Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভালো নেই খুলনার বেসরকারি পাটকল

খুলনার শিল্পাঞ্চল : ভাঙা-গড়ার করুণ উপাখ্যান

আবু হেনা মুক্তি | প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, -০০০১, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:২১ এএম, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

খুলনাঞ্চলের শিল্প-সাম্রাজে ঐতিহ্যেও সোপান হচ্ছে পাট। অর্থায়নের এই সম্ভাবনাময় খাতটির দৈন্যদশা কাটাতে বর্তমান সরকার বাস্তবমুখী একটি রোডম্যাপ নিয়ে এগোচ্ছে। অন্যদিকে ভালো নেই খুলনার বেসরকারি পাটকলগুলো। গত ৩ বছর যাবত অ্যাজাক্স ও মহাসীন জুট মিল বন্ধ। এ দু’টি মিলের স্থায়ী ও অস্থায়ী ৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বেসরকারি খাতের জ্যেষ্ঠ পাটকল সোনালি জুট মিলের মেরুদÐ আজ চরমভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। ৭ হাজার শ্রমিকের এই মিলে এখন কাজ করে ৯শ’ শ্রমিক। পাটকল মালিকরা এখান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসায় লগ্নি করে মিলগুলোতে লালবাতি জ্বালিয়েছে বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশ আর সমস্যা ও সম্ভাবনার সামঞ্জস্য করে উৎপাদনমুখী একটি সমন্বিত প্রকল্পের বাস্তবায়নের প্রয়াস। সরকারের দ্বিতীয় দফার এই তিন বছরের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সেক্টরকে চাঙ্গা করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ অঞ্চলের মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। শিল্পাঞ্চলের মানুষের চোখে-মুখে নতুন সকালের সূর্য যেন উদয়ের অপেক্ষায়। মাত্র দুই যুগে পাটশিল্প হয়ে উঠেছিল দেশের মর্যাদার প্রতীক আর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান অবলম্বন। স্বাধীনতার পর থেকে ভুল নীতি প্রণয়ন আর অব্যবস্থাপনার কারণে সেই শিল্পই হয়ে উঠল বিপুল লোকসান কবলিত জাতীয় বোঝা। আর এখন পাটশিল্প হয়ে উঠেছে জাতীয় দুঃখ আর বেদনার প্রতীকে। পাটশিল্প যেন এদেশের নদ-নদীর জোয়ার-ভাটার সূত্রই মেনে চলছে। বর্তমান সরকার সব নিরাশা আর হতাশাকে কবর দিয়ে লাখ লাখ মানুষের রুটি রুজির নিশ্চয়তা প্রদানে এ সেক্টরকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে কাজ করছে। তবে খুলনাঞ্চলের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা হচ্ছে আরো দ্রæত এই কর্মকাÐের বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর সাথে হাজার হাজার পরিবারের ভাগ্য জড়িত।
জানা গেছে, পাটকলগুলো তদারক, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) গঠন করা হয়। ওই সময় বিজেএমসির আওতায় ৮২টি পাটকল রাখা হলেও ১৯৭৭-৯৬ সালের মধ্যে ৪৪টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে সরকারি ৩৮টি পাটকলের মধ্যে ১৯৯৩ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ১১টি এবং ২০০২ সালে আদমজী জুট মিল বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে সরকারি পাটকলের সংখ্যা ২৬টি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব মতে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থ-বছরে দেশের মোট রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান, যা বর্তমানে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৪-১৫ অর্থ-বছরে রফতানি আয়ে পাটের অবদান মাত্র ৮৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। বাংলাদেশ থেকে মূলত ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ডসহ আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটপণ্য রফতানি হয়।
সূত্র মতে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এ কালের পূর্ববাংলা, তারপর পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমানের বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রায় ৮০ ভাগ পাটের উৎপাদনকারী। তবুও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাট ব্যবসার উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল হিন্দু মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের। পাটকলের সমস্তটাই ছিল কোলকাতার আশপাশ এবং বর্তমান পশ্চিম বাংলা এলাকায়। ভারত বিভাগের পর শুরু হয় পাট শিল্পের পটপরিবর্তন। পশ্চিম বাংলার পাটকল পাটের অভাবে বন্ধ হতে থাকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে উঠতে থাকে পাটকল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে লক লক করে বেড়ে উঠে পাটশিল্প। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠে পাটের রমরমা মোকাম। ভৈরব নদীর যোগাযোগ সুবিধা এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত চালনা (বর্তমানে মংলা) বন্দর দিয়ে রপ্তানির সুযোগ নিয়ে খুলনা হয়ে উঠে দেশের পাটশিল্পের বড় কেন্দ্র। ভৈরব নদীর ধার ঘেঁষে খালিশপুরে স্থাপিত হয় ক্রিসেন্ট জুট মিল, পিপলস জুট মিল, পাটিনাম জুবিলী জুট মিল ও দৌলতপুর জুট মিল। নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে দিঘলিয়া উপজেলার চন্দনীমহল নামক স্থানে স্থাপিত হয় স্টার জুট মিল। খুলনা আটরা ও শিরোমনি এলাকায় স্থাপিত হয় ইষ্টার্ন জুট মিল, আফিল জুট মিল, মহসেন জুট মিল, সোনালি জুট মিল ও এজাক্স জুট মিল। মিলগুলোর মধ্যে প্রথমে ১৯৫২ সালে স্থাপিত হয় দি ক্রিসেন্ট জুট মিলস্ লিঃ এবং পিপলস্ জুট মিল লিঃ। স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুর আগে ১৯৬৮-৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীম এবং মহসেন জুট মিল। সকল মিলই প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যক্তি মালিকানাধীনে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মিলগুলো চলে ভালোভাবেই। প্রায় সবগুলো মিলের স¤প্রসারণ হয়। আরো স¤প্রসারণ করার জন্য জায়গা ক্রয় বা নির্ধারিত করা হয়। কিন্তু অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং পরবর্তীর স্বাধীনতা সংগ্রাম স¤প্রসারণের সুযোগ নস্যাৎ করে। পাটকলগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হলো। গঠন করা হলো বাংলাদেশ জুট মিলস্ কর্পোরেশন (বিজেএমসি)।
সূত্র মতে, বিজেএমসি’র কর্মকর্তা এবং মিল ম্যানেজাররা মিল পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পর্যায়ক্রমে ব্যর্থ হন। অদক্ষ পরিচালনা, সর্বগ্রাসী লুটপাটের কারণে মিলগুলো লোকসান দিতে থাকে। তবে স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৪-৮৫ সাল পর্যন্ত জুটমিলগুলোতে লাভ হয় বলে জানা গেছে। মিল সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে পাট উঠতে থাকে। মৌসুমের শুরুতে যখন দাম তুলনামূলক কম থাকে ও মানসম্পন্ন পাট বাজারে থাকে তখন ক্রয়ের জন্য প্রস্তুত থাকাই নিয়ম। কিন্তু আগাগোড়াই এ ব্যাপারে ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। পাট উঠতে শুরু করলে বিজেএমসিতে ফাইল চালাচালি শুরু হয়। এসময় অবশ্য পাট ব্যবসায়ীরাও ব্রিফকেস নিয়ে বিজেএমসি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে মোলাকাত করেন। বিজেএমসি প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেল হয়ে যখন পাট কেনার টাকা ছাড় করে ততদিনে সমুদয় পাট চলে যায় পাট মহাজনদের গুদামে। সেখান থেকে ভালো মানের পাট রপ্তানি হয়ে যায় ভারতসহ অন্যান্য দেশে। পরে জুট মিলগুলো দু’গুণ-আড়াই গুণ দামে নি¤œমানের পাট কিনতে বাধ্য হয়। মিলে লোকসান হয়েছে দু’দিক দিয়ে। এছাড়া মিলের কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা ও এলাকার দলীয় প্রভাবশালী লোকেরা যোগসাজশ করে অস্তিত্বহীন শ্রমিকের নামে কাজ এবং ভুয়া ওভার টাইম দেখিয়ে অর্থ ভাগাভাগি করে। মিলের যন্ত্রাংশ কেনাকাটায় হয় লুটপাট। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ নি¤œমানের অথবা নকল কিনে কাগজপত্রে উন্নতমানেরটি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। অনেক সময় প্রয়োজন নেই, অর্থ লুটপাটের অসৎ উদ্দেশ্যেই যন্ত্রাংশের কেনাকাটা করা হয়েছে। মিলের লোকসানের অন্যতম আরেকটি সূত্র ব্যাংক ঋণের সুদ। ক্রমাগতভাবেই লোকসান দানকারী মিলসমূহ ব্যাংক ঋণ পরিশোধে বিরত থাকে। সুদ-আসল মিলে সে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন বিশাল অংকের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে মিলগুলোর লোকসানের পরিমাণই কেবল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮১ সালের পর সরকার জুট মিল ব্যক্তিমালিকানায় ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করে। এ প্রক্রিয়ায় খুলনার আফিল, মহসেন, সোনালি এবং এজাক্স জুট মিল পূর্বতন মালিকদের কাছে ফেরত দেয়া হয়। তবে বৃহদাকার অধিকাংশ মিলের মালিক অবাঙালি হবার কারণে সেগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি। লোকসান এবং জোড়াতালি দিয়ে সেগুলো চালানো হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাটকল

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ