চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মেঝেতে পড়ে আছে নিথর দেহখানা! ঘরের ছোট্র বাচ্চাটি বাবার উপরে বসে চোখ খোলার চেষ্টা করছে। চুল টানে দাড়ি টানে বাবার সাড়া পেতে;কিন্তু বাবা তার দুনিয়ায় নেই- একথা তাকে কে বুঝাবে! জনম জননী শিয়রে বসা। বুকফাটা কান্না দেখে দুশমনও চোখ ঝরাবে। শক্ত দিলের বাবাও আজ পর পর ডুকরে উঠছে। ঘৃহকোণে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী। ভাই কাঁদছে বোন কাঁদছে পাড়া প্রতিবেশী সবার চোখে জল ঝরছে। মসজিদের মাইকে ঘোষণা চলছে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! জানাযা হাজির। চিরদিনের মতো চার তাকবির বলে শেষ সালাম দিয়ে বিদায় নিয়েছে এলাকাবাসী। এবার কবরে দেওয়ার পালা। কী করুণ দৃশ্য! সুরম্য অট্রালিকা, আরামের গালিছা, বাহারী সাজ-পোষাক সবকিছু চিরদিনের মতো ফেলে রেখে তিন টুকরো সাদা কাপরে শেষ বিদায়! ডানে মাটি, বামে মাটি,মাটি আর মাটি! আহ! কী অসহায় আত্মসমর্পণ! সবার ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটবে। মৃত্যু কাউকে ছেড়ে কথা বলবেনা। এমনকি দায়িত্বরত ফেরেশতা আজরাইল আ: তিনিও মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবেন।
সে এক করুণ ইতিহাস! বিকট চিৎকারে বের হবে তাঁর রূহ! এখন তিনি এ সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাই কেউ রেহাই পাবেনা। ‘প্রত্যেকটা প্রাণিই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আল ইমরান-১৮৫)। ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেনো, মৃত্যু তোমাদের অবশ্যই পাকড়াও করবে; এমনকি সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরে থাকলেও।’ (সুরা নিসা-৭৮)। মৃত্যু কাউকে মেসেজ দিয়ে আসেনা। ‘যথাসময়ে আসে। এক মুহূর্তকাল আগপাছ হয়না।’ (সুরা আরাফ-৩৪)। এ এক চরম বাস্তবতা। সকলের সামনে থেকে আত্মাটা কেড়ে নেওয়া হয়। পাশে থাকা মানুষগুলো সেই দৃশ্য অসহায় হয়ে দেখতে থাকে। কারো কিছু করার থাকেনা। শুধু কি তাই? লোকটি বদকার হলে শুরু হয় প্রচন্ড মারপিট। এই মার মানুষের মার নয়; ফেরেশতাদের মার। শরীরের উপর নয়; আত্মার উপর হয়। ‘অত:পর কেমন লাগবে যখন ফেরেশতাগণ তাদের (বদকারদের)। চেহারা ও পিঠে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে?’ (সুরা মুহাম্মাদ-২৭)।
অন্যত্র এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে যখন যালিমরা মৃত্যুযন্ত্রণায় পড়বে এবং ফেরেশতাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে,‘তোমাদের প্রাণ বের করো’।’ (সুরা আনয়াম-৯৩)। লোকটি চিৎকার-চেঁচামেচি করে;কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পায়না। প্রশ্ন হয়, এতোসব আমরা দেখতে বা শুনতে পারিনা কেনো? তবে কি সব মিথ্যা? অবশ্যই না, এযে কোরআনের কথা হাদিসের কথা। দেখিনা শুনিনা সেটা ভিন্ন কথা অন্য কারণ। মৃত্যুকালীন অবস্থাটাকে ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নের সাথে তুলনা করা যায়। কারণ ঘুম এক প্রকার মৃত্যু। কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘তিনিই রাতে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিনে যা করো তা তিনি জানেন। তারপর আবার দিনে তোমাদের জীবিত করেন যাতে নির্ধারিত (হায়াত) সময় পূর্ণ হয়।’ (সুরা আনয়াম-৬০)। এজন্য ঘুমের আগে দোয়া করি- ‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহয়া’ তথা হে আল্লাহ, তোমার নামে মরছি তোমার নামেই জাগবো। আবার ঘুম থেকে জেগে প্রথমে বলি-‘আলহামদুলিল্লা হিল্লাযি আহয়ানা বা’দা মা আমাতানা ওয়া ইলাইহিন নুশুর’ বা সমগ্র প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি মৃত্যুর পর আমায় আবার জাগিয়েছেন। (বোখারি-৬৩১২)।
ঘুমের ঘোরে কতো ভয়ংকর স্বপ্ন মানুষ দেখে থাকে। সাপ দৌঁড়াচ্ছে, বাঘ আক্রমণ করছে কিংবা কোনো শত্রু মারার জন্য চেষ্টা করছে, আরো কতো কী দুঃস্বপ্ন মানুষ দেখে। কখনো চিৎকার করে কখনো কান্না করে। প্রচণ্ডরকম কষ্টও অনুভব হয়। কিন্তু কোনোদিন পাশে থাকা লোকটি তার কোনো অবস্থা দেখেছে বা বুঝেছে কিংবা তার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পেরেছে? মৃত্যুযন্ত্রণা বা মৃত্যুর ফেরেশতা দেখতে বা শুনতে পেলে কোনো মানুষ মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে থাকতো? ভয়ে দূরে পালাতো। কিংবা প্রতিকার করতে গিয়ে আল্লাহর আযাব ডেকে আনতো। তখন আল্লাহর পরীক্ষা বলে কিছু থাকতো না। সবাই আল্লাহকে মেনে নিতো। মানুষ পৃথিবীতে আসছে পরীক্ষা দিতে। সুতরাং এটাও একটি পরীক্ষার অংশ স্বরূপ। এতো ছিলো বদকারের কথা। নেককার হলে মারপিট হবেনা সত্য;কিন্তু ‘সাকরাতুল মাউত’ (সুরা কাফ-১৯)। অবশ্যই আসবে। তা থেকে কেউ রেহাই পাবেনা। এমনকি নবি-রাসুলগণও ইন্তেকালের সময়ের সাকরাতের কথা স্বীকার করেছেন। -ইয়াহইয়াউ উলুমিদ্দিন,ইমাম গাযালি রচিত গ্রন্থে রয়েছ, হযরত মুসা আ:-এর রূহকে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত করা হলে জিজ্ঞেস করা হয়- ‘হে মুসা, মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন অনুভব করলেন? উত্তরে তিনি বলেন, জীবন্ত পাখিকে উত্তপ্ত পানির ডেকচিতে ফেললে যেমন হয় তেমন অনুভব আমার হয়েছে।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, কোন কসাই জীবন্ত বকরির চামড়া তুলে নিলে যেমন, তেমন আমার অনুভব হয়েছে।’ আমাদের প্রিয়নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা: ইনতেকালের সময় বলতেছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ইন্না লিল মাউতি লাসাকারাত’ তথা মৃত্যুর রয়েছে তীব্র যন্ত্রণা। (বোখারি-৬৫১০)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, ‘মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে একটি পানির পাত্র ছিলো। তিনি তা থেকে একটু পর পর পানি নিয়ে মুখমন্ডল মুছতেন আর বলতেন, আল্লাহুম্মা আইন্নি আলা মুনকারাতিল মাউতি আউ সাকারাতিল মাউত’ তথা হে আল্লাহ, তুমি আমায় মৃত্যুযন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (তিরমিযি-৯৭৮)। ইমাম গাযালি রা: বলেন,‘রূহ কবয করার পক্রিয়া শুরু হয় মানুষের পায়ের পাতা থেকে। (কারণ রূহ শরীরের সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকে)। এরপর ক্রমান্বয়ে পায়ের গোছা, উরু হয়ে বক্ষদেশে এসে রূহ আটকে যায়। তখন লোকটি বাকশক্তি হারায়। এরপর ক্রমান্বয়ে কণ্ঠনালীতে রূহ পৌঁছায়। তখন দৃষ্টিশক্তিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে তখন বলা হবে কে তোমায় রক্ষা করবে? সে তখন নিশ্চিত হবে মৃত্যু অবধারিত। সেদিন পায়ের গোছার সঙ্গে গোছা জড়িয়ে যাবে।’ ( সুরা কিয়ামাহ:২৬-২৯ )। তাই পেয়ারা নবি (সা.)। ভালো ও সুন্দর মৃৃত্যুর জন্য এই দোয়া সব সময় পড়তেন-‘আল্লাহুম্মা আহসিন আকিবাতানা ফিল উমুরি কুল্লিহা ওয়া আজিরনা মিন খিযইদ দুনয়া ওয়া আযাবিল আখিরা’। আমীন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।