Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খোলা হচ্ছে আজ

লুই আই কানের মূল নকশা

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

* নকশায় যা আছে, তাই থাকবে : ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন
* জিয়ার কবর সরিয়ে পাকিস্তানের পতাকা প্রতিষ্ঠা করতে চায় সরকার : অভিযোগ বিএনপি
হাবিবুর রহমান : যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা সংসদ সচিবালয়ের হেফাজতে থাকলেও তা আজ  রোববার সরকারি কার্যদিবসের প্রথম দিনে খুলে দেখা হবে। এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পীকার এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী, সংসদ সচিবালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বলে সংসদ সূত্রে জানা গেছে। এর পরে বিকালে সংসদের ত্রয়োদশ অধিবেশনে সংসদ ভবন কমপ্লেক্স’র নকশা পাওয়ার বিষয়টি এবং এক্ষেত্রে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরকার বলে দাবি করলেও আসলে এ সরকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে পাকিস্তানের পতাকা প্রতিষ্ঠা করতে চায় বলে অভিযোগ বিএনপির নেতাদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংসদের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বড় স্থাপনাগুলোর ক্ষেত্রে সহসা সিদ্ধান্ত না আসলেও কবরের মতো ছোট- ছোট স্থাপনাগুলো দ্রুতই সরিয়ে ফেলা হবে। স্থাপনাগুলো সরানোর জন্য সরকার এতদিন লুই আই কানের নকশার জন্য অপেক্ষা করেছিল। তা এসেছে এখন আর দেরি হবে না।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা থেকে মরহুম সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর বিষয়ে এর আগে সংসদ ভবনের সীমার ভেতরে নকশায় যা আছে, শুধু তাই থাকবে। মোদ্দা কথা  সেখানে মূল নকশাই আমরা প্রতিস্থাপন করব। এটা করতে গিয়ে সেখানে কারও কবর থাকলে তাও অপসারণ করা হবে। মূল নকশা প্রতিস্থাপন করার কাজ শুরু হবে। নকশায় যা আছে, তাই থাকবে। নকশার বাইরে যা কিছু আছে, সেগুলো থাকবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে: জে: (অব.) মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, জিয়াউর রহমান একজন বড় মাপের মানুষ। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর সরানো কাজটি হবে সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। জিয়াউর রহমান দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে ’৭১ সালে যুদ্ধ করেছে। সরকার যদি এটা করে তা হলে স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা হবে। কারণ, বিএনপি পাকিস্তানের পতাকাকে সম্মান করেনি, এ জন্য জিয়াউর রহমানের কবর দেয়া হয়েছে সেখানে। আজ সরকার জিয়াউর রহমানের কবর সরিয়ে তাদের প্রতি সম্মান দেখাতে চায়।  
সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানায়, গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কাইভ  থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা ঢাকায় পৌঁছেছে। এটি বর্তমানে সংসদ সচিবালয়ের লাইব্রেরির হেফাজতে রয়েছে। সংসদ সচিবালয় কমপ্লেক্সে নকশা বহির্ভূত নির্মিত সকল ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করতে এ মূল নকশায় ফিরিয়ে আনতেই সরকারের সিদ্ধান্ত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ৪১টি বাক্সে এই নকশাগুলো এলেও এখনো তা খুলে দেখা হয়নি। বর্তমান সরকারের বিগত মেয়াদে সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর দাবি ও সংসদ ভবনের পূর্ব প্রান্ত থেকে মেট্রোরেলের রুট হওয়া খবরের প্রেক্ষাপটে লুই কানের মূল নকশার প্রসঙ্গটি উঠে আসে। মেট্রোরেলের রুটের বিরোধিতাকারীদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে ওই সময় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নকশার বাইরে আরো কিছু স্থাপনা নির্মিত হওয়ার কথা জানান। এগুলো বিগত বিএনপি সরকার করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওই সময় নকশা খতিয়ে দেখারও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সংসদ সচিবালয়ে  খোঁজাখুঁজি করে তখন পূর্ণাঙ্গ নকশা পাওয়া যায়নি। পরে সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে লুই কানের মূল নকশা আনার উদ্যোগ নেয়।
মূল নকশা আনার প্রক্রিয়ার সময় ২০১৩ সালে সংসদ সচিবালয়ের পক্ষ থেকেও নকশা বহির্ভূত একটি স্থাপনা করতে গেলে স্পিকারের নির্দেশে তা বন্ধ করা হয়। পরে ২০১৪ সালে সংসদ কমিশনের বৈঠকে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মিতব্য ওই স্থাপনা বন্ধের নির্দেশ  দেয়ার পাশাপাশি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সংসদ ভবন এলাকায় নকশা বহির্ভূত কোনও স্থাপনা রাখা যাবে না। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার নকশা বহির্ভূত সকল স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এছাড়া সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংসদ ভবনের মূল নকশা আনার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরের ১৭ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। একই বছরের ৭ জুলাই একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই আই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কবরগুলো যদি সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তা করবে।
এরপর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ১৪ জুলাই একটি প্রস্তাব তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে স্থপতি লুই আই কানের নকশায় শেরেবাংলা নগর এলাকায় কবরস্থানের জন্য কোনো জায়গা রাখা হয়নি উল্লেখ করে জিয়াউর রহমানের কবরসহ জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় অবস্থিত সব ক’টি কবর সরানোর পক্ষে মত দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে সংসদ সচিবালয় শেরেবাংলা নগরে স্থানান্তরের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য গত বছর ১৩ অক্টোবর তোলা হলে প্রধানমন্ত্রী তা ফেরত পাঠান। ওই সময় তিনি এও জানিয়ে দেন লুই কানের নকশা আসার পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানায়, ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার আদলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ওই সময় স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই ভবনের স্থপতি নিয়োগ করা হয়। তার প্রস্তাবেই লুই আই কান এই প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর লুই কান কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূল নকশা সংশ্লিষ্ট কিছু পরিকল্পনা তিনি হস্তান্তর করতে পারেননি। পরবর্তীকালে এ নিয়ে কোনো সরকারই আগ্রহ দেখায়নি।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার আদলে বর্তমান সংসদ ভবন নির্মাণের কাজ লুই আই কানের মূল নকশার প্রথম ধাপ ছিল ২০৮ একর জায়গার ওপর জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণ। যার সামনে ও পেছনে থাকবে বিস্তীর্ণ সবুজ খোলা মাঠ। চারদিকে আট লেনের সড়ক, মাঝখানে লেক। দ্বিতীয় ধাপে লেকের পর বিস্তীর্ণ সবুজ। এছাড়া বাকি জায়গায় গড়ে তোলা হবে সচিবালয়, লাইব্রেরি, জাদুঘর, হাসপাতালসহ প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিকবলয়।
১৯৮১ সালে ৩০ মে চট্টগ্রামে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে সংসদ ভবন এলাকার উত্তর পাশে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের কবর প্রতিস্থাপন, ঝুলন্ত ব্রীজ নির্মাণ করে অর্ধ চন্দ্রাকৃতির চন্দ্রিমা উদ্যানের আকৃতিও পরিবর্তন হয়। এর নামও পরিবর্তন করে জিয়া উদ্যান রাখা হয়। এছাড়া সংসদ ভবনের পশ্চিম দিকে আরো সাতটি কবর রয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আটজন নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিকে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের পশ্চিম প্রান্তে পাঁচ বিঘা জমিতে ‘জাতীয় কবরস্থান’ নাম দিয়ে সাত জনকে সমাহিত করা হয়। তারা হলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তার, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ও আতাউর রহমান খান, সাবেক মন্ত্রী মশিউর রহমান যাদু মিয়া, মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার তমিজউদ্দীন খান। এ আটটি কবর ছাড়া শেরেবাংলা নগরে আছে লুই কানের নকশাবহির্ভূত আরও সাতটি স্থাপনা। এগুলোর মধ্যে বড় স্থাপনা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিআইসিসি) এবং স্পিকার ও  ডেপুটি স্পিকারের বাসভবন। এর বাইরে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার কবরের চারদিকে থাকা চারটি প্রবেশপথের শুরু বা শেষ প্রান্তে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, সম্মেলন কেন্দ্র ও মসজিদসহ চারটি স্থাপনা। গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংসদ এলাকায় মূল নকশার বাইরে স্পিকার ডেপুটি স্পিকারের জন্য বাসভবন বানানো হয়। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তখন ভবন দুটি তৈরি হয়। এ সংক্রান্ত একটি মামলা এখনও বিচারাধীন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রও বিএনপির আমলে তৈরি শুরু হয়। তখন এর নাম রাখা হয়েছিল বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এর নাম পরিবর্তন করে।
সংসদের অতিরিক্ত সচিব এম গোলাম কিবরিয়া ইনকিলাবকে বলেন, নকশাগুলো সংসদ সচিবালয়ের সম্পদ। এটা সংসদের হাতে এসেছে এটাই বড় কথা। কোনও স্থাপনা নির্মাণ বা ভেঙ্গে ফেলা সংসদ সচিবালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এটা সরকারের গণপূর্ত বিভাগের কাজ। তারা কবে করবে বা কীভাবে করবে সেটা তারাই বলতে পারবে। স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির বলেন, নকশা বাংলাদেশে এসেছে এবং সংসদ সচিবালয়ের হেফাজতে রয়েছে। এখন কী পদক্ষেপ সরকার নেবে, তা সরকার করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ