চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
তারাবীর নামাযে তেলাওয়তে কুরআন সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলা হবে ইন্শাআল্লাহ্, যে সম্পর্কে সাধারণত কম চিন্তা করা হয়। সেজন্য আলোচনাও তেমন হয় না। ফলে নামাযে অনেক ভুলভ্রান্তি থেকে যায় এবং নামাযীগণ প্রচুর ছওয়াব থেকে মাহরূম হন। তেলাওয়াতে পাঠক (হাফেজ ছাহেব) আটকে গেলে বা ভুল পড়লে পিছন থেকে শ্রোতা হাফেজগণ সংশোধনের জন্য লুকমা দেন। এই লুকমা সম্পর্কিত কিছু উসূলী বা মৌলিক পরামর্শ রয়েছে। পাঠক হাফেজ ছাহেবগণ এ পরামর্শ মেনে চললে নামাযে তেমন ভুলই হবে না এবং তাঁদেরসহ নামাযীগণ অসীম ছওয়াবের ভাগী হবেন।
অপরপক্ষে, এই মত কাজ না করলে তেলাওয়াতে নানা রকম ভুল হবেÑ তাতে নামায মাকরূহ হতে পারে, এমনকি ফাসেদও হতে পারে। যে রাকাতে নামাযের ফাসেদ হওয়ার ভুলটা হবে, তার সঙ্গেকার দ্বিতীয় রাকাতটিও ফাসেদ হবে। ফলে সেদিনকার খতমে তারাবী পরিপূর্ণ হবে না। অর্থাৎ (আর ভুল না হলে) সেদিনের তারাবীহ আঠারো রাকাত হবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই হবে যে, রমযান মাসে তারাবীর খত্মে কুরআন পূর্ণ হবে না। তাতে বহু ছওয়াবের কমি হয়ে যাবে। এ রকমের ভুল যদি হতে থাকে, তবে যেন পাঠক হাফেজ ছাহেবদের দ্বারা মসজিদের মুসল্লীদের ভাগ্যই নষ্ট করে ফেলা হলো। অর্থাৎ তাঁদের সৌভাগ্যে ধস নামিয়ে দিলেন। আল্লাহ্র পানাহ! আল্লাহ্ রক্ষা করুন। আমীন।
তেলাওয়াতের ফযীলত : পরামর্শের আগে হাদীসের আলোকে একটি বিষয় মনে রাখলে পরামর্শটি হাফেজ ছাহেবানের পক্ষে গ্রহণ করতে অধিক আগ্রহও হবে, সহজও হবে। হাদীস শরীফে হযরত আলী (রাযি আল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত আছে, নামাযের বাইরে ওযু ছাড়া পবিত্র কুরআন পাঠে প্রতি হরফে দশ নেকী হয়, ওযু অবস্থায় পঁচিশ নেকী। অলসতায় নামায বসে পড়লে তেলাওয়াতে প্রতি হরফে পঞ্চাশ নেকী এবং দাঁড়িয়ে পড়লে প্রতি হরফে একশত নেকী। এ হলো রমযান মাসের বাইরে তেলাওয়াতের ছওয়াব। আর রমযান মাসে প্রতি নেক কাজে সত্তর গুণ বেশি হিসাবে নামাযের বাইরে ওযু ব্যতীত তেলাওয়াতের সাতশত নেকী; ওযুসহ সতেরশ পঞ্চাশ নেকী; নামাযে অলসতায় বসাবস্থায় তিন হাজার পাঁচশ নেকী এবং দাঁড়িয়ে পড়ায় সাতহাজার নেকীর ছওয়াব লাভ হয়। আর শবে কদরে বা কদরের রাতে আল্লাহ্র বাণীÑ ‘খাইরুম মিন আলফি শাহর’ হিসাবে প্রতি নেকীতে হাজার মাসের রাতেরও অধিক নেকী হয়। বলতে গেলে, এক রমযান মাসের অসংখ্য অগনিত নেকীর ছওয়াব লাভ হয়। একমাত্র ৩০ রাতের তারাবীর ছওয়াব লাভ হয় তারাবীর খতমে।
এই সঙ্গে আর একটি বিষয় অবশ্য উল্লেখযোগ্য ও স্মরণযোগ্য। তা না হলে পূর্ণ খতমে তরাবী ও খতমে কুরআন এর ছওয়াব সবই একেবারে বিনষ্ট হয়ে যাবে। সেটা সংঘটিত হয় তারাবীতে পবিত্র কুরআন সহীহ না পড়ার কারণে। সহীহ তেলাওয়াতের ব্যাপারে স্বয়ং পবিত্র কুরআনেই আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশ রয়েছেÑ ‘ওয়া রাততিলিল কুরআনা তারতীলা’, তারতীলসহ কুরআন তেলাওয়াত কর। তারতীল অর্থ হচ্ছে বিশুদ্ধরূপে কুরআন পাঠ করাÑ তাজভীদ ও মাখরাজ অনুসারে তেলাওয়াত করা। মদ ও মাখরাজ এর বেশকমে অর্থের পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থের এখনো পরিবর্তন হতে পারে, যাতে নামায ফাসেদ হয়ে যায়। তাই তো হযরত আনাস ইব্ন মালিক বলেন, “অনেক কারী (কুরআন তিলাওয়াতকারী) কুরআন পড়ে, অথচ কুরআন তাকে লা‘নত করে।”
সারাটা বছর ধরে আমরা পবিত্র রমযানের অপেক্ষা করি। রজব ও শা‘বানে সেই অপেক্ষা হয় গুরুতর। রোযা ও তারাবীই তো রমযানের প্রাণ বা মূল বিষয়। সারাদিন রোযা রেখে বিপুল পরিমাণ ছওয়াবের তারাবী নামাযের অপেক্ষা করতে থাকি। ইফ্তারের পর মাগরিব ও আওয়াবীনের নামায সামনে আসে, তারপর এশা ও তরাবীর নামায। তারাবীতে খত্মে কুরআন; খতমে কুরআনের ছওয়াবের আশায় সারাদিনের রোযার ক্লান্তি কোথায় চলে যায়। এশার নামাযের আগেভাগে মসজিদে উপস্থিত হয়ে তাহ্য়াতুল ওযু ও এশার সুন্নত পড়ে কাতারে বসে যাই। দেখতে দেখতে ইমাম ছাহেব ও হাফেজ ছাহেবগণের শুভ আগমন হয়। মুয়ায্যেন ছাহেবের একামতে আল্লাহু আকবার, ধ্বনিতে মুসল্লীগণ সোৎসাহে দাঁড়িয়ে যান। বাদ এশা ও সুন্নত, মুয়ায্যেনের সুমধুর ধ্বনি মুসল্লীদের কানে ফের ভেসে আসে, “আপনারা দাঁড়িয়ে যান, তারারীর নামায শুরু হচ্ছে।”
আলহামদুলিল্লাহ্ ! তারাবীহ শুরু হলো। তারাবীর প্রথম থেকেই যে বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং যার দিকে সকল মুসল্লীর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়, তা হচ্ছে হাফেজ ছাহেবদের খত্ম কুরআনের তেলাওয়াত। যে সকল মুসল্লী তারাবীর নামায সর্টকার্ট বা তাড়াতাড়ি পড়তে চান, তাদের লক্ষ্য থাকে হাফেজ ছাহেবগণ যেন কুরআন খুব দ্রুত পাঠ করেন। তাঁরা হয়ত এ মাসআলাই জানেন না, অথবা জানলেও ভুলে যান যে, অতি তাড়াতাড়ি পড়াতে মদ্ ও মাখরাজ ঠিকভাবে আদায় হয় না। ফলে আল্লাহ্ তাআলার কালামের অর্থই কোনো কোনো স্থানে এমন বিকৃত হতে পারে যে, তাতে নামাযই বাতিল হয়ে যায়। কী সর্বনাশের কথা। অথচ দ্রুত পড়ায় এবং তারতীলের সঙ্গে পড়ায় সময়ের ব্যবধান বড়জোর ১০/১৫ মিটিনের হয়। কিন্তু এই বেশকমে যে নামায ফাসেদ বা শুদ্ধ হয়, এ কি লক্ষণীয় নয়?
তারাবীর নামায মাঝারি ঢঙে পড়াই সমীচীনÑ খুব ধীরেও নয়, খুব দ্রুতও নয়। কিন্তু সাধারণ মুসল্লীদের অনেকে চান, নামায সত্বর শেষ হোক। তবু আল্হামদুলিল্লাহ্, শহরে কিছু কিছু মসজিদ এখনো আছে, যেখানে বিজ্ঞ আলেম ইমামগণ রমযানের পূর্ব থেকে, অর্থাৎ রজব ও শা‘বান থেকে তারতীলের সঙ্গে তেলাওয়াতের ফাযায়েল বর্ণনা করতে থাকেন। ফলে সেসব মসজিদের মুসল্লীগণের অধিকাংশই ধীরেসুস্থে তারাবী পড়ার প্রতি আগ্রহান্বিত হন এবং তারতীলের সঙ্গে তারাবী পড়া যে অতি ফযীলত বা সৌভাগ্যের বিষয় তা জেনে আনন্দিত হন।
তেলাওয়াত সম্পর্কিত ভুল সংশোধনের কিছু উসূলী পরামর্শ : কুরআনের তেলাওয়াতে মাঝে মধ্যে হাফেজ ছাহেবদের আটকে যাওয়ার ব্যাপার দেখা যায়। যে মসজিদে হাফেজ ছাহেবগণ ভালো ইয়াদ করে পড়েন, সেখানে ভুল-চুক কদাচিৎ হলেও হয়। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলার কালাম এমন এক জিনিস, যার উপর মানুষ বিজয় লাভ করতে পারে না। অতএব, ভুল কিছু না কিছু হওয়া স্বাভাবিক। এ জন্যই লুকমা দিয়ে শুধরানোর প্রয়োজন পড়ে। লুকমা সম্পর্কে কিছু মূলনীতির কথা বলার কথা হয়েছে। তবে তার আগে আরেকটি বিষয় আলোচনা করে নিতে হয়, যাতে তেলাওয়াতে লুকমাই কম দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
বর্তমানকালে তারাবীহ পড়ানোর জন্য মাশাআল্লাহ্ হাফেজ ছাহেবানের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ধরুন, কমপক্ষে তিনজন, বেশির পক্ষে চার/ পাঁচজন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই সাথে তাঁদের পড়ায় গাফলত, অলসতার পরিমাণও বেড়েছে। এতই বেড়েছে যে, পঠিতব্য পারাটি কয়েকবার, হয়ত চার/ পাঁচবার পড়েই হাফেজ ছাহেব মনে করেন যে, ইয়াদ হয়ে গেছে। আর পড়ার দরকার নেই। কোনো রকম পড়তে পেরেই পড়া থেকে উঠে পড়েন।
অথচ অতি প্রাচীনকালের কথা নয় ; আমাদের জীবনের প্রাথমিককালে, এই ধরুন পঞ্চাশ ষাট বছর পূর্বের কথাÑ আমাদের আকাবেরগণের অধীনস্থ ছেলেরা যে পরাটি যেদিন তারাবীতে পড়তেন, সেই পারাটি দিন-রাতে ত্রিশবার পড়ার কথা শুনেছি বা কিতাবে পড়েছি। হযরত শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া কান্ধালবী সাহেব (রহ.)-ই তো তারাবীহ পড়ানোর কালে রাতদিনে পারাটি ত্রিশবার পড়তেন। এতে তাঁদের (রমযান) মাসে ত্রিশ খতম হত। ইয়াদ তো মাশাআল্লাহ্, তাঁদের বছরব্যাপী নিয়মিত খতমের পর খতম পড়ার ফলেই হয়ে থাকত। কিন্তু পবিত্র রমযান মাসে কালামে এলাহীর খতম ত্রিশের কম হবেÑ এ ছিল তাঁদের চিন্তার বাইরে।
তো আমাদের হাফেজ ছাহেবগণ পবিত্র রমযানে দশ খতমও করবেন না? এমনিতে যারা হাফেজ নন, তাঁদের মধ্যেও তো কতক মানুষ রমযানে দশ খতম কুরআন পড়েন। আমাদের মরহুমা শাশুড়ী-আম্মা (হযরত শায়খুল হাদীছ রহ-এর প্রথম বিবি) রমযানে দশ খতম কেন, আরো বেশি তেলাওয়াত করতেন। মামা শ^শুর হযরত মাওলানা আমিনুল ইসলাম ছাহেব (রহ.) বলতেন, “বুবুজান রান্না করার সময়ও এক হাতে কুরআন শরীফ নিয়ে পড়েন, অন্য হাতে চামচ নিয়ে তরকারী পাকান।” হযরত হাকীমুল উম্মত (রহ.) তো বাদ ফজর কয়েক মাইল হাঁটতেন। আর এক মনযিল তেলাওয়াত করে সপ্তাহে খতম করতেন। আমাদের হাফেজ ছেলেদের ক’জন মাসে এক খতম পড়ে, তা তো আমাদের অজানা নয়। শোনা যায়, কতক হাফেজ আছে শুধু রমযানে তারাবীহ পড়ার জন্য কিছুদিন আগ থেকে তেলাওয়াত শুরু করে। আর সেই ছেলেরাই বলে কী যে, মাত্র চার পাঁচবার পড়াতেই তাদের পারা ইয়াদ হয়ে যায়। তাঁদের আরামপ্রিয়তা ও অলসতাহেতু ইয়াদের এই দুরবস্থার কারণে প্রায় মসজিদেই তারাবীতে হাফেজ রাখা হয় বেশি। কমপক্ষে তিন থেকে চারজন। তারপর লুকমার অবস্থা দেখেও বুঝা যায়, তাদের ইয়াদের অবস্থা কী?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।