বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মোহাম্মদ গোলাম হোসেন : চলমান রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানের মোকাবিলায় বাংলাদেশের ভূমিকা ও তৎপরতা কী যথেষ্ট? বিশেষ করে বড় দুটি দলের একটি এখন ক্ষমতায় অন্যটি ক্ষমতা প্রত্যাশী। নির্মূল অভিযানের অংশ হিসেবে খুন-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ পর ১৬ অক্টোবর ২০১৬ সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম মুখ খোলা হলো। বিবৃতিতে সীমান্তের ওপারে কী হচ্ছে এবং তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বা কী সে সম্পর্কে সরকারের উদাসীনতাই শুধু নয়, আসন্ন বিপর্যয় থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার মতো অদূরদর্শিতার পরিচয়ই পাওয়া গেল। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকবে বলে বিবৃতিটির অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি। ‘অপরাধীরা যাতে সহজে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ ১০ অক্টোবর ভোর থেকেই মিয়ানমার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশ রাখাইনের দুজন মুসলিমকে গ্রেফতার করে পরদিনই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে যোগাযোগ রাখছে এবং অনুরোধ অনুযায়ী সহায়তা করছে। বাংলাদেশ যে কোনো ধরনের সহিংস চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে। প্রতিবেশী দেশটিকে সহায়তা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। মিয়ানমারের এই প্রয়োজনের সময়ে বাংলাদেশ সহায়তা দেয়া অব্যাহত রাখবে।’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় যখন বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করার কথা, সে ক্ষেত্রে দমন, নিপীড়ন ও নির্মূল অভিযানে সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হচ্ছে। বিবৃতিতে পুলিশ ক্যাম্পে হামলার জন্য দৃশ্যত রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করার পেছনে সরকারের হাতে কোনো প্রমাণ আছে কী? মিয়ানমারে অসংখ্য গোষ্ঠীগত সশস্ত্র গ্রুপের তৎপরতা যখন বিবৃতিতেই স্বীকৃত তখন দায়টা এককভাবে রোহিঙ্গাদের কেন? রোহিঙ্গা নির্মূলের কূটকৌশল হিসেবে খোদ মিয়ানমার সরকারই যে ঘটনাটি ঘটায়নি তা কেমন করে বলা যাবে?
এই বিবৃতি দেয়ার পর নির্মূল অভিযান আরো জোরদার হলো স্বাভাবিকভাবেই। ওপারে অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণের মহোৎসব আর এপারে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর দায়িত্ব পালনে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হলো কড়াকড়িভাবে। এই পরিস্থিতিতে ১ মাস ৯ দিন পর গত ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্দেশে দেয়া এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা চায়। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়, এই বিবৃতিতেও রাখাইনে পরিচালিত ধ্বংসযজ্ঞ, নির্যাতন ও হত্যার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ তো দূরের কথা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও প্রকাশ পেল না। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনকারী একটি জাতি হিসেবে দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে নির্যাতিত মানবতার পাশে দাঁড়ানো আমাদের শুধু নৈতিক নয়, সাংবিধানিক দায়িত্বও। প্রায় একই সময় একদিকে মিয়ানমারে অন্যদিকে কাশ্মীরে যখন চলছে দমন-নিপীড়ন তখন বাংলাদেশ সরকারের একজন সম্মানিত মন্ত্রী বিদেশ সফরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তায় বাংলাদেশ একটি রূপরেখা তৈরির বিষয়ে ভাবছে এমন একটি ধারণাই তুলে ধরলেন সাংবাদিকদের সামনে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান একটি মানবিক দায়িত্ব বিবেচনায় মন্ত্রী যদি বালুচদের সহায়তাদানের কথা ভেবে থাকেন ভালো কথা, কিন্তু একই সময় কাশ্মীরে চলমান হত্যাযজ্ঞ (যা মূলত চলছে ৭০ বছর ধরেই), রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানের বিষয় তার নজরে না পড়ার কারণ কী? বাড়ির পাশে ‘সেভেন সিস্টার’ কথিত রাজ্যগুলোর স্বাধিকার সংগ্রাম এড়িয়ে দেড় হাজার মাইল দূরের বেলুচ আন্দোলনে সহযোগিতার বিষয় তার আগ্রহের কারণ যদি এটাই হয় যে, তিনি একটি দুর্বল ও ভঙ্গুর পাকিস্তান দেখতে আগ্রহী তা হলে তার বোঝা উচিত আঞ্চলিক রাজনীতি ও আগ্রাসনের ঝুঁকি মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী পাকিস্তানই শুধু নয়, বরং শক্তিধর নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকি ভুটানও আমাদের স্বার্থেই জরুরি। এমন সহজ সমীকরণ মন্ত্রী পর্যায়ের দায়িত্বশীলগণও যদি না বোঝেন তবে ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হলো ‘কারো অন্ধত্বের জন্য কোনো প্রলয় বন্ধ থাকেনি কোনো দিন’ যেমন বন্ধ থাকেনি মুঘল বা রোমানদের জন্যও।
প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গা সমস্যা কী আমাদের জাতীয় সমস্যা, না গোষ্ঠী বা দলবিশেষের? জাতীয় সমস্যা হয়ে থাকলে রাস্তায় প্রতিবাদের দায়িত্ব কেবল মোল্লাদের কেন? দেশের বৃহৎ দুটি দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ বিষয়ে নীরব আর নারায়ণগঞ্জের মতো একটি নগণ্য ইস্যুতে দেশ গরম করার মতো সরব কেন? দেড় মাস পর বামপন্থিদের কয়েকজনের একটা মিছিল দেখলাম। সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠনগুলো কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে কেন? ‘রোহিঙ্গারা মুসলমান’ এটাই কী তাহলে আসল কথা? বুঝতে কষ্ট হয় ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’-এর নেতারা যারা কথায় কথায় আমরা সংবিধানে এটা সেটা লেখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চেতনা ও প্রত্যাশার প্রতি চ্যালেঞ্জও ছুড়ে বসেন, হেন আগ্রাসনের মুখেও তারা নীরব কেন? কোটা সুবিধার সুবাদে যারা সকল ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর চেয়ে এগিয়ে সেই উপজাতিগুলোও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কোনো মানবিক ভূমিকা রাখল কী? একই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে মিয়ানমারের কাছে তারা তো অন্তত এ কথাটা রাখতে পারতেন যে, যে ধর্ম-বর্ণ ও ভাষাগত পার্থক্যের কারণে তোমরা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চাচ্ছ কেন? এখন যদি সেই একই কারণে বাংলাদেশ উপজাতিদের নাফ নদের ওপারে চলে যেতে বাধ্য করে তাহলে মিয়ানমার সরকার তা মেনে নেবে কী?
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণে ভাষা, ধর্ম ও বর্ণগত পার্থক্যকে যুক্তি, বাস্তবতা ও মানবতার ওপর স্থান দিতে চাচ্ছে। অথচ হাজার বছর থেকে তারা পুরুষানুক্রমে আরাকানে বসবাস করেই আসছে না শুধু, দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা (রোসাঙ্গ) মুসলিম ও হিন্দুদের শাসনাধীনেও ছিল। সঙ্গত কারণেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি কোনো দিন। ১৯৬২ সালে নেউইন-এর সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরাকান মুসলিমশূন্য করার কার্যক্রম শুরু হলেও তা জোরালো হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। এ সময় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও জাতিসংযেঘর মধ্যস্থতায় কিছু রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে যায়। অতঃপর ১৯৯২ সালে আবার কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং কিছু সংখ্যক বিদেশে পাড়ি জমায়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সুচির বিজয়ের পর এই সমস্যার একটি মানবিক সমাধান আশা করা হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়েই দেখা দিল। বস্তুত সুচির আমলেই রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ও দূরদৃষ্টির অভাবেই হোক অথবা ধর্মনিরপেক্ষতায় আঁচড় লাগা বা ‘ইসলামিস্ট’ বলে মোড়লদের কাছে পরিচিতি পাওয়ার আশঙ্কায়ই হোক বাংলাদেশ সরকার এই নির্মূল কর্মসূচির ব্যাপারে কেবল চোখ ফিরিয়ে রাখার নীতিই যে গ্রহণ করেছে তা-ই শুধু নয় বরং বহু বিঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আওতায় ফেলে এই নির্মূল অভিযানের সাফল্য কামনা বরং আদর্শ প্রতিবেশী হিসেবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতেই দেখা গেল। তখন বাস্তবতা যখন নিজের ঘাড়েই চেপে বসতে যাচ্ছে তখন সরকারের ভ্রম কাটার লক্ষণ দেখা গেলেও বোঝাটা সহজে নামানো যাবে বলে মনে হয় না।
মিয়ানমার সরকারের এহেন মানবতাবিরোধী কর্মকা-ের পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও উসকানি থাকার সন্দেহ অমূলক না হলেও অন্য কারণও আছে। বাংলাদেশের অতীত বর্তমান কোনো সরকারকেই নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিত্যাগ পূর্বক মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কখনো। মিয়ানমার সরকার বোধকরি এই বিষয়টিকে মূল্যায়নে নিয়েছে পুরোপুরি। সম্প্রতি বিবাড়িয়া জেলার নবীনগরে সন্ত্রাসীদের হামলায় হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু ঘরবাড়ি ও মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। এটি যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার ও দায়িত্ববহির্ভূত কাজ না হয় তাহলে অনুরূপ এখতিয়ার ও দায়িত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও যে প্রযোজ্য তা অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে কাশ্মীরের ঘটনাবলীর কথা না হয় বাদই থাকল, গরুর গোস্ত খাওয়ার অভিযোগে পুড়িয়ে মারা, জোর করে ধর্মান্তরিত করার মতো ঘটনা এমনকি বন্দি অবস্থায় মুসলমান তরুণদের পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করার মতো অমানবিকতায় সীমান্তে বিএসএফের অহরহ হত্যার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকার কথা। সীমান্তে এ পর্যন্ত কোন ফেনসিডিল বাহক খুন হওয়ার নজির না থাকলেও কারণে-অকারণে ৪৫ বছরে খুন হয়েছে হাজার দশেক বাংলাদেশি। প্রতিবাদ হয়েছে কী প্রতিবাদের মতো? বরং কাঁটাতারে ঝুলন্ত ফেলানীকে গুলি করে খুন করার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাষ্যÑ ‘ফেলানী বাংলাদেশের নাগরিক নয়।’ অথচ নিদেনপক্ষে আপসরফার মাধ্যমেও আমরা যদি বলতে পারতাম, গরুর গোস্ত খাওয়ার জন্য আর যদি একটি খুনের ঘটনা ঘটে, যদি কোনো মুসলমানকে জোর করে ধর্মান্তর করা হয়, সীমান্তে আর কোনো ফেলানীর মৃত্যু ঘটে, আর এক বোতল ফেনসিডিলও সীমান্ত অতিক্রম করে তবে বাংলাদেশ...।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ক্ষমতায় আসার পরপরই প্রধানমন্ত্রী মোদি এক ঘোষণায় বলেছিলেন, ‘ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বিদেশিদের অবশ্যই ভারত ছাড়তে হবে। তবে হিন্দু হওয়ার কারণে নির্যাতিত হয়ে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে যদি কোনো হিন্দু ভারতে আশ্রয় নিতে চায় বিশাল ভারত তাকে অবশ্যই বুকে টেনে নেবে।’ একথা ঘোষণার পর ভারতের সংবিধান অপবিত্র হলো কিনা বা ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিতে ফাটল ধরার ঘটনা ঘটেছে কিনা জানা না গেলেও বহির্বিশ্বে হিন্দুদের নিরাপত্তা জোরদার হওয়ার সাথে সাথে ভারতের একটা ভাবমর্যাদা যে সৃষ্টি হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আমাদের পুলিশ-বিজিবি যখন বন্দুকের টার্গেট এড়িয়ে নাফ নদ দিয়ে এপারে ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের নৌকাগুলোকে নাফ নদের ওপারে বন্দুকের নলের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য করছিল ঠিক সেই সময় ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট এর ঘোষণা ছিলÑ ‘পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের নির্যাতিত আশ্রয় প্রার্থী মানুষের জন্য ফিলিপাইনের দরজা খোলা।’ এখানে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীকেও হার মানালেন। তিনি শুধু খ্রিস্টানদের আশ্রয় দেয়ার কথা না ভেবে বিশ্বমানবতার কথাই ভেবেছেন। অথচ ফিলিপাইন আমাদের মতোই তৃতীয় বিশ্বের একটি গরিব দেশ। সুতরাং আমরা মনে করি, মিয়ানমারের এই যে বাড়াবাড়ি আর সীমাহীন জুলুম-অত্যাচার এর জন্য আমাদের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্র নীতিও দায়ী।
এ পর্যায়ে আমাদের পরামর্শ হলো, মিয়ানমারের অমানবিক আচরণ ও রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের মানবিক দায়িত্ব আসলেই বাংলাদেশের জন্য এক কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে ঠিকই কিন্তু দৃশ্যমান ঘটনাবলী ছাড়াও পর্দার আড়ালে আরো কিছু অপ্রকাশিত বিষয় থাকতে পারে যা আজকের সমস্যার চেয়েও অধিকতর ভয়ঙ্কর ও বিপদশঙ্কুল হতে পারে। ভৌগোলিকভাবে রোহিঙ্গাদের অবস্থান অনেকটা বাফার স্টেটের মতো, যার উত্তর-পশ্চিম দুই দিকেই বসবাস করছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের একই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। মাঝখানে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গাদের বাস। এরাই সেই অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান। এদেরকে এই অঞ্চল থেকে উৎখাত করা হলে স্বাভাবিকভাবে তাদের স্থলে পুনর্বাসিত হবে মিয়ানমারের মগ, চাকমা ইত্যাদি সম্প্রদায়, যারা ধর্মীয় বিশ্বাসে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান। অন্যদিকে বাংলাদেশের বান্দরবানসহ পুরো পার্বত্য অঞ্চল এবং ভারতের মিজোরাম এলাকার উপজাতিগুলো নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসে সমগোত্রীয়। সুতরাং রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা গেলে এপার ও ওপারে সংকীর্ণ নাফ নদ ও পাহাড় ছাড়া আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকল না। লক্ষ্যনীয় মিজোরা বহু পূর্ব থেকেই স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। বাংলাদেশের এই অঞ্চলেও একাধিক গ্রুপ বিছিন্নতাবাদী। এদের এক বিপুল সংখ্যক আমাদের দূরদৃষ্টিতে ও উদাসীনতার কারণেই খ্রিস্টান। সুতরাং পূর্ব তিমুরের মতো বিছিন্নতাবাদী আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে এ অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরিকল্পনা যেমনি থাকতে পারে, পশ্চিমাদের তেমনি একই নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নিজেদের অঙ্গীভূত করে নেয়ার সুদূরপ্রসারী কৌশল থাকতে পারে মিয়ানমারেরও। সুতরাং রোহিঙ্গাদের নির্মূল অভিযানে পশ্চিমা দুনিয়া মৌখিক সমালোচনা করলেও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে পুনর্বাসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ কখনো চাইবে না বলেই মনে হয়।
ক্ষমতায় টিকে থাকার চিন্তায় বিভোর কোনো সরকারই এই বিষয়গুলো অতীতে যেমনি মূল্যায়ন করেনি বর্তমানেও করছে বলে মনে হয় না। সময় অনেক বয়ে গেছে, আর নয়। গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে হবে মিয়ানমারের কর্মকা-কে। আমরা মনে করি এ বিষয়ে বাংলাদেশের সার্বিক তৎপরতা শুরু করতে হবে আজই, আগামী দিন নয়। সুতরাং নাসিক নির্বাচন নয়, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিন। এক্ষেত্রে আমাদের প্রথম ও প্রধান বিষয় হবে জাতীয় ঐক্য। অতঃপর বিশ্ব সমাজের সমর্থন ও সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা। এ জন্য ব্যাপক প্রচারে নিতে হবে মিয়ানমারের ‘যুদ্ধাপরাধ’মূলক অমানবিক কর্মকা-গুলো যা বিশেষত নারীদের ওপর চালানো হয়েছে। ধ্বংসযজ্ঞের বাস্তব চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য সকল ধরনের মিডিয়া ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে। রোহিঙ্গা নির্মূল তৎপরতা ভারতের জন্যও যে ক্ষতির কারণ হতে পারে তা তুলে ধরে নৈতিক ও মানবিক সমর্থন-সহযোগিতা লাভে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও এ মুহূর্তে একটি জরুরি কাজ।
উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী বন্ধু ভারত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার বিষয় একটি কথাও বলেনি, এটি অপ্রিয় ও দুঃখজনক। আমাদের বিশ্বাস, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে জাতি একমত। এটাকে আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। আর একটি কথা হলো, এ প্রসঙ্গে দু’দেশ একবার সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি হয়েছিল অতীতে। মনে হচ্ছে মিয়ানমার যেন সেই রকম দুঃসাহসই লালন করছে। অন্তত তাদের উসকানিমূলক কর্মকা- ও নির্যাতন তাই প্রমাণ করে। সুতরাং কোনো সময়ই সামরিক আগ্রাসনের মুখে আমাদের পড়তে হবে না তেমনটি মনে করার কারণ নেই। এ জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি থাকা একান্ত দরকার। এ লক্ষ্যে পার্বত্য এলাকায় একটি শক্তিশালী রেজিমেন্ট গড়ে তোলা প্রয়োজন। তা না হলে রোহিঙ্গাদের আজকের সমস্যা আগামীদিনে আমাদের সমস্যা হয়েই দেখা দিতে পারে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।