Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কওমী মাদ্রাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি দাবি ও বাস্তবতা

আ.হ.ম. নূরুল কবির হিলালী | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৬, ৯:৩৪ পিএম | আপডেট : ১২:৩০ এএম, ২০ নভেম্বর, ২০১৬


॥ এক ॥
বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসার
বর্তমানে উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতার যে বিচ্ছুরণ ও বিকিরণ ঘটেছে এর পাদমূলে রয়েছে তদানীন্তন মুসলিম শাসক পরিভাজক ও ইলমে-নববীর ধারক-বাহক কওমী মাদ্রাসা শিক্ষিত ওলামায়েকেরামের অনবদ্য অবদান। কওমী ওলামায়েকেরামের সাহিত্যনুরাগ, শিক্ষা পিপাসু মন ও জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে জনকল্যাণের অপার আগ্রহ প্রমাণ করে নৈতিকতাসমৃদ্ধ-খোদাভীতিসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমেই দক্ষ, সুশীল সালেহীন সৎকর্মনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক আর্দশ নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব। ইসলামের সাথে গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার সম্পর্ক বিপরীতমুখী। এ কথাটি তাদের মন মগজে প্রোথিত করা হয়।
ইমলে নববীর ধারক-বাহক এদেশের ইসলামী ঐতিহ্যের সুপ্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষাধারা সম্পর্কে নবপ্রজন্মের অনেকে কোন ধারণাই রাখেন না। অল্প-বিস্তর যাদের মোটামুটি ধারণা রয়েছে তাও সত্যসিদ্ধ, বস্তুনিষ্ঠ, তত্ত্ব-উপাত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ নয়। ফলে অনেকে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে অবজ্ঞাপূর্বক ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি-সভ্যতা বিস্তারে এবং রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে এ শিক্ষা ব্যবস্থার গৌরবদ্বীপ্ত অতীত ও সমোজ্জ্বল বর্তমান এবং আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎকে অস্বীকার করে এর বিরুদ্ধে নানা অলিক কল্প-কাহিনী রটিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির জালে ফাঁসানোর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শত শত বছরের ঐতিহ্যম-িত এ শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত তুলে ধরা প্রয়োজনবোধ করছি।
ঐতিহাসিকরা রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী (কওমী) মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাঁচ পিরিয়ডে ভাগ করে থাকেন। যথা-
(১) খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর সূচনা কাল থেকে ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দ (চারশত বছরাধিক)।
(২) ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ (৫৬৮ বছর)।
(৩) ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত (১০১ বছর)।
(৪) ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত (৮১ বছর)।
(৫) ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে চলমান (৫৮ বছর)।
কওমী মাদ্রাসার ইতিহাস
কওমী মাদ্রাসা বলতে ঐ সকল দ্বীনি শিক্ষাগারকে বুঝায় যেগুলো মহান রাব্বুল আলামীনের উপর তাওয়াক্কুলকে সম্বল করে এদেশের দ্বীনপ্রিয় জনগণের সাহায্য-সহযোগিতায় পরিচালিত হয় এবং যেখানে এত নিখুঁত উচ্চমানের পাঠ্যতালিকা অনুসৃত হয় যা কোরআন-হাদিসের জ্ঞান ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উজ্জ্বল মাতাদর্শে পরিপুষ্ট।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে সাহাবীদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইসলামের প্রবেশ ঘটে এবং তাঁরাই সর্বত্র এদেশে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কিন্তু ত্রয়োদশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত এদেশে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না বরং ব্যক্তিগত এবং বিক্ষিপ্তভাবে দ্বীনি শিক্ষা চালু ছিল। সে যুগেও মসজিদগুলোতে দ্বীনি শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু যুগের চাহিদানুযায়ী ক্রম বর্ধমান বহুবিধ দ্বীনি সমস্যাসমূহের সমাধান এবং দেশের সর্বত্র ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতির লক্ষ্যে প্রয়োজন ছিল এমন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের। এ মহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ আলামা তকিউদ্দীন আরবি রাজশাহীর মহিসন্তেষে ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে একটি কওমী মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ছিল বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ইসলামী শিক্ষায়তন। শাহ শোয়াইব লিখিত “মানাকিবুল আসফিয়া” গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ইতিহাস প্রসিদ্ধ সূফি ও লেখক আলামা শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর পিতা, শায়খ ইয়াহইয়া মনরী বিহার থেকে এসে এ মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন। এতে বলা চলে যে, এদেশে কওমী মাদ্রাসার সূত্র ধরেই ইসলামী শিক্ষায়তনের আবির্ভাব ঘটে।
এ সম্পর্কে ১৮৮২ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে আলোকপাত করা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল পর্যন্ত ইসলাম প্রিয় জনসাধারণই দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার বহন করত। ১২৭৮ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে আলামা শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ বাংলার তৎকালীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে গমন করেন। তিনি তথায় একটি উন্নতমানের মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তত্ত্বানুসারে শায়খ আবু তাওয়ামাকে বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। এরপর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত রাজশাহী, বগুড়া, সিলেট ও চট্টগ্রামে বহু কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ইসলাম খানের আমলে দেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের পর ঢাকাতেও বহু মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যেমন খান মুহাম্মদ মীরদাহ মসজিদে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা (১১১৬ হিজরী) এবং আজিমপুর (১২৬০ হিজরী) ভাঙ্গা গড়ার মধ্যদিয়ে ত্রয়োদশ শতক থেকে আরম্ভ করে ইংরেজদের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র পর্যায়ক্রমে বহু কওমী মাদ্রাসা দ্বীনি শিক্ষার আলো বিকিরণ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায় যে, ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের সময় এ উপমহাদেশে ৮০ হাজার অধিক কওমি মাদ্রাসা চালু ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইংরেজদের অনুপ্রবেশের পর দেশ থেকে ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুন চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্যে মারাত্মক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ফলে দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বিলুপ্ত হতে থাকে। তখন দেশের আলেম সমাজ বিশেষত আকাবিরে দেওবন্দ দেশে জনসাধারণের মধ্যে আত্মচেতনা, তাহযীব-তামাদ্দুন এবং দ্বীনি শিক্ষার কার্যক্রম পুনর্বহালের লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের ইউপি-তে রাব্বুল আলামীনের পরম করুণাস্বরূপ ১৮৬৬ সালে স্থাপিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ।
কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বীনের ঐতিহ্যবাহী খালেছ ও গৌরবদ্বীপ্ত ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ভারতীয় মুসলমানদের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বিশ্বস্থ খোদাভীরু ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ প্রতিভা ধর মুসলিম মিলাতের চিন্তানায়ক আলামা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুভী (রহ.)-এর ঐকান্তিক সাধনা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার নজরানার ফল ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম দেওবন্দ। ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলাধীন দেওবন্দে অবস্থিত ইন্ডিয়ার জামিউল আজহার নামে খ্যাত বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে দরশে নেজামী চালু রাখার প্রত্যয়ে সাধারণ মুসলিম জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন ও অর্থানুকূল্যে এক স্বতন্ত্র ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। এরই পথ অনুসরণ করে এদেশেও পুনরায় কওমী মাদ্রাসা গড়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রয়াস শুরু হয়। ফলশ্রুতিতে ১৮৮৯ সালে দারুল উলুম কানইঘাট সিলেট, ১৯০১ সালে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটাহাজারী চট্টগ্রাম, ১৯১০ সালে জামেয়া আরবিয়া জিরি ও কুমিলায় দারুল উলুম বড়–রা, আনুমানিক ১৯১৮ সালে ইসলামিয়া মাদ্রাসা ঢাকা, ১৯২৬ সালে বাবুনগর, ১৯২৮ সালে আশরাফুল উলুম বালিয়া মোমেনশাহি, ১৯৩১ সালে হোসাইনিয়া রানপিং, ১৯৩৭ সালে দারুল উলুম গওহরডাঙ্গা ফরিদপুর, ১৯৩৮ সালে জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়াসহ দেশের রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায় আরও বহু উন্নতমানের মাদ্রাসা গড়ে উঠে। তাই এই যুগকে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার রেনেসাঁর যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
দ্বীনের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাধারায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জনপদে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা আবহমান কাল ধরে কুরআন-হাদিস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মাধ্যমে ইলমে দ্বীনের মশালকে প্রজ্বলিত ও অনির্বান রেখেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ২০০৫ সালের জরিপ অনুযায়ী স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ছোট-বড় নুরানী ও মক্তবসহ প্রায় লাখ খানেক কওমী মাদ্রাসা বিদ্যমান। এরমধ্যে জামিয়া আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া, জামিয়া দারুল মা- আরিফ আল ইসলামিয়া চট্টগ্রাম, জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ ঢাকা, জামিয়া এমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ, জামিয়া শারিয়াহ মালিবাগসহ মাঝারি, বড় ও বিশ্ববিদ্যালয় মানের মাদ্রাসা রয়েছে ১১ হাজার।



 

Show all comments
  • H nazmul islam ২০ নভেম্বর, ২০১৬, ৫:০৫ পিএম says : 0
    এমন গৌরবময় ইতিহাসের পরও আজ আমরা রাষ্ট্রিয় কোনো মুল্লায়ন পাচ্ছিনা এটাও ইতিহাস হয়ে থাকবে।
    Total Reply(0) Reply
  • ২১ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২১ এএম says : 0
    এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন কৌমি শিক্ষা আরো গণমুখি হওয়া প্রয়োজন।
    Total Reply(0) Reply
  • রাসেল ২২ নভেম্বর, ২০১৬, ৭:১৬ এএম says : 0
    মুসলমানের এক নেতার অভাবে ,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ