চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
পবিত্রতম মাস! মাহে রমজান আমাদের মাঝে অতিবাহিত হচ্ছে। আরবি বারো মাসের মধ্যে মাহে রমজান বিশেষ কারণে অন্যান্য মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। এ মাস হচ্ছে মহান আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি হাসিলের মাস। রমজান মাস আগমণের সাথে সাথে মুসল্লী দ্বারা মসজিদ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কি অপরূপ সে দৃশ্য! পৃথিবী তখন পৃথিবী মনে হয় না, মনে হয় এক টুকরো জান্নাত। মানুষ সেজদায় লুটিয়ে পড়ে তার প্রভুর কুদরতি চরণে। মানুষ নিরবে-নিভৃতে দু’হাত উত্তলন করে কাকুতি-মিনতির সুরে ডাকতে থাকে তাদের মহান মালিককে। ক্ষমা লাভের আশায় রাত-দিন অশ্রুসিক্ত নয়নে বুক ভাসায়। তাছাড়া রমজান আমাদের ধৈর্য ও সহমর্মিতা শিক্ষা দেয়। মহানবী (সা.) পবিত্র রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, পবিত্র মাহে রমজান মাস দয়া, কল্যাণ ও ক্ষমার মাস। এ মাস মহান আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ মাস, এ মাসের দিনগুলো শ্রেষ্ঠ দিন, রাতগুলো শ্রেষ্ট রাত এবং এর প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত মূল্যবান। রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাসে আল্লাহর দস্তরখান আমাদের জন্য উন্মুক্ত।
রোজার আরবি শব্দ হলো সাওম, যার আভিধানিক অর্থ হলো বিরত থাকা, সংযত থাকা, উপবাস থাকা ইত্যাদি। পরিভাষায় সাওম বলা হয়, প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ, মুসলমান নর-নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী-সহবাস ও রোজা ভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমজান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকিম, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাস মুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমজানে রোজা রাখা ফরজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, অর্থাৎঃ- হে ইমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। (সূরা বাকারা-১৮৩)
নামকরণঃ- রমজান একটি আরবি শব্দ, এর শব্দমূল হলো রা-মীম-দোয়াদ। আরবি ভাষায় অর্থ হচ্ছে, অতিরিক্ত গরম, কঠিন সূর্যতাপ, দহন, প্রজ্বলন, তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া। রমজান মাসে যেহেতু নেক-আমলের কারণে বিগত গুণাহ বা পাপগুলো বিমোচিত হয়ে যায় কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়, সম্ভবত সে কারণেই এ মাসের নাম হলো রমজান। রোজার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদিস উপস্থাপন করা হলো। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোজা আমার জন্য, আমি নিজেই এর প্রতিদান দিবো। কিয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য একটি বিশেষ পানির হাউজ থাকবে, সেখানে রোজাদার ব্যতীত অন্য কারো আগমণ ঘটবে না। (মুসনাদে বাযযার-৫০৯৩)।
অন্য হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, মানুষের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করা হয়, একটি নেকির সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতাশ গুণ পর্যন্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, কিন্তু রোজা আলাদা। কেননা, তা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি নিজেই এর বিনিময় প্রদান করবো। বান্দা একমাত্র আমার জন্য নিজের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং পানাহার পরিত্যাগ করেছে। (সহীহ মুসলিম-১১৫১)। হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা নিজের উপর অবধারিত করে নিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার সন্তুষ্টির জন্য গ্রীষ্মকালে (রোজার কারণে) পিপাসার্ত থেকেছে, তিনি তাকে তৃষ্ণার দিন (কিয়ামতের দিন) পানি পান করাবেন। (মুসনাদে বাযযার-১০৩৯)।
অপর এক হাদিসে হযরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোজা হলো ঢাল। বান্দা এর দ্বারা নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবে এবং রোজা আমার জন্য আমিই এর পুরষ্কার দিবো। (মুসনাদে আহমদ-১৪৬৬৯) অন্যত্র বর্ণিত, রোজা হলো (জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ লাভের) ঢাল এবং সুরক্ষিত দূর্গ। অপর বর্ণনায় রযেছে, যে ব্যক্তি ইমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী-২০১৪)।
পিয়ারা নবী (সা.) হাদিস শরিফে ইরশাদ করেন, জান্নাতের একটি ফটক রয়েছে, যার নাম হলো রাইয়্যান। কিয়ামতের দিন রোজাদারগণ সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অন্য কেউ সেই ফটক দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে, রোজাদারগণ কোথায়? তখন তারা উঠবে। তারা ছাড়া অন্য কেউ যাবে না। যখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন রাইয়্যান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হবে, সুতরাং আর কেউ এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী-১৮৯৬)।
রোজাদারদের সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, রোজাদারদের জন্য দুটি আনন্দের মুহুর্ত রয়েছে, এক. যখন সে ইফতার করে তখন ইফতারের কারণে আনন্দ পায়। দুই. যখন সে তার রবের সাথে মিলিত হবে তখন তার রোজার কারণে আনন্দিত হবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন সে আল্লাহর সাথে মিলিত হবে, আর তিনি তাকে পুরষ্কার দিবেন, তখন সে আনন্দিত হবে। (সহীহ বুখারী-১৯০৪)। অতএব, উপরোল্লিখিত হাদিস থেকে বুঝা যায় যে, রমজান মাসে রোজা রাখলে জান্নাতের পথ সুগম হয়। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য সহজে লাভ করা যায়। জীবন অধ্যায়ের পাপরাশি মুছে যায়। পরিশেষে, দয়াময় প্রভু আমাদের রমজান মাসের সবকটি রোজা রাখার তাওফিক দান করুক। রোজা রাখার ফলে আল্লাহ আমাদের কামিয়াবী দান করুক এবং রোজাই হোক জান্নাত লাভের হাতিয়ার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।