Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর ‘ব্যতিক্রমী রাজনীতি’

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম


গাজী আতাউর রহমান

॥ শেষ কিস্তি ॥
মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. ছিলেন একজন নীতিনিষ্ঠ রাজনীতিক। পূর্বসূরী আউলিয়ায়ে কেরামের মতো তিনিও প্রচলিত ধারার শুধু ক্ষমতা বদলের রাজনীতি পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন-“প্রচলিত পদ্ধতিতে কেয়ামত পর্যন্তও যদি ক্ষমতার হাত বদল হয়, তবুও জনতার মুক্তি আসবে না।” তিনি নীতি ও সাংবিধানিক কাঠামোর পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি রাজনীতি ও প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন চেয়েছেন। তিনি বলতেন, “শুধু নেতার পরিবর্তন আর ক্ষমতার হাত বদল হলেই যে শান্তি আসতে পারে না, বিগত দিনে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছি।” তিনি বারবার বলেছেন, “আকাশ জমিনের মালিক যেমন আল্লাহ, জীবন-মৃত্যুর মালিক যেমন আল্লাহ, ক্ষমতা-রাজত্ব আর সম্পদের মালিকও তেমনি আল্লাহ, শান্তির মালিকও আল্লাহ। অতএব শান্তি পেতে হলে মানুষের গড়া দূর্বল নীতি বাদ দিয়ে আল্লাহর ইনসাফপূর্ণ নীতিতে দেশ চালাতে হবে।”
তিনি আরো বলতেন, “একমাত্র ইসলামই মানুষের মুক্তির গ্যারান্টি; আওয়ামী লীগ, বিএনপিও যদি ইসলামের ইনসাফপূর্ণ বিধানের আলোকে দেশ চালায়- আমি তাদের খাদেম হয়ে থাকবো। আমি ক্ষমতা চাই না, আমি চাই মানুষের শান্তি।”
পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর পদ্ধতি ও নীতির পরিবর্তনের জোড়ালো আহবান অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবির সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের বিপ্লবী আওয়াজেরই প্রতিধ্বনি ছিল। পীর সাহেব রহ. এর রাজনৈতিক দর্শন-চিন্তা ছিল সুদূরপ্রসারী। সাময়িক স্বার্থ চিন্তায় তিনি কখনো তাড়িত হতেন না। চমক আর হুজুগের রাজনীতি, আবেগ আর হঠকারী রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। তিনি ইসলামী রাজনীতির স্বতন্ত্র ধারা বজায় রাখতে চেয়েছেন। তিনি জাতীয় রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের কথা ভাবতেন। এ লক্ষ্যেই তিনি শেষ জীবনে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়ে ছিলেন। জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে  সকল রাজনৈতিক দলের সাথে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রতি তিনি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি জাতীয় সমস্যা ও ধর্মীয় বিষয়াদী নিয়ে দেশের সচেতন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন। তিনি সব সময় স্পষ্ট কথা বলতেন। কোন বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার বা পাশ কাটানোর প্রবণতা তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ওলামা, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণী-পেশার গণমানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করার চেষ্টা চলিয়েছেন। জাতীয় জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ মূহুর্তে ১৯৮৭ সালের ১৩ মার্চ গণমানুষকে মুক্তি ও আলোর পথ দেখাতে তিনি কায়েম করেছিলেন “ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন” নামের একটি গণ-সংগঠন। সংগঠনের নামের মধ্য দিয়েই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, দেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে শাসনতান্ত্রিক সংকট। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মানুষ মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা বহাল রেখে গোলামীর হাত বদল হয়েছে মাত্র। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামীনের গোলামী করার আহবান জানিয়ে ছিলেন। এটাই ছিল পীর সাহেব চরমোনাই রহ.-এর এবাদতের রাজনীতির মূলমন্ত্র। তিনি মানুষের ভেতরের প্রকৃত মনুষ্যত্ত্বকে জাগিয়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সমাজের প্রতিটা মানুষ যাতে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে সংশোধন করে একজন আল্লাহ প্রেমিক মানবতাবাদী ইনসানে কামেলে পরিণত হতে পারে-সেটাই ছিল এই সাধক পুরুষের সবচেয়ে বড় মিশন। তাঁর রেখে যাওয়া সে মিশন এখনও চালু আছে। আত্মশুদ্ধি ও ব্যক্তিশুদ্ধির এই প্রচেষ্টার ফলে সমাজের বহুসংখ্যক অপরাধী অপরাধের পথ পরিহার করে ন্যায়ের পথে চলছেন। অনেকেই সমাজ বিরোধী, রাষ্ট্র ও আইন বিরোধী, ধর্ম ও নৈতিকতা বিরোধী পথ পরিহার করে শান্তির আলোকিত পথ ধরেছেন। একটি ভাল রাষ্ট্র ও ভাল সমাজ গড়ে তুলতে হলে ভাল মানুষের প্রয়োজন। পীর সাহেব চরমোনাই রহ. সেই ভাল মানুষ তৈরীর জন্যে সবচেয়ে বেশি পেরেশান ছিলেন। এমন একজন মানবতাবাদী দরদী আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা পাওয়াটা ছিল আমাদের জন্যে এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়।
মানুষের মাঝে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, “আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে মানুষ সমাজবিমূখ ও সংসার বৈরাগী হয়ে যায়।” মহান আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক পীর সাহেব চরমোনাই রহ. তাঁর সময়োপযোগী দর্শন-চিন্তা ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে তা নতুন করে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি তাঁর বৈচিত্রময় কীর্তির মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহকে পাওয়ার সাধনা মানুষকে আরো সমাজমূখী এবং জীবন-জগত সম্পর্কে আরো দায়িত্বসচেতন করে তোলে। সন্যাস প্রবণতা আর বৈরাগ্যতা তো দূরের কথা বরং নিজের মাঝে রাষ্ট্রচিন্তা ও বিশ্বচিন্তার উন্মেষ ঘটে। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেতনা বিকশিত হয়।
২০০৬ইং সালের ২৫ নভেম্বর এই মহান সাধক, ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন পূনর্জাগরণের আপোষহীন সংস্কারক মাওলায়ে করীমের ডাকে সাড়া দিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরীর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এদেশে এবাদতের রাজনীতিকে নতুন মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব
    ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
    কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা     পরিষদ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ