পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আমানউল্লাহ, নজির হোসেন, শামসুদ্দিনসহ ৯ জন জেলে মাত্র দু’দিন আগে গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে এসেছেন। তবে সামুদ্রিক মাছ নিয়ে নয়। রীতিমত মৃত্যুর দুয়ার থেকে তারা ফিরেছেন। গতকাল (বুধবার) কর্ণফুলীর মোহনায় ফিরিঙ্গিবাজার ফিশারি ঘাটে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনজনই জানান, গত সোমবার ভোরে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলের বিপরীত দিকে গভীর সাগরে তারা মাছ শিকার করছিলেন। সাগর তখন শান্ত। হঠাৎ তাদের ফিশিং ট্রলারের (দেশীয় ট্রলার) দিক বরাবর খুব কাছাকাছি এসে পড়ে একটি নৌদস্যুদের ট্রলার। প্রথমে মনে হয়েছিল তাদের মতো সাধারণ মাছ শিকারি ট্রলার। কিন্তু ধাওয়া করে এসে থামতে ইশারা করার ‘ধরন’ বুঝে নিশ্চিত হওয়া গেল, ওরা তো নৌদস্যু! তখন যত জোরে পারা যায় বিপরীত দিকে সাগরের বুকে ট্রলার চালিয়ে নিয়ে কুতুবদিয়া উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এসব জেলে। তারপর চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায় স্বজন-পরিজনদের মাঝে ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সাগরে নেভি ও কোস্টগার্ডের পর্যাপ্ত টহল-প্রহরা দিয়ে জেলে, মাঝি-মাল্লাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া অবধি আপাতত গভীর সাগরের দিকে মাছ শিকারে যাবেন না।
গত ক’দিনে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন স্থানে সামুদ্রিক ট্রলার নৌযানের জেলেরা নৌ দস্যুদের কঠোরভাবে দমন ও নিরাপত্তার দাবিতে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ সভা ও সমাবেশ ও মিছিল করেছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে স্মারক লিপিও দেয়া হয়। এদিকে বাংলাদেশ সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্র উপকূলভাগের আবহাওয়া বর্তমানে এই অগ্রহায়ণ মাসে এসে বেশ শান্ত রয়েছে। ইলিশ, চিংড়ি, রূপচাঁন্দা, লাক্ষ্যা, কোরাল, সুরমা, ছুরি, টুনা, পোয়া, লটিয়াসহ সব প্রজাতির অর্থকরী সামুদ্রিক মাছ শিকারের জন্য এখনই উপযুক্ত ও ভরা মৌসুম। শুটকি তৈরি করার জন্যও এখন মোক্ষম সময়। কিন্তু হেমন্তের স্বাভাবিক সাগরে, বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূলভাগ জুড়ে সশস্ত্র নৌদস্যুদের একেকটি গ্রুপ বেপরোয়া সন্ত্রাস, লুটতরাজের কালো থাবা বিস্তার করেছে। প্রতিদিনই সমুদ্র উপকূলের একাধিক জায়গায় নিরীহ সাধারণ জেলেদের ট্রলার, নৌযানের ওপর নৌদস্যুদের আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। খুন, আহত করা, গুম, অপহরণ, মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় চলছে ব্যাপকভাবে। জানমালের নিরাপত্তার সংকটে নিরীহ জেলেরা প্রতিনিয়তই রয়েছে চরম আতংকে। জেলেরা প্রাণ হাতে নিয়ে সাগরে গেলেই তাদের পরিবার-পরিজনরা থাকেন উৎকণ্ঠায়।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কক্সবাজার থেকে খুলনা পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলভাগে এবং এর বিপরীতে গভীর সাগরে নৌদস্যুরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। উপকূলে নৌদস্যুদের একের পর এক ঝটিকা হামলায় নিরীহ জেলেরা হতাহত হচ্ছে। সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসছে অনেকেই। সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে নৌদস্যুবাহিনী ট্রলার ও ইঞ্জিন সমেত জেলেদের অপহরণ করে লাখ লাখ টাকা অংকের মুক্তিপণ আদায় করছে। নৌদস্যুরা আচমকা জেলেদের উপর আক্রমণ চালিয়ে মাছ ধরার ট্রলার, ট্রলারের ইঞ্জিন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেল, মোবাইল ও রেডিও সেট, মাছ ধরার জাল, সাগরে আহরিত বিভিন্ন জাতের মাছ, নগদ টাকাসহ মূল্যবান সামগ্রী নির্বিচারে লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। দস্যুদের তা-ব দিন দিন বাড়ছেই। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অসহায় জেলেরা পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সমন্বয়ে সমুদ্র উপকূলের নিরাপত্তা বিশেষ করে নিয়মিত টহল দাবি করেছে।
মাছ শিকারি জেলে ও ট্রলার-নৌযান মালিকদের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের ‘এলিফেন্ট পয়েন্ট’ টেকনাফ-সেন্টমার্টিন পয়েন্ট থেকে মহেশখালী কুতুবদিয়া চ্যানেল, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, নোয়াখালীর হাতিয়া, রামগতি নিঝুমদ্বীপ, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা হয়ে খুলনার কাছে ‘হিরণ পয়েন্ট’ দুবলার চর, রায়মঙ্গল হয়ে সীমান্ত পয়েন্ট পর্যন্ত প্রধান সামুদ্রিক মৎস্য বিচরণ অঞ্চলের অভ্যন্তরে নৌদস্যুদের হামলা, লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। মৎস্যসমৃদ্ধ উপকূলভাগের একেকটি পয়েন্টে একেক নামের ‘বাহিনী’ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। এসব বাহিনীই সাগর বা উপকূলে জেলেদের ট্রলার নৌকায় আচমকা আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু লুটপাট করে নিচ্ছে। হতাহত ও অপহরণ করছে নিরীহ জেলে-মাঝি-মাল্লাদের।
বিভিন্ন এলাকায় গত দুই সপ্তাহে জেলেদের একশ’রও বেশি ট্রলার-নৌযান আক্রমণের শিকার হয়েছে। এতে করে কোটি কোটি টাকার মাছ ধরার সামগ্রী, আহরিত মাছ লুটপাট, বিপুল অংকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের অন্তত ৫০টি ট্রলার নৌযানে হামলা চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সামগ্রী লুট করা হয়েছে। তবে প্রত্যন্ত ও দুর্গম চর, দ্বীপ এলাকাগুলোতে সংঘটিত নৌদস্যুদের হামলা, লুটপাট ও অপহরণের অনেক ঘটনা প্রকাশ পায় না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নৌদস্যুদের অব্যাহত বেপরোয়া সন্ত্রাসে চর, দ্বীপাঞ্চল, উপকূলবাসী নিরীহ জেলেদের জানমালের নিরাপত্তার সঙ্কট প্রকট। টেকনাফ সেন্টমার্টিন শাহপরীর দ্বীপসহ কক্সবাজার উপকূল, কুতুবদিয়া মহেশখালী, চট্টগ্রামের বহির্নোঙ্গর থেকে শুরু করে আনোয়ারা, বাঁশখালী, সন্দ্বীপ চ্যানেল, হাতিয়া, রামগতি, রাঙ্গাবালি, নিঝুমদ্বীপ, ভোলা, চরফ্যাশন, বরগুনা, পাথরঘাটা, চরকুকরি মুকরি, সুন্দরবন, দুবলার চরাঞ্চল, রায়মঙ্গল এবং এর সংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের আশপাশ জুড়ে নৌদস্যুদের আক্রমণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নৌদস্যুদের উৎপাতের কারণে উপকূলের অসংখ্য জেলে পরিবার ছদ্ম-বেকার অবস্থায় দিন গুজরান করছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা উপকূলে, চর ও দ্বীপাঞ্চলে নৌদস্যুদের সাঁড়াশি আক্রমণের কারণে মাছ শিকার অনেকাংশে কমে গেছে। সামুদ্রিক মাছের আড়ত ও মোকামগুলো প্রায়ই খালি পড়ে থাকছে। রূপচাঁন্দা, লাক্ষ্যা, কোরাল, সুরমা, পোয়া, লটিয়াসহ সামুদ্রিক সব জাতের মাছের দাম আকাশছোঁয়া। গভীর সমুদ্রগামী মৎস্য শিকারি ট্রলার নৌযান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠন সূত্র জানায়, সংঘবদ্ধ নৌদসুরা নিরীহ জেলেদের উপর বেশিরভাগই হামলা চালানো হয়েছে জেলে নৌকাযোগে সাধারণ জেলেদের ছদ্মবেশে। উপকূলের কাছাকাছি খাঁড়ির গোপন জায়গায় ওঁৎ পেতে থাকা অবস্থান থেকেও তারা হামলা চালায়। কোনো কোনো জায়গায় একাধিকবারও জেলেরা হামলার শিকার হচ্ছে।
গভীর বঙ্গোপসাগর এবং উপকূলজুড়ে নৌদস্যুদের ব্যাপক অত্যাচারের ফলে চোরাচালানীদের এখন পোয়াবারো। এরা সুযোগ বুঝে ভারত ও মিয়ানমারে কোটি কোটি টাকার মাছ পাচার করছে। সাধারণ জেলেরা জানান, সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের ভরা মৌসুমে নৌদস্যুদের আক্রমণের কারণে অনেক জেলে গভীর সমুদ্রে যাবার সাহস পাচ্ছে না। জেলেদের জীবিকার পথ রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বর্তমান সময়ে বঙ্গোপসাগর ও এর সংলগ্ন সমুদ্র উপকূলভাগে চিংড়িসহ অর্থকরী যাবতীয় মাছ শিকারের জন্য একমাত্র সংকট বর্তমান নিরাপত্তাহীনতা। সাগরে মাছের ঘনত্ব ও বিচরণ বেশি রয়েছে এ ধরণের জায়গাগুলো টার্গেট করেই নৌদস্যুরা হামলা চালাচ্ছে স্থানীয় জেলেদের ট্রলার নৌযানে।
আরেকদিকে দেশের পানিসীমায় ভারত, মিয়ানমার ও ফিলিপাইন থেকে আসা অনুপ্রবেশকারী ট্রলারে ব্যাপকহারে মাছ চুরি, লোপাট হচ্ছে। ভারতীয় ও ফিলিপিনো নাবিকসহ ট্রলার আটক করা হয় কোস্ট গার্ডের ইতোপূর্বে পরিচালিত অভিযানে। বাংলাদেশের পানিসীমায় ইলিশ, চিংড়ি, রূপচাঁন্দা, লাক্ষা, কোরাল, সুরমা, পোয়াসহ মৎস্যসমৃদ্ধ একেকটি এলাকা টার্গেট করে অনুপ্রবেশকারী বিদেশি ট্রলার নৌযানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ লোপাট করা হচ্ছে। বিদেশি ট্রলারগুলো সচরাচর ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন হওয়ায় পানিসীমায় এসেই মাছ চুরি ও পাচার করে আবার দ্রুত সটকে পড়ে। দেশীয় জেলেদের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশকারী প্রতিবেশী দেশের নাবিকদের সহজে শনাক্তও করা যায় না। তাছাড়া প্রতিদিন কোটি টাকা মূল্যের ইলিশসহ বিভিন্ন জাতের মাছ নৌপথে সরাসরি ভারত ও মিয়ানমারে পাচার করে দিচ্ছে সংঘবদ্ধ মাছ চোরাকারবারীরা। এর বিনিময়ে আসছে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সর্বনাশা হরেক রকম মাদকদ্রব্য, ফরমালিন বিষ মেশানো রুই, কাতলা, মৃগেল মাছ। নির্বিচারে মাছ শিকারের পরিণতিতে বঙ্গোপসাগরে মাছের স্বাভাবিক মজুদ ফুরিয়ে আসছে। সাগরে মাছের বিচরণ ক্ষেত্রগুলোতে এখন আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না। ৫/৬ দিনের ট্রিপে গিয়ে জেলেরা অনেক সময় হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।