Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আইএমএফের শর্ত মেনে ঋণ নেয়া মানেই দেশ সার্বভৌমত্ব হারানো : আলাপচারিতায় ড. দেবপ্রিয়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১২ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৩ এএম

সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কেউ যদি বলেন, আইএমএফের শর্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মানে, দেশ নীতি সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় একটি উত্তরণকালীন নীতি-সমঝোতা শীর্ষক’ আলাপচারিতায় ‘আইএমএফের ঋণ পাওয়ার পূর্বশত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে কি না’ প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, কোনো সরকারের জন্য এটি সম্মানজনক নয়। তবে এই ধরনের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রাক-পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই সময়ে তিনি বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপের উদাহরণ দেন। তিনি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে ‘অনভিপ্রেত ও অবিবেচনাপ্রসূত’ বলে মনে করেন।
তেলের মূল্য ধাপে ধাপে বাড়ালে যৌক্তিক হতো কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতি কখনও অভিঘাত গ্রহণ করতে পারে না। এটা করা হলে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অর্থনীতি অভিঘাত পছন্দ করে না। অনেক দিন ধরে না করে এক ধাক্কা দেয়া এটা অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। তিনি মনে করেন, শুধু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নয়, সুদের হার, বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও এমনটি সত্য।

আরেক প্রশ্নের জবাবে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি কতদিন থাকবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে অর্থনীতির যে চিত্র দেখছি, মূল্যস্ফীতি বাড়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী দুই বছর পর্যন্ত এ অবস্থা থাকবে।
সরকারের এই মুহ‚র্তে তিনটি বিষয় করণীয় আছে বলে ড. দেবপ্রিয় মনে করেন। প্রথমত, সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে উৎসাহ দেওয়া এবং তৃতীয়ত, অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে সমর্থন দেওয়া।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ৬টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিলেন। অর্থবছরের শুরুর দুই মাসের মধ্যে এর চারটি আরও তীব্র হয়েছে। বাজেটের পর অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অনেকে বলছেন বৈশ্বিক কারণে এই পরিস্থিতি। আমি তাদের সঙ্গে আংশিক একমত হয়ে বলছি, শুধু বৈশ্বিক কারণে বললে এক ধরনের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। অর্থনীতির মূল ফুসফুস হলো আর্থিক খাত। বর্তমানে যে আর্থিক কাঠামো এবং সরকারের খরচ করার যে সক্ষমতা তা উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে সমর্থন দেওয়ার মতো নয়। সরকার এখন আর্থিক সম্পদ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভর্তুকি কমিয়ে দিচ্ছে। অথচ সরকারের আর্থিক সামর্থ্য থাকলে জ্বালানি তেলের এতো উচ্চ হারে দর বাড়িয়ে মানুষকে কষ্টে ফেলতে হতো না।

তিনি বলেন, ভর্তুকি কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সার, বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসে ভর্তুকি দরকার। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে সেটা খারাপ ভর্তুকি। জ্বালানি তেলের ভর্তুকি কমিয়ে বড় অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া ভুল পদক্ষেপ।

বর্তমান সঙ্কটে শ্রমিক শ্রেণিকে সুরক্ষা দিতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, এই মুহ‚র্তে একটি জাতীয় মজুরি কমিশন গঠনের সময় হয়ে গেছে। তৈরি পোশাক শ্রমিকদের এখন মহার্ঘ্য ভাতা দেওয়া উচিত। বেশি বিনিময় হারের সুবিধা পাচ্ছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। তাই এর একটি অংশ পোশাক শ্রমিকদের পাওয়া উচিত। কারণ, বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

নীতিনির্ধারকেরা ক্ষুন্ন মনে স্বীকার করছেন যে অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে-এই মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নীতিনির্ধারকেরা অপরিপক্ব ও বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলছেন। তারা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলছেন। কেউ বলছেন, দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ঠিক হয়ে যাবে, কেউ বলছেন, ২০২৪ সালের আগে ঠিক হবে না। কেউ বলছেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেবে না, কেউ বলছেন নেবে। এসব কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, নীতি প্রণয়নের মধ্যে রাজনীতিবিদেরা নেই, আমলানির্ভর নীতি প্রণয়ন হচ্ছে।

তার মতে, কর-জিডিপি যদি ১৫ শতাংশ হতো, তাহলে সরকার এখন ভর্তুকি দিতে পারত। তিনি বলেন, আমাদের রাজস্ব আহরণ অনেক কম। বড় দুর্বলতা এই জায়গাতেই। জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত যদি ১৫ শতাংশ হতো, তাহলে এই সংকটকালে বাড়তি রাজস্ব দিয়ে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারত। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, যা করা হচ্ছে না।

অর্থনীতিতে যে সঙ্কট চলছে, তা নিরসনে অর্šÍবর্তীকালীন নীতি সমঝোতার পরামর্শ দিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সঙ্কটকালে একটি বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে নীতি সমঝোতা বাস্তবায়ন করতে পারলে সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব। বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব বলতে কী বোঝাতে চান-এমন প্রশ্নের জবাবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনীতির চলমান সঙ্কট কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে সরকার সংসদের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা করতে পারে। প্রথমে মন্ত্রিসভায় আলোচনা করতে হবে। তারপর সংসদে এবং স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করতে পারে। সংসদের বাইরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

তিনি বলেন, সরকার যতই কাজ করুক না কেন, সেটা যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, জনগণের আস্থা অর্জন না করে, তাহলে সবচেয়ে ভালো নীতিও তখন কাজে আসে না। সে জন্যই আমি সমঝোতার ভিত্তিতে নীতি প্রণয়নের কথা বলছি।
অর্থনীতির বর্তমান চাপ থেকে উত্তরণে তিনি জাতীয়ভাবে অংশ্রগ্রহণমূলক ও পরামর্শমূলক একটি নীতি সমঝোতার সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে আগামীতে রাজনৈতিক টানাপোড়েন যাই থাকুক না কেন অর্থনীতি তা থেকে মুক্ত থাকবে।

অংশগ্রহণমূলক নীতি সমঝোতার জন্য বিরোধী দলের সঙ্গে, সরকারের রাজনৈতিক সহযোগী, সুশীল সমাজ, অর্থনীতি বিশেষজ্ঞসহ নানান পর্যায়ে আলোচনা করে দুই থেকে তিন বছরের একটি স্বল্প মেয়াদি কৌশল প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।

আর্থিক খাতের সঙ্কট মোকাবিলায় দুই থেকে তিন বছরের জন্য একটি অন্তবর্তীকালীন অর্থনৈতিক নীতি সমঝোতা প্রয়োজন বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এই নীতি সমঝোতায় নীতি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা; উৎপাদন ও কর্মসংস্থান অব্যাহত রাখা এবং গরিব মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া। এই নীতি প্রণয়ন ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তাহলে আগামীতে যদি রাজনৈতিক টানাপোড়েন হয়, তখনো আর্থিক খাতকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ড. দেবপ্রিয়

২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ