Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এক রোহিঙ্গা তরুণীর আত্মকাহিনী

রোহিঙ্গা তরুণী খিন মি

প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১:৩২ এএম, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬

স্টাফ রিপোর্টার : ২৬ বছরের তরুণী খিন মি তিওয়ান। ইংরেজিতে স্নাতক। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও মগদের পৈশাচিক অত্যাচারে চোখের সামনে মরতে দেখেছেন গ্রামের অসংখ্য নারী-পুরুষকে। গুলি-ছুরিকাঘাতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-নারী-পুরুষ। মগদের অত্যাচারে নিজের পিতার মাথা থেকে রক্তের সঙ্গে মগজ বের হতে দেখেছেন। রক্ত আর রক্ত দেখেছেন পথেঘাটে। গ্রামময় দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখা। তার চোখের সামনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে নিজের গ্রামসহ অসংখ্য গ্রাম। নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করেও তরুণী-নারীদের ধর্ষিত হতে দেখেছেন চোখের সামনে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। নীরবে কেঁদেছেন। জীবন বাঁচাতে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে নৌকায় ভেসেছেন মাসের পর মাস। দুর্বিষহ জীবনের সেই কাহিনী তুলে ধরেছেন খিন মি তিওয়ান।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় খিন মি তিওয়ানের বয়স ছিল ২২। ওই সময়ে তিনি সবেমাত্র ‘সিতোই’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের জন্য ইয়াংগুন যাবার পরিকল্পনা করছেন। কর্মজীবনে একজন কূটনীতিক হওয়ার তার অনেক দিনের স্বপ্ন তখন তাকে তাড়া করে।
হঠাৎ এক রাতে শহর ‘সিতোইয়ে’ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে তার স্বপ্নের পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ ছারখার হয়ে যায়। চোখের সামনে তিনি তার প্রতিবেশীদের ইস্পাতের লাঠি দিয়ে পেটানো এবং ছুরি দিয়ে আঘাতের দৃশ্য দেখেন। তিনি দেখেছেন বর্বর মগদের নির্মম অত্যাচারে তার বাবা প্রায় মারা যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাবার মস্তিষ্ককে দেখতে পাই। রক্তের সঙ্গে মস্তিস্কের অংশ বের হয়ে এসেছে। আমি আমার চোখের সামনে বন্ধুদের ছুরির আঘাতে মারা যেতে দেখেছি। সেখানে ছিল সর্বত্র রক্ত আর রক্ত। ওই সময়ই আমি শেষবারের মতো আমার রক্তাক্ত মৃত্যুপথযাত্রী প্রতিবেশীদের দেখেছিলাম।’
মিয়ামারের প্রায় ১০ লাখ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের একজন এই খিন মি তিওয়ান। ২০১৫ সালে যখন হাজার হাজার রোহিঙ্গা বৌদ্ধ চরমপন্থীদের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছোট নৌকায় সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ছিলেন; তখন তিনি আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম হন। ওই সময় শরণার্থী হিসেবে কোনো দেশ তাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় ছিলেন। ২০১২ সালের বৌদ্ধদের নির্মম নির্যাতনে খিন মি’সহ প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনের নিজ গ্রাম থেকে পালিয়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হন। ওই ঘটনার ৪ বছর পরও মিয়ানমার সীমান্তে সহিংসতা, মুসলিম রোহিঙ্গা হত্যার কোনো অবসান ঘটেনি। এখনো চলছে।
যুগের পর যুগ ধরে রাখাইনের রোহিঙ্গারা অধিকাংশই একটি সীমাবদ্ধ অঞ্চলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। অঞ্চলটিতে আবার রয়েছে কড়া পুলিশি প্রহরা। সেখান থেকে বাইরে যেতে কিংবা বাড়িতে ফিরে আসার সময় নিরাপত্তাবাহিনীর নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। ক্যাম্পের ভেতরে তারা কাজ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। তাদের অধিকাংশই বেঁচে থাকার জন্য দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেখানে তরুণী ও নারীরা প্রায়ই যৌন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হনÑ জানান খিন মি।
নিয়ন্ত্রিত ওই অঞ্চলে বসবাস সম্পর্কে খিন মি আলোচনায় বলেন, ‘প্রথম প্রথম এটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগত। আমি এখানে ট্রাউজার্স পরতে পারতাম না। নারীরা চা স্টলে যেত না এবং সেখানে কোথাও পড়াশোনার বই ধার কিংবা কিনতে পাওয়া যেত না।’ তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে শেয়ার পাম্প থেকে পানি সংগ্রহ করা হতো। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসত এবং ল্যাট্রিন ছিল বাইরের দিকে। রাতে ল্যাট্রিন ব্যবহার করার সময় অনেক নারী ও কিশোরী যৌন হয়রানির সম্মুখীন হতো। সেখানকার অধিকাংশ কুঁড়েঘরেই কোনো তালার ব্যবস্থা ছিল না এবং এমনকি অন্ধকারেও সেখানে সুরক্ষার কোনো গ্যারান্টি ছিল না।’
এমন অবস্থায় কুঁড়েঘরে কোনো রকম গোপনীয়তা ছাড়াই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আমরা বাস করতে বাধ্য হয়েছি। এসব নিপীড়ন রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম হতাশার জন্ম দিচ্ছে যা দেশটিতে অভ্যন্তরীণ সহিংসতার অন্যতম কারণ।
স্থানচ্যুতির জবাবে ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি এবং মেটা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউএনএফপিএ মিয়ানমারের ১৫ জন তরুণী ও নারীকে নিয়ে ‘উইমেন অ্যান্ড গার্লস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, ঘরহারা নারী ও মেয়ে শিশুদের সামাজিক সহায়তা প্রদান, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য, পরিবার পরিকল্পনা, মনোসামাজিক কাউন্সিলিং, অন্যান্য সহিংসতা সংক্রান্ত সেবা এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালে নেয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা। কেবল ২০১৫ সালেই ১৬ হাজার নারী ও মেয়েশিশু ওই সেন্টার থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছে। এই সেন্টারের সকল কর্মী সেখানকার বাস্তুচ্যুত নারী ও মেয়েশিশু। সেখানে কাজের মাধ্যমে তারা আর্থিক নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্জিত বাস্তব জ্ঞান ক্যাম্প জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে।
রাখাইনে ইউএনএফপিএর ৭টি কেন্দ্রের কর্মীদের একজন খিন মি। সেখানে তিনি ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন।  
রাখাইনে সাম্প্রতিক সহিংসতা শুরুর আগে গত মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, আমার কাজ সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আসা অধিকাংশ নারীই অশিক্ষিত কিংবা সামান্য শিক্ষা আছে। আমরা তাদের শুধু লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে শেখাচ্ছি না, তাদের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সম্পর্কেও ধারণা দিচ্ছি।’ পরিতৃপ্তিদায়ক কাজ সত্ত্বেও তিনি কিশোরীদের মধ্যে ক্রমাগত হতাশা ও নৈরাশ্য দেখতে পান বলে তখন জানিয়েছিলেন।
সাম্প্রতিক আবারো রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর রক্তাক্ত নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তাদের অমানবিক নির্যাতনে বাধ্য হয়ে এসব অসহায় রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করছে। নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে শত শত রোহিঙ্গা গণধর্ষণ, ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনের মুখে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। উপগ্রহ চিত্র বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে কয়েক হাজার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। গণধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ তদন্ত করতে বিদেশী সাংবাদিক, স্বাধীন তদন্ত সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের এসব অঞ্চলে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। কয়েক প্রজন্ম ধরে এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইনে বসবাস করে আসছে। তারপরও তাদের নাগরিকত্বকে স্বীকার করা হয়নি। তারা বিবাহ, ধর্মপালন, সন্তান জন্মদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগণ হিসেবে বসবাস করছে।  আর খিন মি বাস্তুচ্যুত হয়েও বিতাড়িত রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। (ইউএনএফপি অবলম্বনে)



 

Show all comments
  • Akash ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:০১ এএম says : 0
    Sobai ondho hoye gase. agulo dekhar kew nei
    Total Reply(0) Reply
  • Aman ullah Aman ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ২:১৮ পিএম says : 2
    আর্ন্তজাতীক সম্প্রদাকে এগিয়ে আসতে হবে রোহিঙ্গাদের রক্ষায়
    Total Reply(0) Reply
  • mostafizur Rahman ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৬:৩৬ পিএম says : 0
    Myanmar(Rohingya peo]ple) It is a Barbarian story.How did the government of Burma allow their militaries kill ,raping the young girls ,burn down houses, destroy the community and Royhinga;s people.They have not belonged to Myanmar.They are the creature of God. Please Stop the killing and do n;t destroy your own people. Mostafizur Rahman Ex.Freedom fighter of Bangladesh Canada
    Total Reply(2) Reply
    • moniruzaman ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৮:২৮ পিএম says : 4
      amar sudoi kanna ar kanna
    • ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০৪ পিএম says : 4
      ...Bangladesh jege uthuk ea kamonai..
  • firoz ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:১৪ পিএম says : 2
    what we should at this time for them give us answer.........we r werld less observing those
    Total Reply(0) Reply
  • HOSSAIN ALI ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ৫:২৬ পিএম says : 2
    BELIEVE ME,I TALL ALLAH GIVE ME (AUSSRIK SHOKTI) EXTRA POWER.I FOR GATE EVERYTHING,I TEACH PEOPLE,WHAT IS PIC-FULL.THAT IS NOT'S GOOD AWAY.I WANT TO SHOW THEM THIS REAL POWER,NOTE'S YOUR POWER.....?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ