Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী সঙ্গীতের উত্থান চলছেই

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০২২, ৮:০৯ পিএম

ভক্তিমূলক গানের গায়ক হিসাবে সন্দীপ চতুর্ভেদীর গায়কী জীবনের শুরু। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার সন্দীপ চতুর্ভেদী নতুন একটা গান রেকর্ড করার জন্য তার অস্থায়ী স্টুডিওতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গানটি একটি মসজিদকে ঘিরে, যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজো করার অধিকার দাবি করার পর তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। গানটি মুসলিম বিরোধী কটাক্ষ দিয়ে ভরপুর। কিন্তু চতুর্ভেদী বলছেন, এই গান আবার তার ভাগ্য ফেরাতে পারে।

ভারতে ইদানীং ইউটিউব এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এমন কিছু গান বেশ চলছে যার মাধ্যমে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। এসব গানের কথা আপত্তিকর এবং হুমকিতে পূর্ণ। গানগুলো এমন ধারণার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে যে হিন্দুরা বহু শতাব্দী ধরে মুসলমানদের হাতে নির্যাতন সহ্য করেছে - এবং এখন তার পাল্টা শোধ নেবার সময় এসেছে।

লেখক এবং রাজনীতির বিশ্লেষক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন, এই গানগুলো অনেকের আয়ের উৎস ছাড়াও, এই জাতীয় গানের গায়করা মূলত এর মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করছেন তার জন্য এগুলো কোন সঙ্গীত নয়। "এটা এক ধরনের যুদ্ধের ডাকের মতো। বিষয়টা এরকম যেন যুদ্ধ জয়ের জন্য গানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা গানের অপব্যবহার এবং এটা বছরের পর বছর ধরে হয়ে আসছে।"

প্রায় এক দশক আগে ভক্তিমূলক গানের গায়ক হিসাবে চতুর্ভেদীর গায়কী জীবনের শুরু। কিন্তু কয়েক বছর পরে তিনি গানের ধারা পরিবর্তন করেন এবং "হিন্দুধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ" সম্পর্কে গান রচনা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে তার ইমেজ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। দুই হাজার ষোল সালে তার একটি গানের মিউজিক ভিডিও ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে রাতারাতি ব্যাপক হিট হয়েছিল।

গানটি খুবই জ্বালাময়ী, যার মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে যেদিন হিন্দু জাতীয়তাবাদ জেগে উঠবে সেদিন কি ঘটবে সে সম্পর্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা। চতুর্ভেদী বলছেন, হাজার হাজার অভিযোগের কারণে ইউটিউবে তার চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ার আগে এই গানটি লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছে। তিনি তার গানের বিষয়বস্তু নিয়ে ইউটিউবে রিপোর্ট করার জন্য মুসলিমদেরকে দায়ী করেন।

লক্ষ লক্ষ সাবস্ক্রাইবার হারানোর বিষয়টি নিয়ে তার বেশ দুঃখ। কিন্তু ইউটিউব থেকে তিনি কি পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন তা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন তিনি৷ তবে তিনি বলেছেন যে একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করতে তার প্রায় কুড়ি হাজার রুপি খরচ হয়৷ তিনি জোর দিয়ে বলেন, "আমি ইউটিউব থেকে খুব একটা অর্থ উপার্জন করছিলাম না। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আমি একজন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী গায়ক হিসেবে যে স্বীকৃতি পেয়েছি সেটা।"

ইউটিউবে একটি নতুন চ্যানেল তৈরি করেছেন সন্দীপ চতুর্ভেদী। কিন্তু তার আপলোড করা কিছু কন্টেন্টের ভিউ তেমন একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। তিনি অবশ্য আশা করছেন যে তার সর্বশেষ গান বিষয়টা বদলে দেবে। তার গানে তিনি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন প্রায়শই তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠে কিন্তু সেনিয়ে সন্দীপ চতুর্ভেদীর কোন অনুতাপ নেই। "যে জিনিস আমার তা পেতে যদি আমি যদি হাত জোড় করে অনুনয় করি, আপনি কি আমাকে তা দেবেন? না আপনি দেবেন না। তাই আমাদের উস্কানিমূলক হতে হবে, তাই না?"

একই ধরনের গান করেন দিল্লির দাদ্রী এলাকার উপেন্দ্র রানা। তার উদ্দেশ্য হল ইতিহাসকে "সংশোধন করা"। তার গানে হিন্দু যোদ্ধাদের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করা হয়েছে এবং মুসলিম শাসকদের খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। স্কুলে ইতিহাসের বইয়ে যা পড়ানো হয় সেনিয়ে তার কথা হচ্ছে, "অনেক সত্যি কথা আছে যা লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং আমাদের উপর মিথ্যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।"

রানা বলছেন তিনি তার ইউটিউব ভিডিও থেকে মোটামুটি নিয়মিত অর্থ উপার্জন করেন। তিনি হাত তুলে ঘরের দেয়ালে টাঙানো 'ইউটিউব সিলভার প্লে বাটনের' দিকে ইঙ্গিত করে বলছিলেন, "আমরা ভারতের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা এনে দিচ্ছি। ইউটিউব ডলারে অর্থ পরিশোধ করে।" দেয়ালে আরও রয়েছে হিন্দু যোদ্ধাদের প্রতিকৃতি।

যখন থেকে রানা ভক্তিমূলক এবং রোমান্টিক গান রচনা বাদ দিয়ে "ঐতিহাসিক" অভিব্যক্তিমূলক গানে চলে এসেছেন, তখন থেকেই তিনি দাদ্রী এলাকায় এক ধরণের তারকা হয়ে উঠেছেন। ইউটিউবে তার প্রায় চার লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে এবং তার অনেক গান লক্ষ লক্ষ বার দেখা হয়েছে। রানা বলছেন একটি মিউজিক ভিডিও তৈরি করতে তার খরচ হয় মাত্র চার হাজার রুপি। ভিডিও রেকর্ড এবং সম্পাদনা করার জন্য তার নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে, ক্যামেরাপারসন এবং ভিডিও এডিটর দল রয়েছে।

নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলছেন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সঙ্গীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহারের প্রবণতা অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি ১৯৮৯ সালে অযোধ্যায় ডানপন্থী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিতর্কিত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দেন। যার পরিণতি ছিল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের ধ্বংস। "এর ঠিক আগে, অডিও টেপের একটি শিল্প গড়ে উঠেছিল। যাতে থাকতো রামের জন্মভূমি সম্পর্কিত ধর্মীয় গান এবং উস্কানিমূলক স্লোগান। এই টেপগুলি মানুষকে সংগঠিত করতে বিভিন্ন মিছিলে বাজানো হত।"

হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে অযোধ্যা রামের জন্মস্থান। তিন দশক পরে এসে সেই একই ধরনের গানের সুর যেন আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। "যদি আপনি ভারতে বাস করতে চান তবে বন্দে মাতরম বলতে শিখুন"। "তোমার সীমার মধ্যে থাকতে শেখো"। "হিন্দুদের দুর্বল মনে করা শত্রুর ভুল"। এসব গানের প্রচারণায় তারা কাকে টার্গেট করছে তা লুকানোর কোন চেষ্টাও করছে না। এই গানগুলি ডানপন্থী সংগঠনগুলিকে কর্মী জড়ো করতেও সাহায্য করেছে৷ "তরুণরা এই গানগুলি পছন্দ করে কারণ এগুলো তাদের উৎসাহ দেয় এবং মনোবল বাড়ায়," বলছেন পিঙ্কি চৌধুরী, যিনি ডানপন্থী হিন্দু রক্ষা গোষ্ঠীর প্রধান৷ তার মতে, এই ধরনের গান তরুণদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে সাহায্য করে।

এই গানের একজন ভক্ত, ললিতকলার ছাত্র ২৩ বছর বয়সী বিজয় যাদব বলছিলেন, "আমি যখন এই গানগুলি শুনি তখন আমি হঠাৎ এক ধরনের তেজ অনুভব করি। এই গানগুলি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে এক সময় আমরা কিসের শিকার হয়েছিলাম এবং আমরা এখন কোথায় পৌঁছেছি।" যে তেজের কথা তিনি বলছিলেন, সম্ভবত সেই তেজের প্রদর্শন হয়ে গেছে গেল এপ্রিল মাসে যখন ভারতের কয়েকটি প্রদেশে হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের সময় সহিংস সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল।

সেসময় হিন্দুরা যখন ধর্মীয় মিছিল বের করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার কাছাকাছি চলে যাচ্ছিল তখন লাউডস্পিকারে শোনা যেত এই সঙ্গীত। তখন কয়েকটি সংঘর্ষ উসকে দেবার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল ২০১৬ সালে রচিত সন্দীপ চতুর্ভেদীর গানসহ একই ধরনের গান। চতুর্ভেদী অবশ্য এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার ভাষায়, "আমি শুধু আমার গানের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করার চেষ্টা করছি। ভালোবাসা থেকে কিছুই আসে না। আমাদের যা আছে তা ছিনিয়ে নিয়ে লড়াই করতে হবে।" সূত্র: বিবিসি।

 



 

Show all comments
  • ABU ABDULLAH ৮ আগস্ট, ২০২২, ৯:৪০ পিএম says : 0
    আমাদের দেশে হিন্দু বিদ্বেষী সংগীত লিখা যায়না ?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সঙ্গীতের উত্থান
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ