঢাকার অভিজাত বনানী এলাকা থেকে আরো তিনজন নিখোঁজ হয়। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে সাফায়াতের বাবা মোঃ আলী হোসেন বলেন, নিখোঁজ হওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে ফোনে বলেছিল মা স্যুপ খাচ্ছি, এক্ষুণি চলে আসবো। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি জানান, পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে সাফায়াত নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শেষ করতে পারেনি। সারাদিন বাড়িতেই থাকতো সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, বোনদের পড়া দেখিয়ে দিত। নিখোঁজের দিন বাড়িতেই মাগরিবের নামাজ আদায় করে সাফায়েত। এরপর বোনকে কোচিং সেন্টার থেকে বাড়িতে দিয়ে সোয়া ৭টার দিকে এশার নামাজ আদায় করতে বনানী মসজিদে যায়। সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাইন হোসেন খান (পাভেল)। মসজিদ থেকে বের হয়েই নর্দান ক্যাফেতে যায় সাফায়াত। সেখানেও ছিলেন পাভেল। সাফায়েতের বাবা জানান, সেদিন রাত পৌনে ৯টা থেকেই তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।
একইসঙ্গে ফোন বন্ধ পাওয়া যায় তার বন্ধু পাভেলের। চিন্তিত পাভেলের মা ফোন দেন সাফায়াতের মাকে। একসঙ্গে দুই বন্ধুর ফোন বন্ধ থাকায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরে দুই পরিবার। রাতেই বনানী থানাসহ আশপাশের এলাকায় খোঁজ নেন সাফায়াতের বাবা ও পাভেলের পরিবার। রাতে তাদের না পেয়ে ফজর নামাজের পর মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে যান তারা। সেখানকার এক কর্মকর্তা সাফায়াতের বাবাকে থানায় জিডি করার পরামর্শ দেন। জিডি করতে বনানী থানায় গিয়ে দেখেন সাফায়াত, পাভেলের মতো আরো দুই শিক্ষার্থী এভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। পরদিন ৪র্থ জনের পরিবারও নিখোঁজের জিডি করেছেন। জিডি করার পর পুলিশের তদন্তে ক্যাফের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা চারজনই নর্দান ক্যাফেতে এক টেবিলে বসে একসঙ্গে খেয়েছেন এবং আড্ডা দিয়েছেন। এদের মধ্যে একজন কিছুক্ষণ পরপর উঠে টয়লেটের সামনে গিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন এবং এসএমএস দিচ্ছিলেন। পুলিশ সূত্র জানায়, তাদের মোবাইল ট্র্যাক করে দেখা যায়, বনানী মার্কেটের পাশেই একসঙ্গে চারজনের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। সাফায়েত ও পাভেল ছাড়া বাকি দুজন হচ্ছেন মেহেদি হাওলাদার ও মো. সুজন। পাভেল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মেহেদি বরিশালের বিএম কলেজের ছাত্র। আর সুজন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে কোর্স করে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল।
এই চারজনের সাথে আরও চারজন নিখোঁজের খবর মিলেছে। সর্বশেষ পাবনা থেকে দুজন মেডিকেলের চাত্র নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে গতকাল। এসব ঘটনায় সারাদেশের মানুষ তথা অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। অনেকেরই প্রশ্ন গুলশানের হলি আর্টিজানে এতোবড় একটা ঘটনার পর সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করাসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছিল। তারপরেও সেখান থেকেই কিভাবে এক সাথে চারজন উধাও হলো। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. এএসএম আমানউল্লাহ বলেন, গুলশানের ঘটনার পর রেডিও, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা দেখা গেছে। টিভিতে জঙ্গিবাদের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিজ্ঞাপনও লক্ষ্য করেছি আমরা। কিন্তু সেগুলো ছিল একেবারেই কম সময়ের জন্য। এখন এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা বিজ্ঞাপন আর চোখে পড়ে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ চলে। এরপর ‘পিচমিল’ এর ভিত্তিতে একটু একটু করে সবাই চুপ হয়ে যায়। আমরা ভাবি সব বুঝি এখানেই শেষ। আসলে কিন্তু তা নয়। এই সমাজবিজ্ঞানীর মতে, গুলশানের ঘটনার পর আমাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া উচিত ছিল। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারলে এরকম ঘটনা যে আর ঘটবে না তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে। তিনি বলেন, আমি মনে করি আবার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা শুরু করা দরকার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কারিকুলাম পরিবর্তন করে সেখানেও এ বিষয়ে শিক্ষণীয় বিষয় থাকা দরকার। সর্বোপরি আমাদের র‌্যাব-পুলিশ-ডিবির মধ্যে সমন্বহীনতা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। জরুরীভিত্তিতে এই সমন্বয়হীনতা দূর করা দরকার। তা না হলে আমাদের উদ্বেগ কিছুতেই কমবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ