Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুশফিক-লিটন রূপকথা

স্পোর্টস রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০২২, ১২:০৫ এএম

ক্রিকেট রোমান্টিকদের মধ্যে যারা এই ম্যাচ দেখবে বলে স্টেডিয়ামমুখী হয়েছিলেন তাদের অনেকেই হয়তো তখনও ঢাকার বিরস জ্যামে আটকা। আর যারা সোয়াফ গা এলিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে খেলা দেখতে চেয়েছিলেন তাদের অনেকেই হয়তো টিভি সেটের রিমোর্ট নিয়ে ‘দেখি’, ‘দেখছি’ করে ঘুরাঘুরি করছেন এই চ্যানেল থেকে ঐ চ্যানেলে। এই অল্প সময়ের ব্যবধানে কতকিছুই না ঘটে গেল মিরপুরে! ম্যাচ শুরু হবার মাত্র ২৪ মিনিটেই ৬ ওভার ৫ বলে ৫ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ দলের রান ২৪! যারা স্টেডিয়ামে ছিলেন স্কোরকার্ডের এই ছবিটা এক টুকরো দুঃস্বপ্নই মনে হচ্ছিল তাদের! এই যেমন হোম অব ক্রিকেটের প্রেসবক্সে তখন বাংলাদেশ দলের সর্বনিম্ন রানে অলআউটের রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি শুরু হয়ে গেছে। তবে ‘মর্নিং শো’স দ্য ডে’ কথাটিকে উল্টো দিয়ে মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাসের রূপকথার গল্পের শুরুটা সেখান থেকেই।
চট্টগ্রাম টেস্টেও টপ অর্ডারে ছোট্ট ধসের পর লিটন-মুশফিকের ১৬৫ রানের জুটি বিপদমুক্তির পর বাংলাদেশের দাপুটে অবস্থান নিশ্চিত করেছিল। এবার ঢাকাতেও সেই জুটির সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রথম সেশনে বাজে শুরুর পরও শেষ পর্যন্ত শক্ত ভিত পেয়েছে। গতকাল ২৪ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর দিনভর লড়াই করলেন মুশফিক আর লিটন। ঐ ৫ উইকেট হারিয়েই বাংলাদেশের সংগ্রহ দিনশেষে ২৭৭। শতক পেয়েছেন দুজনই। লিটন ২২১ বলে ১৩৫ আর মুশফিকুর রহিম ২৫২ বলে ১১৫ রানে অপরাজিত। অবিচ্ছিন্ন ২৫৩ রানের জুটি গড়েছেন দুজনে। ষষ্ঠ উইকেটে যা বাংলাদেশের রেকর্ড।
অথচ কী দুঃস্বপ্নের মধ্যেই না শুরু হয়েছিল মিরপুর টেস্ট। দুই ওপেনারই খুলতে পারলেন না রানের খাতা। সাত ওভারের মধ্যে সাজঘরে প্রথম সারির পাঁচ উইকেট। এর আগে ২০১৮ সালে অ্যান্টিগা টেস্টে ১৮ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর নুরুল হাসান সোহানের সঙ্গে লিটনের জুটিতে এসেছিল ১৬ রান। তখন শঙ্কা ছিল একশর আগেই গুটিয়ে যাওয়ার। টাইগারদের এমন উদাহরণও ভুরিভুরি। কিন্তু এরপর বুক চিতিয়ে লড়াই করলেন লিটন ও মুশফিক। তাতে দিনের শেষটা হলো বর্ণিল।
খেলাটা যখন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে, কোনো অধিনায়কই টস হারতে চায় না। অনিশ্চয়তায় ভরা মিরপুরের উইকেটে কেউই চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। মুমিনুল হকও সেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ মাড়াতে চাননি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে টসে জিতেই ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। ওদিকে আগে ব্যাট করতে না পারার হতাশা লুকাননি লঙ্কান অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নেও। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর সেই দিমুথের চোখে মুখেই আনন্দের ঝিলিক। আর মুমিনুল? বাংলাদেশ দলের চার নম্বর ব্যাটসম্যান ততক্ষণে আউট হয়ে ফিরে গেছেন ড্রেসিংরুমে। তার আগে পরে আউট হয়েছেন টপ অর্ডারের আরও চার ব্যাটসম্যান। স্কোরবোর্ডে বাংলাদেশ দলের রান তখন ৫ উইকেটে মাত্র ২৪! শ্রীলঙ্কার দুই পেসার কাসুন রাজিতা ও আসিতা ফার্নান্ডোর ছোট ছোট সিম মুভমেন্ট ও অ্যাঙ্গেলের কাছেই ধরাশায়ী বাংলাদেশ দলের টপ অর্ডার।
টপ অর্ডারের দরজায় প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছেন রাজিতা। ওবল সিমে করা দিনের দ্বিতীয় বলটিই মাহমুদুল হাসানের ডিফেন্সে ফাটল ধরায়। আউট সুইং ভেবে খেলার চেষ্টায় তালগোল পাকিয়ে উল্টো বোল্ড হন এই তরুণ ওপেনার। মাহমুদুলের মতো ০ রানে আউট হন চট্টগ্রামে সেঞ্চুরি করা তামিম ইকবালও। তবে নিজের আউটের ধরনে তামিমের হতাশই হওয়ার কথা। আরেক পেসার ফার্নান্ডোর লেগ স্টাম্প লাইনের বলটি ফ্লিক করতে গিয়ে তিনি ক্যাচ তুলেছেন পয়েন্টে। ৬ রানের মাথায় দুই ওপেনারকে হারিয়ে একটি জুটির খোঁজে ছিল বাংলাদেশ দল। তিনে নামা নাজমুল হোসেন ও অধিনায়ক মুমিনুলের শুরুটা বাউন্ডারিতে হওয়ায় ওই দুজনকে ঘিরেই ছিল যত আশা।
কিন্তু রাজিতা ছিলেন বাঁহাতি নিধনের মিশনে। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ওবল সিমে বল করে কিছু বল ভেতরে আর কিছু বাইরে নিয়ে ধন্দে ফেলে দেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেই নাজমুল-মুমিনুল এই অ্যাঙ্গেলে ধুঁকছেন। এদিন মিরপুরেও সেই দুর্বলতাকে আরেকবার সামনে নিয়ে এলেন রাজিতা। মুমিনুল অবশ্য আউট হয়েছেন ফার্নান্ডোর অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট ছুঁইয়ে। ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে ৯ বলে ২টি চার মেরে ৯ রান করেই তিনি আউট। তবে নাজমুলের নাম লেখা ছিল রাজিতারই বলে। ঠিক পরের ওভারেই রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে আসা ভেতরে আসা বলে নাজমুলকে বোল্ড করেন তিনি। নাজমুলের চোখে তখন অবিশ্বাস। এই বল কীভাবে এতটা ভেতরে ঢুকল, এই হিসেব যেন তিনি মেলাতেই পারছেন না!
অবিশ্বাস্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই মাঠে আসেন সাকিব আল হাসান। চট্টগ্রাম টেস্টে লিটন দাসের পর ব্যাটিংয়ে নামলেও গতকাল দলের বিপদে এক ধাপ এগিয়ে এসেছেন তিনি। তবে তাতে খুব একটা পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারেননি। রাজিতার ঠিক পরের বলেই সাকিব এলবিডব্লিউ দেশসেরা অলরাউন্ডার। ভালো লেংথ থেকে আরেকটি ভেতরে আসা বল সাকিবের প্যাড আঘাত করে। অ্যাঙ্গেলে বলটি বেরিয়ে যাবে, এই আশা থেকে সাকিব সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নিলেও শেষ পর্যন্ত আম্পায়ার্স কলে আউটই ধার্য থাকে।
এরপর থেকেই মুশফিক-লিটনের যুগলবন্দী শুরু। দায়িত্ব নিয়ে খেলতে থাকেন দু’জনেই। বাজে বল কিংবা নিজের জোনে বল না পেলে মারতে যাননি কোনো বাউন্ডারি। এক-দুই রানে রাখেন সচল রাখেন রানের চাকা। তবে জুটি শতক তোলার একটু পরপরই সুযোগ দিয়েছিলেন লিটন। আসিথা ফার্নান্ডোর বলে হুক করতে গিয়ে শর্ট লেগে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন। ক্যাচ ধরতে গিয়ে বলের ফ্লাইট মিস করে সে সুযোগ হাতছাড়া করেন কুশল মেন্ডিস।
এই মেন্ডিসই প্রথম সেশনের ঠিক আগে বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ ওভারে যখন পেসার রাজিথা বল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ বুক ধরে বসে পড়েন। অস্বস্তি বোধ করায় মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে এমন কিছু ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে অনেকের ক্যারিয়ার। তবে আশার খবর প্রাথমিক শুশ্রƒষার পরই ফিরে এসেছেন। মেন্ডিস ফিরে আসায় লঙ্কানরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও মাঠে তাদের অস্বস্তি বাড়াতে থাকেন লিটন ও মুশফিক। দুইজনই ফিফটি ছুঁলেন। এরপর জুটির শতক। পার হয় দ্বিশতকও। প্রায় একই সঙ্গে দুই জনের সেঞ্চুরি। কিছুটা আগে লিটন। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগেও দুইবার সেঞ্চুরির সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে আউট হন ৯৪ রানে, এবার প্রথম টেস্টে একই মাঠে বাজে এক শটে বিদায় নেন ৮৮ রানে। মিরপুরে আর কোনো ভুল করলেন না। দারুণ সব শটের পসরা সাজিয়ে ১৪৯ বলে পৌঁছান তিন অঙ্কে। সবশেষ আট টেস্টে এটি তার তৃতীয় সেঞ্চুরি। প্রথম ২৫ ম্যাচে ছিল না একটিও!
লিটন যখন ছুটছিলেন দারুণ গতিতে তখনও দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলেন মুশফিক। নিজের জোনে বল পেয়ে কিংবা বাজে বল পেলেই কেবল বাউন্ডারি মারছিলেন তিনি। খেলছিলেন মূলত এক-দুই নিয়ে। এভাবে খেলেই ক্যারিয়ারে প্রথমবার টানা দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি পেয়েছেন মুশফিক। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সিরিজের প্রথম টেস্টে একমাত্র ইনিংসে ১০৫ রান এসেছিল তার ব্যাট থেকে। টেস্ট ক্রিকেটে নবমবারের মতো ছুঁয়েছেন তিন অঙ্ক, এর তিনবারই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আগের ম্যাচে নিজের মন্থরতম সেঞ্চুরি করেছিলেন মুশফিক, এবার তিন অঙ্ক স্পর্শ করলেন ২১৭ বলে। আর তাতে অস্বস্তি ক্রমেই বাড়তে থাকে লঙ্কান শিবিরে। শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ২৫৩ রানের জুটিতে দিন শেষ করেন এ দুই ব্যাটার। মুশফিক ১১৫ ও লিটন ১৩৫ রানে অপরাজিত রয়েছেন।
দারুণ এ জুটিতে রেকর্ড বই থেকে সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলের নাম সরিয়ে দেন লিটন। এর আগে এই মুশফিককে নিয়ে ২০০৭ সালে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোতে ৭৮ রানে পাঁচ উইকেট হারানোর পর ১৯১ রানের জুটি গড়েছিলেন আশরাফুল। এতো দিন এটাই ছিল ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি। তবে টেস্টে এত কম রানে ৫ উইকেট হারানোর পর মুশফিক-লিটনের এ জুটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জুটি, যেকোনো উইকেটে।
এখানেই শেষ নয়! প্রথম সেশনের ৬৬ পর দ্বিতীয় সেশনে যখন উঠল ৮৭ রান- তাতে ৬৩ বছরের পুরোনো একটা বিশ্বরেকর্ডও ভেঙে ফেলেন লিটন আর মুশফিক। ২৫ রানের কমে ৫ উইকেট হারানোর পর ষষ্ঠ উইকেটে সর্বোচ্চ রানের কীর্তিটা এতদিন ছিল পাকিস্তানের দখলে। ১৯৫৯ সালে ঢাকার বুকেই পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সেই ম্যাচে ২২ রানে ৫ উইকেট খোয়ানোর পর ষষ্ঠ উইকেটে ওয়ালিস ম্যাথিয়াস আর সুজাউদ্দিন তুলে ফেলেন ৮৬ রান। যা পরের ৬৩ বছর ছিল অক্ষত। সেই রেকর্ডটাকেই লিটন আর মুশফিক পাঠিয়ে দিলেন সাজঘরে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুশফিক-লিটন রূপকথা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ