Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিশ্চিহ্নের পথে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আশ্রয়ণ প্রকল্প

রামগতির চরআব্দুল্লায় মেঘনার ভাঙন

রামগতি (লক্ষ্মীপুর) সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০২২, ২:৩৮ পিএম

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মেঘনার ভাঙনকবলিত ইউনিয়ন চরআব্দুল্লাহ। চারদিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত এ ইউনিয়নটিতে মেঘনার ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে। ভাঙনের শিকার অসহায় পরিবারগুলোর আশ্রয়ের জন্য দুই যুগ আগে ইউনিয়নটির চরগজারিয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আশ্রয়ণ প্রকল্প। কিন্তু ভাঙনের কবলে পড়ে সেই আশ্রয়ণ প্রকল্পটিও এখন নিশ্চিহ্নের পথে। ইতোমধ্যে ওই প্রকল্পের ৯০০ ঘরের মধ্যে ৮৯৫টিই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অপর পাঁচটি ঘরও নদীতে বিলীনের মুখে। তাছাড়া বিগত এক দশকের ভাঙনে ইউনিয়নটির একটি ওয়ার্ড নদীতে সম্পূর্ণ বিলীন হওয়াসহ প্রায় ২৫ ভাগ এলাকা এখন নদীর গর্ভে। এতে বসতভিটা হারিয়ে কয়েক হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমতাবস্থায় মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধ করে কৃষি সম্ভাবনাময় এ ইউনিয়নটিকে রক্ষার দাবি এলাকাবাসীর।

সরেজমিন চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নের বিভিন্ন চর এলাকা ঘুরে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরের মোহনার কাছাকাছি হওয়ায় তিন যুগ আগ থেকে চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নে মেঘনার ভাঙন শুরু হয়। ভাঙনের মুখে পড়ে ইউনিয়নটির চরআব্দুল্লাহ নামক চরটি বিলীন হওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হন। এরই মধ্যে ইউনিয়নটিতে চরগজারিয়া নামে আরেকটি নতুন চর জেগে উঠলে সেখানে শুরু হয় বসবাস। একপর্যায়ে ইউনিয়নটির ছিন্নমূল ও নদীভাঙা ভ‚মিহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন ওই চরগজারিয়াতে সেনাবাহিনীর কারিগরি সহায়তায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওই আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। ২০০১ সালের ১৬ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ওই প্রকল্পটি উদ্বোধন করেন। দ্বীপ চরগজারিয়ার প্রায় ৯৭৩ একর খাস জমির ওপর নির্মিত ওই আশ্রয়ণে ৯টি কলোনীর ৯০টি ব্যারাক হাউজে ৯০০ ছিন্নমূল ও নদীভাঙা ভ‚মিহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। বসবাসের জন্য ব্যারাক হাউজে একটি কক্ষ ছাড়াও প্রতিটি পরিবারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এক একর করে কৃষি খাস জমি। এ ছাড়া মৎস্য চাষ, হাঁস-মুরগী ও পশু পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা এবং সমবায় পদ্ধতিতে ছোট ছোট উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য তাদেরকে দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা। ওইসব প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা, আশ্রয়ণের ৯টি দিঘীতে সমবায় ভিত্তিতে মাছ চাষ এবং বরাদ্দ পাওয়া খাস জমিতে চাষাবাদ সুবিধাভোগী পরিবারগুলোকে স্বপ্ন দেখায় স্বাবলম্বী হওয়ার। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করে করালগ্রাসী মেঘনা। কয়েক বছর পরই মেঘনার ভাঙন চলে শুরু হয় ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা ওই ভাঙনে আশ্রয়ণের নয়টি কলোনীর আটটিই বিলীন হয়ে গেছে। অপর কলোনীর মাত্র পাঁচটি ঘর বৃহত্তম এ প্রকল্পটির চিহ্ন হিসেবে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সেগুলোও নদীর খুব তীরে হওয়ায় নেই বসবাস। দু’-এক সপ্তাহের মধ্যেই এগুলোও হারিয়ে যাবে নদীরগর্ভে। এতে করে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে প্রকল্পটি।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত এক দশকের ভাঙনে চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড সম্পূর্ণ, ২, ৩, ৫ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২৫ ভাগ এবং ৪, ৬ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ১৫ ভাগ এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এতে চরসেবাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসলামপুর নুরানী মাদ্রাসা, তিনটি বাজার, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক ও একটি মাটির কিল্লা ভাঙনের শিকার হয়েছে। নদীগর্ভে চলে গেছে শত শত একর ফসলি জমি ও হাজারো ঘরবাড়ি। এতে সহায়-সম্বল হারিয়ে সহ¯্রাধিক পরিবার অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

এলাকাবাসী জানান, নতুন চরআব্দুল্লাহ, চরমোজাম্মেল ও তেলিরচর নামে চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নের অংশে কয়েকটি নতুন চর জেগে উঠেছে। ইতোমধ্যে ভাঙনের শিকার মানুষেরা ওইসব চরে নতুন করে বসতি স্থাপন করেছেন। কিন্তু ওইসব চরের শত শত একর ভুখন্ড ইউনিয়নটির ওয়ার্ড সীমানায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই নাগরিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে ইউনিয়নটির ওয়ার্ডগুলো পুনর্বিন্যাস করে সেখানে নতুন নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের দাবি জানান তারা।

চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. তছলিম জানান, মেঘনার ভাঙন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাসহ চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নের জনগণ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। উপজেলার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং চারদিকে মেঘনা নদী বেষ্টিত হওয়ায় সেখানে বসবাসকারীদের দুর্ভোগ লেগেই থাকে। তাই, নাগরিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে ওইসব সমস্যা সমাধানসহ নদীভাঙন রোধের উদ্যোগও নেওয়া জরুরী বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মঞ্জুর বলেন, চরগজারিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পটি এ ইউনিয়নের গরীব-অসহায় মানুষদের নতুন করে বেচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু ভাঙনের মুখে পড়ে সেটি আজ নিশ্চিহ্নের পথে। মেঘনার ভাঙন চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নবাসীকে এভাবেই বারে বারে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় সরকার এ ইউনিয়নের মানুষদের জন্য ভাঙনরোধের ব্যবস্থা ও নতুন আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণসহ শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তুনু চৌধুরী জানান, চরগজারিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তাছাড়া ওই ইউনিয়নে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তারা আন্তরিক রয়েছেন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান জানান, চরআব্দুল্লাহ ইউনিয়নটি উপজেলার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রায় আট থেকে ১০ কিলোমিটার মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। যে কারণে, ওই এলাকার মানুষেরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নদী ভাঙনসহ বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তাই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি ওইসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন বলে জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙন

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ