Inqilab Logo

শনিবার ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ২৯ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

গন্তব্য কোথায় ইউক্রেনের শস্যবাহী জাহাজগুলোর?

২০২২ : অভূতপূর্ব খাদ্য সঙ্কটের বছর

ডানা ইশরাত | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ এবং পরির্বতিত বিরূপ আবহাওয়া বিশ্বের লাখ লাখ মানুষকে অনাহারের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) ২০২২ সালকে অভূতপূর্ব খাদ্য সঙ্কটের বছর বলে অভিহিত করেছে। সেন্ট্রাল আমেরিকান ড্রাই করিডোর (সিএডিসি) ও হাইতি থেকে শুরু করে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, মধ্য আফ্রিক, দক্ষিণ সুদান এবং পূর্ব দিকে হর্ন অফ আফ্রিকা, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং আফগানিস্তান পর্যন্ত সারা বিশ্বে অস্থিরতা এবং খাদ্য তীব্র সঙ্কট ছড়িয়ে পড়েছে।

অনাহারের মুখে রয়েছে বিশে^র ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, আগামী মাসগুলোতে মোট ৪৫টি দেশের ৫ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা আফ্রিকার। কেনিয়ায় গত দু’বছরে যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে, তা বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চারগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ইথিওপিয়ার ৭ লাখের বেশি মানুষকে দৈনিক খাদ্য সহায়তা দিতে হবে।
কোভিড-১৯ মহামারি, আবহাওয়া পরিবর্তন এবং সঙ্ঘাতের আন্তঃসংযুক্ত ধাক্কা আগেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য, কৃষি, অর্থ ও শাসন ব্যবস্থা এবং বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। এরপর ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ ইতোমধ্যেই অনিশ্চিত দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অপুষ্টি পরিস্থিতিতে আরো বিপর্যকর করে তুলেছে। এটি মর্মান্তিক মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি, যুদ্ধটি কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল থেকে প্রধান কৃষিপণ্য রোপণ, ফসল সংগ্রহ, পরিবহন এবং রফতানিতে ব্যাপক বিঘ্ন সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের সকল প্রান্তে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

কম শস্য সরবরাহ বৈশ্বিক পণ্য বাজারকে উচ্চ ঝুঁকিতে নিয়ে গেছে। এর ওপর আবার প্রভাব ফেলেছে জ্বালানি এবং সারের উচ্চমূল্য। যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ও বাণিজ্য কমে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন সোমবার ঘোষণা করেছে যে, আমেরিকা ইউক্রেনকে ১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা দেবে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এককালীন অস্ত্রের প্যাকেজ। এটিসহ ইউক্রেনের জন্য বাইডেন প্রশাসন প্রায় ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার প্রদান করল। এর মানে হ’ল, এ যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে না; খাদ্য সঙ্কটও নয়।

গত মাসে জাতিসংঘ এবং তুরস্ক ইউক্রেনের শস্য চুক্তিতে মধ্যস্থতার পর শস্যবাহী দুটি জাহাজ ইউক্রেন থেকে তুরস্কের দিকে রওনা হয়। একটির গন্তব্য ব্রিটেন, একটির আয়ারল্যান্ডে এবং অন্যগুলোর গন্তব্য ইতালি ও চীন। জাতিসংঘ তুরস্ক এবং ইউরোপে ভুট্টা নিয়ে যাওয়া তিনটি চালানকে ‘জীবন রক্ষাকারী শস্যের চালান’ হিসাবে বর্ণনা করেছে, যেখানে ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া মতো খাদ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়া অঞ্চলগুলোর জন্য সাহায্য নিয়ে এখনও কোনো জাহাজ পৌঁছেনি। পরিবর্তে, জাহাজগুলো বিক্রির জন্য শস্য নিয়ে সেখানে যাচ্ছে, যেখানে যেতে ক্রেতারা নির্দেশ দিচ্ছে।

যদিও, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সোমবার বতসোয়ানা থেকে বলেছেন যে, তার দেশ বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে নিয়োজিত থাকতে প্রস্তুত, তবে, ইউক্রেনের বাণিজ্য রুটগুলো পুনরায় চালু করার পেছনে উদ্দেশ্য সরাসরি দুর্ভিক্ষের প্রান্তে থাকাদের কাছে খাদ্যশস্য পৌঁছানো নয়। বরং মুক্ত চালানের মাধ্যমে অর্থ বিশ্ববাজারে খাবারের দাম কিছুটা কমানো। যদিও ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ইউক্রেন থেকে সরাসরি ইয়েমেন এবং সোমালিয়ার মতো ক্ষুধাপীড়িত দেশগুলোতে খাদ্য সহায়তা নিতে একটি জাহাজ ভাড়া করেছে, তবে সেটি কবে গন্তব্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।

বর্তমান মানবিক প্রয়োজন মেটাতে ডব্লিউএফপি’র ২২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে প্রয়োজন। নাইজেরিয়া, শাদ, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, মালি এবং মৌরিতানিয়া, এ ৬টি সাহেল দেশ জুড়ে পশ্চিম আফ্রিকায় ৯ লাখ লোক অনাহারে মারা যেতে পারে। পূর্ব এবং দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে এ মাসের শেষ নাগাদ ৬ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি লোক জরুরি খাদ্য অবস্থা বা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তা এবং পুষ্টি সঙ্কটের প্রতিক্রিয়ায় মাদাগাস্কার, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং মোজাম্বিকের মতো দেশে চলমান প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক জরুরি অর্থায়ন চালু করেছে এবং ওএফপি পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার ৭টি দেশের জন্য অতিরিক্ত প্রায় ৩শ’ ৫০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করছে। কিন্তু এগুলো কার্যকর হওয়া দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ। ক্রমবর্ধমান খাদ্য সঙ্কটে নিমজ্জিত লেবানন গত সপ্তাহে ওডেসা বন্দর থেকে শস্যের প্রথম চালানের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু লেবাননের ক্রেতারা চালানটি প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, এটি ৫ মাস দেরি করেছে।

ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম সতর্ক করেছে যে, চুক্তিটি বাজায় রাখলেও সরবরাহ এখনও আঁটসাঁটো থাকায় খাদ্যের দাম বাড়তে থাকবে এবং কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ায় ইউক্রেনের ফসল গত বছরের তুলনায় কম হবে। যদিও, দেশটিতে গত বছরের প্রায় ২০ মিলিয়ন টন শস্য অবশিষ্ট রয়েছে এবং এ বছরেও প্রায় ২০ মিলিয়ন টন উদ্বৃত্ত থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে, কিন্তু এই ব্যাপক পরিমাণ শস্য পরিবহনের জন্য বিপুল সংখ্যক জাহাজের প্রয়োজন এবং কিছু জাহাজের মালিক যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে অনিচ্ছুক, বিশেষ করে সমুদ্রে নৌ-মাইনগুলো বিস্ফোরণের আশঙ্কা, লোকবল এবং বীমার উচ্চ মূল্যের কারণে।

চুক্তিতে জড়িত তিনটি বন্দর ওদেসা, চোরনোমর্স্ক এবং পিভদেন্নি প্রায় ৩ মিলিয়ন টন পণ্য পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখে, যা এ মুহূর্তে বৈশি^ক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। আশঙ্কা এই যে, অক্টোবরেও ইউক্রনের শস্য রফতানির লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে।
এদিকে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে খাদ্যমূল্যের স্ফীতি সাধারণ মূল্যস্ফীতির সাথে যোগ হয়ে ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। প্রভাব বিশ্বের দরিদ্রতম ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগে উপরোল্লিখিত সংখ্যার পরিবর্তন ঘটবে এবং ২০২০ সালের তুলনায় আরো ৪ কোটির বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় যুক্ত হবে।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক সতর্ক করেছে যে, ইউক্রেনের যুদ্ধ বাণিজ্য, উৎপাদন, এবং ব্যয়ের বৈশ্বিক নজিরগুলিকে এমনভাবে বদলে দিয়েছে যে, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ খাদ্য ও পণ্য মূল্যগুলো ঐতিহাসিকভাবে উচ্চস্তরে অবস্থান করবে এবং এটি প্রত্যেককে, সর্বত্র আঘাত করবে। এর পরিণতি ব্যাপক মৃত্যু, শরণার্থী চাপ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আরও যুদ্ধের কারণ হয়ে উঠতে পারে।



 

Show all comments
  • এইচ এম মোমিন উল্লাহ ১১ আগস্ট, ২০২২, ৮:৩৫ এএম says : 0
    ঠিক বলেছেন
    Total Reply(0) Reply
  • Farhan Janvi ১১ আগস্ট, ২০২২, ৮:৩৫ এএম says : 0
    আন্দলন ছাড়া কোনো উপায় নেই। সাধারন জনগনকে রাস্তায় নামতে হবে।।।
    Total Reply(0) Reply
  • Al-amin Abdullah ১১ আগস্ট, ২০২২, ৮:৩২ এএম says : 0
    তুরস্কে জিন্দাবাদ ইসলাম জিন্দাবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • Shilon Kha ১১ আগস্ট, ২০২২, ৮:৩২ এএম says : 0
    মানবজাতির ধ্বংসকারী ইউক্রেনের জীবাণু অস্ত্র ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ করছে তাই রাশিয়াকে মানবজাতি ধন্যবাদ জানানো উচিৎ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গন্তব্য কোথায় ইউক্রেনের শস্যবাহী জাহাজগুলোর?
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ