বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর হাতে মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় সংখ্যালঘু মুসলিম রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম।
দিন দিন মিয়ানমারে চরম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা। প্রকাশ্যে কুপিয়ে বা জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটছে দেশটিতে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। রাখাইন প্রদেশে গত রোববার অন্তত ৯ জন রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সম্প্রতি তা প্রকাশ পাওয়ায় সমালোচনা এখন তুঙ্গে। শুধু মংড়ুর একটি গ্রামে এখন পর্যন্ত ৯০ জন নারী-পরুষ-শিশু নিখোঁজ রয়েছে বলে খবর দিয়েছে বিবিসি।
খবরে বলা হয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানসমর্থিত ‘রোহিঙ্গা ভিশন’ নামে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা এক ভিডিও চিত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আগুনে পোড়া কয়েকটি মরদেহ এবং এগুলোকে ঘিরে তাদের স্বজনরা আর্তনাদ করছে।
এদিকে রাখাইন রাজ্যের কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালাতে মুসলিমবিরোধী একটি মিলিশিয়া গ্রুপকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে এমন খবর প্রচারের পর প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। নাফ নদী পার হয়ে অবৈধভাবে কক্সবাজারের টেকনাফে প্রবেশের চেষ্টাকালে ১২৫ রোহিঙ্গাকে আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদস্যরা।
আর জাতিসংঘ বর্তমান মানবিক পরিস্থিতিকে ভয়াবহ উল্লেখ করে, রাখাইন রাজ্যে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ পাঠানোর অনুমতি দিতে বলেছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইনে এক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন হাজার হাজার মানুষ। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যে কোনো ছুঁতোয় দেশটির রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করে না। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর এমন নৃশংস ও অমানবিক হত্যা এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেও মিয়ানমার সরকার তা থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। দেশটির সরকারের আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা দূরে থাক মানুষ বলেই মনে করে না সরকার। তার সর্বশেষ জনসংখ্যা জরিপে রোহিঙ্গাদের মূল নাগরিকের বাইরে ‘আদারস’ বা ‘অন্যান্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা উদ্বাস্তু ও ভাসমান। অবশ্য দেশটির সরকার সবসময়ই মনে করে আসছে, রোহিঙ্গারা নাকি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা বাঙালি। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যুগের পর যুগ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে অভিযান চালিয়ে আসছে। এতে নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্বল ফেলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তাদের কক্সবাজারসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ভরণ-পোষণেরও দায়িত্ব নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বহুবার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয়া হলেও মিয়ানমারের আচরণে অনেকটা উদাসীনতা ও অনীহা ফুটে উঠেছে। অথচ ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা। তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
দুঃখের বিষয়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকার করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গা নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। এর সাথে যুক্ত হয় উগ্রবাদী বৌদ্ধগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধগোষ্ঠী স্ট্রিম রোলার চালাতে থাকে এবং এখনো চালাচ্ছে। এই নিপীড়ন, বিতাড়ন ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার। এমনকি গণতন্ত্রের জন্য আজীবন সংগ্রাম করা অং সান সুচিও এব্যাপারে নিশ্চুপ। ক্ষমতায় আসার পর সমালোচনার মুখে পড়ে কয়েক মাস আগে মুখ রক্ষার্থে অনেকটা দায়সারাভাবে রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা দেন তিনি। তাতেও রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এখন আবার ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার’ তকমা লাগিয়ে হত্যাযজ্ঞকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পরবাসী করার বা অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেয়ার বিষয়টিকে বৈধতা দেয়ার পথ অবলম্বন করা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গাদের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে এটাই পরিদৃষ্ট হয়, পৃথিবীতে বসবাস করার জন্য তাদের পায়ের নিচে কোনো মাটি নেই। তারা ভাসমান। বিশ্বে এমন জাতিগোষ্ঠী আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। মানবতার এমন বিপর্যয় এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার এমন দৃষ্টান্ত বিশ্বে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া ভার।
রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে যে হামলা ও পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তা নিন্দনীয়। তবে এ হামলায় কে বা কারা জড়িত তা এখনো স্পষ্ট নয়। কোনো গোষ্ঠীও এখন পর্যন্ত হামলার দায় স্বীকার করেনি। এমতাবস্থায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষী ও সেনাবাহিনী যেভাবে রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা কোনো যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সঠিক তদন্ত ও হামলাকারীদের শনাক্তকরণ ছাড়া তারা যেভাবে রোহিঙ্গাদের উপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে রোহিঙ্গা নিধনের উসিলা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বলা হচ্ছে, অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিনা অপরাধে বা যে কোনো ছুঁতোয় যদি কারো উপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হয়, তবে জীবন বাঁচাতে আক্রান্তদেরও প্রতিরোধ করার অধিকার রয়েছে। আমরা মনে করি, পুলিশ ফাঁড়িতে কারা কী কারণে হামলা চালিয়েছে, আগে তার যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন। তা না করে এর দায় পুরো রোহিঙ্গা জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই সঙ্গত নয়, উচিতও নয়। আমরা আশা করব, মিয়ানমার সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমনাভিযান বন্ধ করবে, এ ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো যে আহ্বান জানিয়েছে, তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করবে।
মানুষ মানুষ নয়, কেউ কেউ মানুষ। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর ও অমানবিক কর্মকা- দেখে এমন উপলব্ধি খুবই সঙ্গত। বিশেষ করে আমাদের পাশের দেশ মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান চলছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণের সাথে সাথে তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংগঠনগুলো কিছু কথাবার্তা বললেও বিশ্বের প্রতাপশালী রাষ্ট্রগুলো নীরব। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কিছু মানুষের জীবন খুবই মূল্যবান, আর অনেক মানুষের জীবনের কোনো দামই নেই। আলো ঝলমলে ও বিজ্ঞানমনষ্ক বর্তমান পৃথিবীতে এমন বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা কেমন করে চলছে তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। এক সময় ভাবা হতো মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক জান্তার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর অকথ্য জুলুম-নির্যাতন চলতে পারছে। গণতন্ত্রমনা নেত্রী অং সান সুচির ব্যাপারে অনেকে আশাবাদী ছিলেন। তারা ভেবেছিলেন ক্ষমতার পরিবর্তন হলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জীবনে মুক্তি আসতে পারে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল তো হলো কিন্তু রোহিঙ্গাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন এলো না। মন-মানসিকতায় অং সান সুচিও উদারতার পরিচয় দিতে সক্ষম হননি। বরং তার মধ্যেও মুসলিম বিদ্বেষ কাজ করছে।
অং সান সুচির মুখোশ ক্রমেই উন্মোচিত হচ্ছে। ফলে তার কৃত্রিম ইমেজের পালকও খসে পড়ছে। সুচির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইন আবেদনে ইতোমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার ব্যাপারে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এই আবেদন জানানো হয়। নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি, যারা এ পুরস্কার দেয় তাদের প্রতি আবেদনে এ পুরস্কার প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া থেকে চেঞ্জ ডট অরগে এই আবেদনটি করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক শান্তি এবং ভ্রাতৃত্ববোধ রক্ষায় যারা কাজ করেন তাদেরই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। সুচির মতো যারা এই পুরস্কার পান তারা শেষদিন পর্যন্ত এই মূল্যবোধ রক্ষা করবেন এটাই আশা করা হয়। যখন একজন নোবেল শান্তি বিজয়ী শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ হন তখন শান্তির স্বার্থেই নোবেল শান্তি কমিটির উচিত এই পুরস্কার হয় জব্দ করা, নয় ফিরিয়ে নেয়া।’
লক্ষাধিক মানুষের অং সান সুচির নোবেল প্রত্যাহারের দাবিটি গণমাধ্যমে গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে। নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে সঙ্গত ভূমিকা পালনে সুচি ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ অবাক হয়েছে। সুচি যে ইমেজ সংকটে পড়ে গেছেন তা তিনি এবং তার দল কতটা উপলব্ধি করতে পারছেন তা আমরা জানি না। তবে লক্ষাধিক মানুষ তার নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের যে দাবি জানিয়েছেন তা তিনি এড়িয়ে যাবেন কেমন করে? বিষয়টি যে শুধু তার নিজের এবং দলের জন্য ক্ষতিকর তা নয়, মিয়ানমার নামক রাষ্ট্রের জন্যও তা কলঙ্কজনক। আর দেশে-দেশে যদি সংখ্যালঘু মানুষদের প্রতি জুলুম-নির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অমানবিক কর্মকা- চলতে দেয়া হয়, তাহলে এ পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকবে কেমন করে?
লেখক : সদস্য নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল ও সভাপতি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।