সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি ১ দশমিক ৬ শতাংশ
অর্থনৈতিক রিপোর্টার : সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ বলে জানিয়েছে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল
মনিরার বয়স পঁয়ত্রিশ। আরও পনেরো বছর আগে তার বিয়ে হয়েছে ইউসুফের সাথে। ইউসুফ রাজমিস্ত্রি। মানুষটা খুব ভালো। দয়ার শরীর। মনিরার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বাসায় ফেরে। গপাগপ কয়টা খেয়ে শুয়ে পড়ে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে কাদা। মনিরার সাথে দুদ- গল্প করার সময়ও নেই। তবুও মনিরার কোনো অভিযোগ নেই। লোকটার জন্য তার খুব মায়া হয়। দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে মনিরার সুখের সংসার। হঠাৎ একটা স্বপ্ন তার জীবনে ঝড় তুলে দিল। ধূলিঝড়। ধূলি উড়িয়ে তার ধুলাচ্ছন্ন অতীত বের করে ফেলল। তার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল মনিরা। তার কান্নার গমকে ইউসুফের ঘুম ভেঙে গেল। গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘কাঁদ কেন মনিরা? কী হয়েছে?’ এ কথা শুনে কান্নার গমক আরও বেড়ে যায়। শান্ত হওয়ার পর মনিরা বলল, ‘সে তার মাকে স্বপ্নে দেখেছে। তার মা খুব কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার খুব দুর্দিন। দেখার কেউ নেই। তুমি এসে দেখে যাও।’ ইউসুফ ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। মনিরা আরেক দিন বলতে চেয়েছিল তার অতীত। ইউসুফ শোনেনি। আজ সব বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছে। মনিরা গড় গড় করে বলতে লাগল তার ফেলে আসা অতীত :
‘দুই বোন আর মাকে নিয়ে আমাদের খুব ছোট্ট সংসার ছিল। মা মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করত। আমরা দুবোন মাঝে মাঝে মানুষের ফাই-ফরমাশ খাটতাম। কোনো রকমে সংসার চলে যেত। মা সারা দিন মানুষের বাড়িতে কাজ করে, একটু বাসি ডাল, একটু বাসি তরকারি আর একটু ঠা-া ভাত নিয়ে বাড়ি ফিরত। আমরা গবগব করে খেয়ে নিতাম। তারপর ছোট্ট একটি খাটে জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম। প্রায় প্রতিদিন মা ঘুমাতে যাওয়ার আগে গীত গাইত। মার গীত শুনে আমাদের চোখে পানি এসে যেত। তখন নিজেদের মনে হতো রাজকন্যা। মা আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখাত। বলত, ‘দেখিস একদিন আমাদের কোনো অভাব থাকবে না। তোরা একটু বড় হলে আমি একটা দোকান দেব।’ আমাদের মনে ধনী হওয়ার এই স্বপ্নটা সব সময় উঁকি দিত। আমরা সব কষ্ট ভুলে থাকতাম। মা চলে যাওয়ার পর আমরা দুবোন খড়ি টোকাতাম। মাঝে মাঝে এর-ওর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। আমার বড় আপুর নাম ছিল মহুয়া। মহুয়া আপু আমাকে হাজি বাড়ির পুকুরে ঢলে ঢলে গোসল করিয়ে দিত। পুকুরটা ছিল অনেক বড়। একপাশে একটি মাথাভাঙা তালগাছ ছিল। লোকমুখে শুনতাম, তাল গাছটা নাকি একসময় আকাশছোঁয়া ছিল। ঠাঠা পড়ে মাথা ভেঙে গেছে। এরপর থেকে এ গাছের নাম হয়েছে মাথাভাঙা তালগাছ। আশপাশের লোকজন এ নামেই চিনত। আরেক পাশে ছিল মস্তবড় বটগাছ। ভরদুপুরে ঝিরঝিরে বাতাসে বটের পাতা যখন নড়ত, পুকুরে আলো-ছায়ার এক সুন্দর আলপনার সৃষ্টি হতো। আমাদের খুব ভালো লাগত। বটের ঝিলিমিলি ছায়ায় শানবাঁধানো ঘাটে আমরা বসে থাকতাম। একদিন আপু বলল, ‘চল, বান্নিমেলা দেখে আসি।’ আমাদের বাড়ি থেকে এ মেলা অনেক দূরে। মাকে না জানিয়ে আমরা দুবোন মেলা দেখতে গেলাম। মেলায় ঘুরে ঘুরে আমরা ক্ষুধার্ত হয়ে গেলাম। মেলার এক কোনায় এক লোক মাটির হাতি, ঘোড়া, গরু আর মহিষ নিয়ে বসে আছে। গরুটা কি সুন্দর! ইচ্ছে করছিল গরুটা একটু ছুঁয়ে দেখি। আমাদের হাতে কোনো পয়সা ছিল না বলে ছুঁয়ে দেখতেও ভয় পাচ্ছিলাম। আমি অপলক গরুটার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি আপু নেই। অনেক খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। আমি এক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। এদিকে রাতও হয়ে আসছিল। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে আমার পাশে দাঁড়াল। একজন ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘কাঁদছ কেন।’ আমি বাঘে দৌড়ানো হরিণের মতো জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। কাঁদতে কাঁদতে হিক্কা উঠছে। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। খুব আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘যাবে আমার সাথে? সুন্দর জামা কিনে দেব। খেলনা দেব। তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।’ আমি লোকটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে মোটামুটি জোর করেই গাড়িতে উঠাল। বনবন করে গাড়ি ছুটছে। আমি আমার পৃথিবী ছেড়েÑ দূরে, বহু দূরে চলে যাচ্ছি। যেতে যেতে অনেক রাত হয়ে গেল। গাড়ি বড় এক অট্টালিকার সামনে থামল। আলিশান বাড়ি। বাড়ির সব কিছুই দামি। বাড়ির এক কোনায় পড়ে থাকি আমি। কোনো কিছুর অভাব নেই আমার। কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ভালো লাগে না। হাজি বাড়ির পুকুর, বটের ঝিলিমিলি ছায়াÑ আমাকে ভালোবেসে ডাকে। কান পাতলেই তাদের ডাক শুনতে পাই। বাড়ির ছাদে উঠি কাপড় শুকাতে। নিচের দিকে তাকিয়ে ঢাকা শহর দেখি। মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ আর শুধু দালান আর দালান। আমার তখন মনে হয়Ñ আমার যদি পাখির মতো ডানা থাকত! উড়াল দিয়ে আমার মায়াময় গ্রামে চলে যেতাম। কতদিন বাড়ির বড় কর্তাকে বলেছিÑ আমাকে মা’র কাছে নিয়ে চলেন। তার সময় হয় না। তাছাড়া একটু ভয়ও পায়। আমাকে নিয়ে গিয়ে আবার কোন ঝামেলায় পড়ে যান। তাই আর যাওয়া হয় না। একদিন বাড়ির কর্ত্রী আমাকে অনেক মারেন। আমি এত কাজ করি, তবুও এত নিষ্ঠুর আচরণ! আমি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। সারা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। এত বড় বড় দালান আমার কোথাও ঠাঁই নেই! ভাবলাম বাসাবাড়িতে আর কাজ করব না। কিন্তু ঘরের বাইর হলে মেয়েদের পদে পদে বিপদ। তারপর দেখা হলো তোমার সাথে। তার পরের ঘটনা তো তুমি জানোই। সেই যে শৈশবে শেকড়ছাড়া হলাম, আর শেকড়ের সন্ধান পেলাম না। বলে দর দর করে কাঁদতে লাগল।’
মনিরার কান্না ইউসুফকে স্পর্শ করে। কতদিন সে তার আপনজনদের দেখে না! তার আপনজনতো তারও আপনজন। সে কী করেছে তার জন্য? নিজের ওপর রাগ হয়। কিন্তু কীভাবে খুঁজে বের করবে? সে তো কিছু বলতে পারে না। বটের ঝিলিমিলি ছায়া। হাজি বাড়ির মাথাভাঙা তালগাছ। পুকুরে পোনা মাছের ঝাঁক ধরে চলা। শুধু এই-ই মনে আছে।
তবুও ইউসুফ থেমে যায় না। ফেসবুকের মাধ্যমে শুরু হয় সেই মাথাভাঙা তালগাছ খোঁজা। দিন যায়। মাস যায়। বছর যায়। হঠাৎ একদিন হদিস পায় সেই তালগাছের। জামালপুর জেলার খড়খড়িয়া গ্রামে। একদিন মনিরাকে নিয়ে ইউসুফ চলে যায় সে গ্রামে। সেই পুকুর পাড়ে। তালগাছটা এখনো কলঙ্ক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাটের একটা অংশ ভাঙা ছিল। সেটা এখনো ভাঙাই আছে। সবুজ শ্যাওলা জমে আছে। পানির কাছে একটা সিঁড়িতে বসল মনিরা। আস্তে আস্তে অনেক কিছু মনে পড়তে লাগল। তাদের দেখে একে একে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেল। ইউসুফ দু-একজনের সাথে বিষয়টা শেয়ার করল। হাজি বাড়ির শ্যামলের মা মনিরাকে চিনেই ফেলল। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। মনিরা ফিরে এসেছে। হই হই রই রই ব্যাপার। মনিরাকে তার মা’র কাছে নেওয়া হলো। ছোট্ট একচিলতে স্যাঁতসেঁতে উঠুন। কেঁচুই মাটি তোলা। একপাশে এলোমেলো কয়টা ভেন্নাগাছের চারা। ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরা মনিরার মা, উদোম কুঁজোপিঠে বসে আছে। পায়ের কাছে তল্লাবাঁশের লাঠি। এ লাঠিতে ভর দিয়েই এঘর-ওঘর যায়। চোখে তেমন একটা দেখে না। মানুষের হল্লা শুনে বাড়িতে ঢোকার রাস্তার দিকে তাকাল। একজন দৌড়ে গিয়ে বলল, ‘অ মহুয়া মাও, তোমার মনিরা ফির্যা আইছে।’ মনিরার মা’কে বিস্মিত মনে হলো না। মনে হয় তার জন্য সে অপেক্ষা করে আছে। মনিরা মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। মনিরার মা’ও কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘সে দিন স্বপ্নে দেখি তুই আইছর। এরপর থেকে ভেবেছি, তুই নিশ্চয় আসবি। আল্লাহ একজন আছেন। নইলে তোকে খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। উনিই সব ঘটান।’ দুজনের চোখের পানি একই ধারায় প্রবাহিত হতে লাগল। এ কান্না কিসের? আনন্দের না বেদনার?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।