হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : জাতীয় সংসদ আমাদের পুরো জাতির স্বপ্ন ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। ষোল কোটি মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের সাথে আমাদের জাতিসত্তার মেলবন্ধনের কর্মপরিকল্পনা এই জাতীয় সংসদ থেকেই গৃহীত ও বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসেও আমরা এখনো সেই কাক্সিক্ষত জাতীয় সংসদ গড়ে তুলতে পারিনি। দেশের সরকার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশাপ্রদ স্বপ্ন দেখাচ্ছে বটে, তবে এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, গত দুই দশকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে জাতির এই এগিয়ে চলার কৃতিত্ব যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেও দাবি করবে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল কারিগর এ দেশের কর্মঠ ও স্বপ্নচারী জনগণের বিশাল কর্মীবাহিনী ও উদ্যোক্তা শ্রেণি। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিটি নির্বাচনের আগে এই বিশাল কর্মযোগী জনগণের কাছে অগণিত প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিলেও দেশে বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে যা উন্নয়নের মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য।
বিগত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান উন্নয়নের রাজনীতির ধারণা গিলিয়েছিলেন। তিনি গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে পিছিয়ে পড়া পূর্ববাংলার উন্নয়নে জেনারেল আইয়ুব খানের প্রকল্পগুলো যতই প্রশংসনীয় বা উন্নয়নের মাইলফলক হোক না কেন, এ দেশের মূল ধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেসব অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক স্বাধিকার ও বৈষম্যমুক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের চেয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নকে বড় করে দেখলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম অর্থবহ ও সফল হতো না। জনগণের রায়ের প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের অনাস্থা ও অবিমৃষ্যকারিতার কারণেই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে তাদের অনীহা ও গড়িমসি পূর্ব পাকিস্তানের গণতন্ত্রকামী জনগণকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বর্ণনা করা এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে আইয়ুবি ‘রাজনীতি’ চেপে বসায় এসব ইতিহাসের কথা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। উনিশশ’ আটান্ন সালে মার্শাল ল’ জারির পর থেকেই জেনারেল আইয়ুব খান জাতিকে উন্নয়নের মহাসরণিতে তুলে দেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে অনেকটা বিনা বাধায় এক দশক পাকিস্তান শাসন করেছেন। বৃটিশদের কাছে থেকে একই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে ভারতীয় ইউনিয়নে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলেও পাকিস্তানের সামরিক জেনারেলরা জাতির ঘাড়ে গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে পুরো জাতিকে হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন। সেই বিক্ষোভের পথ ধরে স্বাধীনতার যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর যেখানে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে একদলীয় শাসন চালিয়েছিলেন। পরবর্তী জেনারেল জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছিলেন। তবে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার বিষয়গুলোও বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতির রাজনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট সময় পাননি। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী দলের ব্যাপক জনসমর্থন দেশে গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করলেও এখন সেই অবস্থা নেই এমন এক হতাশাজনক রাজনৈতিক পরিবেশের জন্ম হয়েছে। রাজনীতি ও গণতন্ত্রের এই গুমোট ও হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণই এই মুহূর্তে দেশের সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া। এর সাথেই জড়িয়ে আছে দেশের কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রত্যাশিত সুশাসনের প্রশ্ন।
দশম জাতীয় সংসদের কার্যক্রম ও আনুষঙ্গিক বিষয়াবলীর ওপর একটি গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করতে গিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বর্তমান সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ বলে অভিহিত করে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন গত বছর। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিরিখে এর গ্রহণযোগ্যতা দেশে-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও অবাধ ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থার অধীনে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রত্যাশা পূরণে সরকার তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে রাজি নয়। এমনকি আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সব দলের অংশগ্রহণমূলক ও ক্রেডিবল করতে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোচনার হাওয়া বইছে তাতেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক নীতিগত পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যদিও আগামী নির্বাচন নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। আগামী বছরে এ বিষয়ে কিছু নতুন সিদ্ধান্ত ও সমঝোতার বাতাবরণ তৈরি হতে পারে। তবে সংসদকে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও ফলপ্রসূ করে তোলার রাজনৈতিক উদ্যোগ না থাকলেও অর্ধশতাব্দী আগে জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে গৃহীত মার্কিন স্থপতি লুই আইসোডর কানের তৈরি আমাদের জাতীয় সংসদের আর্কিটেকচারাল নকশা নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় লুই আই কানের মূল নকশার বাইরের স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। পাকিস্তান সরকার প্রায় আটশ’ একর জায়গার ওপর ঢাকার শেরেবাংলানগরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা, গণযোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল। এর মধ্যে দুইশ আট একর জায়গা নিয়ে গঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্স ও ভবনটির অনন্য স্থাপত্য নকশা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সুখ্যাত এক স্থাপত্য নির্দশন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রফেসর, বিশ্বখ্যাত আর্কিটেক্ট লুই আই কানকে জাতীয় সংসদ ভবন তৈরির দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন তৎকালীন শাসক আইয়ুব খান। ১৯৬১ সালে নকশা প্রণয়নের পর ১৯৬৪ সালে লুই আই কান ও তার সহযোগীদের উপস্থিতিতে মূল ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হতে আরো এক দশক লেগে যায়। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগেই ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের হাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু হলে তাকে প্রথমে চট্টগ্রামে কবরস্থ করা হলেও জনপ্রত্যাশার আলোকে তার লাশ উত্তোলন করে বাংলাদেশের ইতিহাসে বৃহত্তম জানাজা শেষে জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তরাংশে লেকের উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে দাফন করা হয়। সেই থেকে জিয়ার মাজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জিয়ার মাজারে যাতায়াতের সেতুটি সরিয়ে নিয়ে ব্যাপক রাজনৈতিক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। এবার লুই আই কানের মূল নকশার দোহাই দিয়ে শেরেবাংলানগর থেকে জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে নিতে চাচ্ছে বলে বিএনপি নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। তবে জিয়ার কবর সরিয়ে নেয়ার কোনো আনুষ্ঠানিক সরকারি সিদ্ধান্ত এখনো গৃহীত না হলেও বিএনপির আশঙ্কা অমূলক নয় বলেই মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সংসদ ভবনটি বিশ্ববিখ্যাত স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত নাকি অর্ডিনারি অট্টালিকা সে বিতর্কের চেয়ে সত্যিকার অর্থে সংসদে নির্বাচিত সদস্যদের মান ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে তাদের ভূমিকাই মূল বিবেচ্য বিষয়। জনগণ যখন সত্যিকার অর্থে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ও কার্যকর সংসদীয় ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে, তখন সরকার যদি পাকিস্তান আমলে গৃহীত জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের মূল নকশার দোহাই দিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরটি সরিয়ে নেয়ার স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে তা দেশের রাজনীতিতে একটি ন্যূনতম সমঝোতা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ও নস্যাৎ করে দিতে পারে। লুই আই কানের মূল নকশা বাংলাদেশের সংসদ সচিবালয় বা অন্য কোনো সংস্থার হাতে ছিল না। সংসদ ভবন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার অনেক আগে ১৯৭৪ সালে স্থপতি লুই কান মৃত্যুবরণ করেন। তার নকশা অনুসারে মূল ভবনসহ সংসদ ভবন চত্বরের নকশার আয়তন সংরক্ষিত হলেও যতদূর জানা যায়, একদিকে লুই কানের নির্দেশিত অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি, আবার আইকনিক মূল সংসদ ভবনের অভ্যন্তরের স্থাপনাসহ সন্নিহিত এলাকায় অনেকগুলো নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে নকশাবহির্ভূতভাবে। প্রায় সরকারের আমলেই সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের নকশা নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ পরিকল্পনা গ্রহণের সময় ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী। তখন ঢাকার আয়তন এবং লোকসংখ্যা ছিল অনেক কম। তবে লুই কানের মতো স্থপতিরা নগরীর ভবিষ্যতের ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের কথা বিবেচনায় রেখেই এ ধরনের মনুমেন্টাল স্থাপনার নকশা প্রণয়ন করে থাকেন। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং মাত্র সাড়ে চার দশকে ঢাকার জনসংখ্যা ২০ লাখ থেকে প্রায় দুই কোটিতে উন্নীত হওয়ার বাস্তবতা পশ্চিমা একজন শৌখিন স্থপতির ধারণার বাইরেই থাকার কথা। ইতোমধ্যে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকার প্রথম স্থানে ঠাঁই পেয়েছে। যখন দেশের রাজধানী শহরের লাখ লাখ মানুষ ঘিঞ্জি বস্তিতে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে, যখন হাজার বছর ধরে বয়ে চলা ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দূষণে ও দখলে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে, তখন শত শত একর জায়গা নিয়ে অর্ধশত বছর আগে ভিন্ন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে গড়ে তোলা স্থাপত্য নকশায় কোনো পরিবর্তন ঘটবে না এমনটা আশা করা যায় না। তবে আইকনিক মূল অ্যাসম্বলি (জাতীয় সংসদ) ভবনে নকশাবহির্ভূত যেসব পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে যা লুই কানের দর্শন ও শৈলীকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে তা অপসারণ করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিশেষত সূর্যের প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস চলাচলের বিষয় বিবেচনায় রেখে করা নকশার পরিবর্তন ঘটানো হলে ভবনের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ও স্থায়িত্ব দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংসদ ভবন কমপ্লেক্সসহ শেরেবাংলানগরের আটশ, একর জায়গায় পরিকল্পিত নগরায়ণের অনেক কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষত অ্যাসেম্বলি সেক্টরে (সেক্টর-এ) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ন্যাম ভবন, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন, লোহার প্রাচীর, আইল্যান্ডসহ নকশাবহির্ভূত অনেক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উত্তরাংশের ৭৪ একর জায়গায় গড়ে তোলা চন্দ্রিমা উদ্যানসহ সন্নিহিত এলাকায় মাত্র দেড় একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা জিয়ার মাজারটি কমপ্লেক্সের প্যানারোমিক ভিউতে কম দৃষ্টিগ্রাহ্য ও গৌণ পরিবর্তন হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে।
ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য, পরিবেশবান্ধব ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিকল্পে ও বৃহত্তর স্বার্থে সরকার যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেই পারে। পাকিস্তান আমলের সংসদ ভবন কমপ্লেক্স ও প্রস্তাবিত প্রশাসনিক এরিয়া সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হওয়াই স্বাভাবিক। এখন প্রায় দু কোটি মানুষের ঢাকা নগরীকে যানজটমুক্ত করে আরো বাসযোগ্য করে তুলতে যদি সংসদ এলাকার ওপর দিয়ে কোনো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এমআরটি বা বিআরটি প্রকল্পের রুট নির্ধারণ করা হয়, তবে লুই কানের নকশার দোহাই দিয়ে তা বন্ধ রাখার যুক্তি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। অতীতে বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করতে গিয়ে শত শত কোটি টাকা বেহুদা খরচ করা হয়েছে, যা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা, সুযোগ-সুবিধা বা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখেনি। এ ধরনের বেহুদা খরচ ও সম্পদের অপচয় জনগণ প্রত্যাশা করে না। বিশেষত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন যখন প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তখন লুই আই কানের নকশা পুনরুদ্ধারের নামে জিয়ার মাজার সরিয়ে নতুন করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্ম দেয়ার মতো কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। লুই আই কানের প্রাপ্য বকেয়া পরিশোধ করে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আনার পর থেকে অন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু পাস কাটিয়ে মূলত জিয়ার কবর সরানোর আশঙ্কার কথাই বেশি আলোচিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে একটি টিভি টকশোতে সরকার সমর্থক একজন বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক কৌটিল্যের একটি অনুজ্ঞার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছেÑ দেশে শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে শাসককে যতটা সম্ভব বিতর্ক এড়িয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু একবিংশ শতকে এসেও আমাদের শাসকরা জনগণের মধ্যে অহেতুক ভয় ও বিতর্ক ছড়ানোর পস্থা অনুরসরণ করেছেন। এটি শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও জনগণের ওপর ভ্রান্ত ভয় বা ফোবিয়া চাপিয়ে দিয়ে পাওয়ার এলিটরা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। মার্কিন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড জনগণের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার অপতৎপরতাকে পশ্চিমা শাসকদের ‘পলিটিক্স অব ফিয়ার’ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশ যখন নি¤œ আয়ের দেশ থেকে আগামী দশকে মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন দেখছে, তখন ভয় ও প্রতিহিংসার রাজনীতি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ৬০ বছর আগের সংসদ ভবনের নকশা বাস্তবায়নের চেয়ে রাজধানীসহ দেশকে বাসযোগ্য রাখা এবং একাত্তরের বৈষম্যমুক্ত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ অর্জনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক-রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতি নজর দেয়া এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল নকশা বাস্তবায়ন বেশী জরুরি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।