চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
হজরত মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.) আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ, ইতিহাস রচয়িতা মোফাসসিরে কোরআন, আলেম সমাজের অগ্রনায়ক, লালবাগ শাহী মসজিদের ইমাম ও খতিব, লেখক, গবেষক, বহু ভাষাবিদ এবং শ্রোতাম-লীর মন জয় করা একজন ওয়ায়েজ। যাঁর সুললিত কণ্ঠ আর হৃদয়গ্রাহী বয়ান যুগ যুগ ধরে স্মরণীয়। অনুপম চারিত্র্যিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সকলের জন্য অনুকরণীয়, অনুসরণীয়।
মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.) ১৯৩২ সালে কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার মুদাফরগঞ্জ বাঘমারা মিয়াবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আলী মিয়া। খেতাব-নাজির সাহেব। তিনি একজন উঁচুস্তরের আবেদ ও দরবেশ ছিলেন। তৎকালীন বৃটিশ ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত ওলীয়ে কামেলের অনুসন্ধানে জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, খাসিয়া, জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আধ্যাত্মিক সাধনার প্রথম স্তরে তিনি এশার নামাজের পর একশত রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। আর বংশ পরম্পরায় চালু ছিল মুসাফিরখানা, পূর্ব পুরুষের বৈশিষ্ট্য ছিল আতিথেয়তা। মেহমান ব্যতীত একবেলাও আহার গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তিনি নিজেও ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। সবার প্রতি তাঁর উপদেশ ছিল-“দিও কিঞ্চিৎ, না করিও বঞ্চিত।”
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.)-এর রুহানী সিলসিলার শাজারাশরীফ ৩০তম পর্যায়ে হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হয়েছে। নি¤েœ এর বিবরণ উল্লেখ করা হলোÑ
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.) মোহাম্মদ আলী মিয়া (রহ.), হজরত আহমদ মিয়া (রহ.), হজরত শাহ ফজলে রহমানগঞ্জে মুরাদাবাদী (রহ.), হজরত শাহ আফাক (রহ.), হজরত জিয়াউল্লাহ (রহ.), হজরত নকশবন্দ (রহ.), হজরত মাসুম (রহ.), হজরত আবদুল বাকি (রহ.), হজরত খাজা মকনকী (রহ.), হজরত দরবেশ আহমদ (রহ.), হজরত যাহেদ (রহ.), হজরত ওবায়দুল্লাহ (রহ.), হজরত ইয়াকুব (রহ.), হজরত আলাউদ্দীন (রহ.), হজরত বাহাউদ্দীন (রহ.), হজরত আমীর (রহ.), হজরত মোহাম্মদ (রহ.), হজরত আলী (রহ.), হজরত মাহমুদ (রহ.), হজরত আবেদ (রহ.), হজরত আবদুল খালেক (রহ.), হজরত ইউসুফ (রহ.), হজরত বুআলী (রহ.), হজরত আবুল হাসান (রহ.), হজরত বায়েজিদ (রহ.), হজরত জাফর (রহ.), হজরত কাসেম (রহ.), হজরত সালমান ফারসী (রা.), হজরত আবু বকর (রা.), হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
পিতা-মাতা দুজনেই দ্বীনি এলমের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর মাতা ছিলেন দ্বীনদার পরহেজগার বুদ্ধিমতী এবং ধৈর্যশীল একজন মহিয়ষী নারী। তাঁর মাতা তাজবিদ সহকারে সহিশুদ্ধরূপে কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে পারতেন যা সেই সময় ছিল বিরল। তাই ঘরেই তিনি প্রয়োজনীয় দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর পিতার নিয়ত ছিল এই সন্তানকে শুধুমাত্র দ্বীনি শিক্ষা দান করবেন। উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমগণের সঙ্গে তাঁর পিতার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। তিনি স্বয়ং বলেছেনÑ “আমি বাল্যকালে আমাদের বাড়িতে মেহমান হিসেবে যাঁদেরকে দেখেছি, তন্মধ্যে হজরত মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী (রহ.), হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), হজরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ (রহ.), (হজরত কারী ইব্রাহীম (রহ.)-এর জামাতা), ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার হজরত মাওলানা তাজুল ইসলাম (রহ.), নোয়াখালীর হজরত মাওলানা নুরুল্লাহ (রহ.), চট্টগ্রামের জিরি মাদ্রাসার হজরত মাওলানা আহমদ হোসাইন (রহ.) প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতিব হজরত মাওলানা আবদুল আহাদ সোয়ায়েল মাদানী (রহ.)-কে মেহমানরূপে আমাদের গ্রামের বাড়িতে দেখেছি।” তাই সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, বাল্যকাল থেকেই তিনি আলেম-ওলামাদের ফয়েজ বরকত, দোয়া ও সোহবত লাভ করেছেন।
প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় পিতার সুপ্রতিষ্ঠিত রহমতগঞ্জ মাদ্রাসায়। কোরআন শরীফ পাঠ করেন মুহতামিম হজরত মাওলানা আবদুর রহমান (রহ.)-এর নিকট। কেরাত পাঠ করেন নলুয়া চাঁদপুরস্থ মাওলানা আবদুল মতিন সাহেবের নিকট। একই সাথে উর্দু, ফারসী ও আরবী ভাষা শিক্ষা করেন আরো চারজন বিজ্ঞ ওস্তাদের নিকট। এছাড়াও আরবী ব্যাকরণ শিক্ষার জন্য তিনি একটি বছর হজরত মাওলানা আবুল কাসেম (রহ.)-এর নিকট তালিম গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) ঢাকার বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বড় কাটারা আশরাফুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তাঁর নেগরান ছিলেন হজরত জাফর আহমদ ওসমানী (রহ.)। আর ওস্তাদ হিসেবে পেয়েছেন কালজয়ী ত্রিরতœ হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), পিরজী হুজুর (রহ.) এবং সদর সাহেব হুজুর (রহ.)।
এরপর তাঁর মুরুব্বী হজরত মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী (রহ.)-এর নির্দেশক্রমে নোয়াখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং মাত্র তিন মাসের প্রস্তুতিতে আলিম পরীক্ষায় সারাদেশে নবম স্থান অধিকার করেন। এখানে অবস্থানকালীন সময়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং জেলাভিত্তিক, বিভাগীয় ও প্রাদেশিকভাবে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এই মাদ্রাসা থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে ফাযিল পরীক্ষায় পাস করেন। এই মাদ্রাসায় তিনি দু’বছর অধ্যয়ন করেন। এখানকার ওস্তাদগণ তাঁকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন, তাঁর বিদায় মুহূর্তে সকলেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এবং অশ্রুসজল নেত্রে প্রিয়ছাত্রকে বিদায় জানান। এটি ছিল একটি স্মরণীয় ঘটনা।
এরপর তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় টাইটেল ক্লাসে ভর্তি হন। এখানে হজরত মুফতি আমিমুল এহসান (রহ.)-এর নিকট পবিত্র বোখারী শরীফ পাঠ করার সৌভাগ্য লাভ করেন। মুফতি সাহেবের সান্নিধ্যে এসে জ্ঞান-সাধনার ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। ১৯৫৫ সালে টাইটেল পরীক্ষায় সারাদেশে তিনি পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এরপর তাঁকে দু’বছরের জন্য সরকারের তরফ থেকে হাদীস শরীফের একটি বিশেষ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করার নিমিত্তে “রিসার্চ স্কলারশিপ” দেয়া হয়। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আরবী ভাষায় এই রিসার্চ সম্পন্ন করেন। এই পা-ুলিপিটি দেখে হজরত মুফতি সাহেব ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে বাড়িতে ডেকে নিয়ে বলেন, “বাবা! একগীর ও মুহকামগীর।” তুমি জ্ঞান সাধনার এ কাজটিই করো এবং এর উপরেই সুদৃঢ় থাক। বস্তুতঃ তিনি সারাজীবন এর উপরেই সুদৃঢ় ছিলেন।
বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী হজরত মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.) তরুণ বয়স থেকেই ছিলেন সপ্রতিভ, উদ্যমী, তেজস্বী, বাগ্মী, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। যে কোনো পরিবেশেই তিনি ছিলেন নজরকাড়া-নজরলাগা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সবার মাঝেই সমুজ্জল। সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
১৯৫৮ সালের কথা। কুমিল্লা শহরে হজরত সৈয়দ আব্দুল করীম মাদানী (রহ.)-এর মাহফিলে তাঁরই আরবী বয়ান অনুবাদ করেন মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম (রহ.)। তাঁর অনুবাদে সন্তুষ্ট হয়ে মুফতি সাহেব তাঁকে চট্টগ্রামে তাঁর সাথে থাকার অনুরোধ করলেন। অতঃপর দুই বছর তিনি মুফতি সৈয়দ সাহেবের সোহবতে ছিলেন। তাঁর আরবী বয়ান বাংলা ও উর্দু ভাষায় তরজমা করতেন ও প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত করতেন মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.)। ১৯৬০ সন থেকেই তিনি ঢাকা রেডিওতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। এছাড়া টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি সর্বপ্রথম তেলাওয়াত করেছেন। সুস্থ জীবনের শেষসময় পর্যন্ত তিনি রেডিও ও টিভিতে মূল্যবান কথিকা, মিলাদ-মাহফিল ও বিভিন্ন ইসলামিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে দ্বীন-ইসলামের খেদমত করে গেছেন। ১৯৫৯ সালের পর থেকে সুদীর্ঘ এগার বছর তিনি ঢাকাস্থ ইসলামিয়া মাদ্রাসার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এই সময় তিনি দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম উন্নীত করেন এবং বিশেষ পদ্ধতিতে দরস দিতেন যাতে সব ছাত্রই উপকৃত হতো।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁকে বাকশক্তি ও লেখনীশক্তি দুটোই দান করেছিলেন। দ্বীন-ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই দুই মাধ্যমকেই তিনি আজীবন কাজে লাগিয়েছেন। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে তাঁর মুখ-নিঃসৃত প্রতিটি বাণীই শ্রোতার মনে হেদায়েতের আলো জ্বালিয়েছে। আর তাঁর প্রতিটি গ্রন্থই পাঠকের জীবনে মন-মননে, চিন্তা-চেতনায় রেখাপাত করেছে।
১৯৫৯ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। ইসলামিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিল। প্রধান অতিথি হিসেবে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম বিশ্ববরেণ্য আলেম হাকিমুল ইসলাম হজরত মাওলানা কারী তৈয়্যব সাহেব (রহ.) তশরীফ আনবেন। কোনো কারণবশতঃ অনুষ্ঠানের দিন তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। এদিকে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী নবাববাড়ী-ময়দানে লোকজন সমবেত হয়েছেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নিতান্তই বিপাকে পড়ে মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.)-এর স্মরণাপন্ন হলেন। তাঁদের বিশেষ অনুরোধে তিনি রাজি হলেন এবং আসর থেকে মাগরিব ও পরে মাগরিব থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময় বয়ান করেন। আল্লাহ্পাকের খাস রহমতে উপস্থিত সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো বয়ান শোনেন, উচ্ছসিত হন আর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু পরদিনও একই সমস্যার উদ্ভব হয়। যথারীতি মাওলানা আমিনুল ইসলাম সাহেব বয়ান আরম্ভ করেন, শ্রোতাদের মন জয় করেন ও কারী সাহেবের অনুপস্থিতির শূন্যতা পূরণ করেন। এই মাহফিলের সাফল্যের কারণে ওলামায়েকেরামগণ সম্মিলিতভাবে তাঁকে “তাজুল খোতাবা” উপাধিতে ভূষিত করেন।
জীবনের এক বৃহৎ অংশ তিনি ব্যয় করেছেন দেশ-বিদেশে ওয়াজ-নসিহত করে, দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করেছেন শহর থেকে গ্রামে একাধিক মাহফিল করে। এখানে সেই সময়ের উল্লেখ করছি যাতে সহজেই অনুমান করা যায় প্রকৃত অবস্থা। রবিউল আউয়াল মাসে সিলেটে দুটি মাহফিল ছিল। সকাল সাড়ে সাতটার ফ্লাইটে সিলেটে রওয়ানা হন। সোয়া আটটায় অবতরণের পর ত্রিশ মাইল দূরে বিয়ানীবাজারে মাহফিলে পৌঁছান। সকাল সাড়ে দশটা থেকে বারটা পর্যন্ত বয়ান শেষ করে পুনরায় দশ বারো মাইল দূরে আরো একটি মাহফিলে বয়ান করেন। সেখান থেকে সাড়ে তিনটার ফ্লাইটে ঢাকায় রওনা হন। চারটা পনেরতে ঢাকায় অবতরণ করে বাড়িতে পৌঁছান। আসর আদায় করে পুনরায় বিমানবন্দরে গিয়ে সাড়ে পাঁচটার ফ্লাইটে চট্টগ্রাম রওনা হন। চট্টগ্রাম পৌঁছে বাদ মাগরিব আলিয়া মাদ্রাসার মাহফিলে বয়ান করেন। বয়ান শেষে রাতের ফ্লাইটেই ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ পরবর্তী মাহফিলের লোকজনের সঙ্গে সরাসরি লালবাগে সীরাতুন্নবী (সা.) মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন। বয়ান ও মুনাজাত শেষে গভীর রাতে বাড়িতে ফিরে আসেন।
মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.) দৈহিকভাবে মাঝারি গড়ন ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য ও মার্জিত রুচির সংমিশ্রণে তিনি সকলের নিকটই আকর্ষণীয় ছিলেন। সুস্পষ্ট বাচনভঙ্গি, অপূর্ব কণ্ঠ-মাধুর্য-এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন কথার জাদুকর। তাঁর কথার জাদুকরী প্রভাব পড়তো শ্রোতার অন্তরে।
আমেরিকা সফরকালে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্য শুনে উপস্থিত শ্রোতারা এতটাই প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন যে মসজিদ তৈরি করার জন্য যে অনুদান প্রয়োজন ছিল যার নিকট যা ছিল তাৎক্ষণিকভাবে তাই সবাই দান করেছিলেন। এমনকি মহিলারা পরিহিত স্বর্ণালংকার খুলে দান করেছিলেন।
তিনি লালবাগ শাহী মসজিদের খতিব হিসেবে আমৃত্যু খেদমত করে গেছেন। এছাড়া তিনি বহু বছর নিয়মিত তফসির করেছেন আবদুল হাদী লেন মসজিদ, চৌধুরী বাজার মসজিদ এবং সাতরওজা মসজিদে। নিজ বাড়িতে প্রতি শুক্রবার বাদ মাগরিব বয়ান করেছেন, মৃত্যুর পূর্বে শেষ শুক্রবার পর্যন্ত একটানা সাতাইশ বৎসর পর্যন্ত এই কার্যক্রম পরিচালনা করে গেছেন। একই সময়ে ধর্মীয় মাসিক পত্রিকা আল-বালাগ সম্পাদনা করে গেছেন।
তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম অমরকীর্তি হলো “তফসীরে নুরুল কোরআন” বাংলা ভাষায় এমনকি মৌলিক ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত বিস্তারিত সহজবোধ্য তফসীর গ্রন্থ ইতিপূর্বে আর লিখিত ও প্রকাশিত হয়নি। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন সুদীর্ঘ আঠার বৎসরের সাধনায় এই গ্রন্থটি (৩০ খ-ে সমাপ্ত) রচনা করার তওফিক দান করেছেন। পাশাপাশি তিনি “নূরেনবী (সা.)” এই গ্রন্থটি দুই খ-ে সমাপ্ত করেন। তাঁর রচিত “বিশ্ব সভ্যতায় পবিত্র কোরআনের অবদান” গ্রন্থটি তিনবার জাতীয় পুরুস্কার লাভ করে। ৩০টিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করে তিনি মুসলিম জাতির বিরাট উপকার সাধন করেছেন।
এই ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর মতো একজন অসাধারণ ব্যক্তি সম্পর্কে সঠিকভাবে ধারণা দেয়া সম্ভব নয়। এরপরও দু’একটি চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উল্লেখ না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি ছিলেন একজন সাচ্চা আশেকে রাসূল (সা.)। দৈনন্দিন জীবনে এক একটি সুন্নত পালন ও বাস্তবায়নের উপর অত্যন্ত তাগিদ দিতেন। দরুদ শরীফ পাঠের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর গ্রন্থে “সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম” পুরো দরুদ শরীফ লিপিবদ্ধ করেন।
তাঁর আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সময়ের সদ্ব্যবহার করা। জীবনে কখনো অহেতুক কথা বা গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করেননি। এমনকি শৈশবেও অন্যান্য শিশুদের মতো খেলাধুলা করে সময় নষ্ট করেননি। কোনো শরিয়ত বিরোধী কাজ হতে দেখলে বা সময় নষ্ট করতে দেখলে অত্যন্ত রাগান্বিত হতেন। প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতেন, প্রতিটি মুহূর্তকে হিসেব করে খরচ করতেন। সময়ের এই হিসেবের কারণেই যে তারিখে কুমিল্লায় তাঁর মাহফিল ছিল (১২ই রবিউল আউয়াল) সে তারিখেই বিবাহের তারিখ নির্ধারণ করেন এবং মাহফিল শেষে বিবাহের কাজ সমাধা করেন।
যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অপরিসীম। তিনি নিজেই বলতেনÑ “আমি এখনো নিজেকে তালেবে এলম মনে করি। দিন রাতের আঠার ঘণ্টাই আমি পড়াশোনার কাজে ব্যয় করি।” হাদীস শরীফে আছেÑ “তোমরা জ্ঞান অর্জন কর দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত।” বস্তুতঃ তিনি সর্বশেষ অসুস্থতার পূর্ব পর্যন্ত দ্বীনি কিতাব অধ্যয়ন করেই শান্তি পেতেন।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। ২০০৭-এর ১৯ শে নভেম্বর সোমবার ৭ই জিলকদ ১৪২৮ হি. তিনি তাঁর প্রিয় রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তিসমূহ। মনের মাঝে তাঁর মায়াবী নূরানী চেহারাখানি ভেসে উঠলে আজো নিজের অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে পড়ে। তাঁর সমস্ত ভক্ত-অনুরক্তদের প্রতি অনুরোধ একবার সূরা ফাতিহা, তিনবার সূরা ইখলাস ও দরুদ শরীফ পড়ে সওয়াব রেসানী করার জন্য। আল্লাহ্পাক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।