Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দখলে দূষণে বিপন্ন কক্সবাজারের নদী

মাতার বাড়ি প্রকল্পের জন্য কোহেলিয়া ভরাট হওয়ায় বিপাকে জেলে ও লবণ চাষিরা পাহাড় কাটার কারণে খরস্রোতা বাঁকখালী নদী সরু খালে পরিণত হয়েছে বাঁকখালী নদী ড্রেজিং করার উদ্যোগ নিলেও রহস্যজনক

শামসুল হক শারেক | প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০২২, ১২:০৬ এএম

ভারত ফারাক্কা বাঁধসহ অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এ দেশের নদ-নদী এ খন মৃত্যুর মুখে। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, সুরমাসহ প্রধান প্রধান নদীতে পানি নেই। নদীর বুকে ধূ ধূ বালুচর। কোথাও কোথাও নদীর বুকে হচ্ছে ফসলের চাষ। পাহাড়ি নদীগুলোরও একই অবস্থা। নদীর বুকে পানি নেই। শুকনো জীর্ণ-শীর্ণ মরা খালে পরিণত হয়েছে। এতে কমছে মাছ ও জলজ প্রাণী। বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র, কৃষি অর্থনীতি এবং জলবায়ুর ওপর।

দখলে দুষণে বিপন্ন পর্যটর নগরী কক্সবাজারের প্রধান তিন নদনী বাঁকখালী, মাতামুহুরি ও কোহেলিয়া। এ ছাড়াও এ সব নদীর সাথে সংযুক্ত অসংখ্য খাল-ছরাও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভূমি দস্যুদের কবলে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে উন্নয়নের নামে চলছে এই নদী দখল-দূষণ। এতে বিঘিœত হচ্ছে স্বাভাবিক জনজীবন, ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকা মিয়ানমার সীমান্ত থেকে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁকখালী নদীর প্রশস্ততা ছিল ১২০ মিটার। কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত দখলের কারণে নদীর প্রশস্ততা কমে কক্সবাজার শহরের কোথাও ৫০ মিটার, কোথাও ৬০-৭০ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় খেকোদের পাহাড় কাটার কারণেও খর¯্রােতা বাঁকখালী নদী এখন ভরাট হয়ে সরু হয়ে গেছে। এই সুযেগে বাঁকখালীর বুকে অনেক জায়গায় ধান ও সবজি চাষ করেছেন দখলকারীরা। ওদিকে গত কয়েক বছর আগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন বাঁকখালী নদী ড্রেজিং করার উদ্যোগ নিলেও রহস্যজনক কারণে তা চাপা পড়ে আছে।

দ্বীপ উপজেলার মহেশখালী ও মাতারবাড়ির মাঝখানে অবস্থিত কেহেলিয়া কক্সবাজার জেলার অন্যতম নদী। মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল ও পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড কোহেলিয়া নদীর ৭.৪ কিলোমিটার অংশ ভরাট করে রাস্তা নির্মাণ করে নদীর গতি পথে বাধা সৃষ্টি করে। এতে প্রভাব পড়ছে নদীর দু›পাশের হাজারো মানুষের জীবন জীবিকায়। এই নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন মহেশখালী মাতারবাড়ী, কালারমারছড়া ও ধলঘাটা, ইউনিয়নে বসবাসরত দরিদ্র দুই হাজারের অধিক জেলে ও লবণ চাষি পরিবার। কোহলিয়া ভরাটের কারণে তাদের জীবন জীবিকায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকা দেশের লবণশিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নদী দিয়ে বছরে চার-পাঁচ মাস গড়ে দৈনিক ২০-২৫টি লবণের নৌকা যাতায়াত করত। এখন তা বন্ধ রয়েছে। এই নদী ভরাটের কারণে লবণচাষি, সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছে।

উন্নয়নের নামে নদী দখল ও দূষণ চলছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, দেশের অন্যান্য নদীর ন্যায় কক্সবাজারের মহেশখালীর কোহেলিয়া নদীরও অবাধে দখল দুষণ চলছে। এই নদীর উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে উন্নয়ন কর্মকান্ডের কয়লাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নেওয়া হচ্ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে কোহেলিয়া নদী বাঁচানো যাবে না। নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় নেমে আসবে।
কক্সবাজার জেলার নদীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, দূষণ রোধ এবং অবৈধ দখল প্রতিকারের জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রæয়ারিতে জেলা নদী রক্ষা কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র।

অথচ এই পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের নামই রয়েছে নদী দখলদারদের তালিকায়। পর্যটন শহর কক্সবাজার এর প্রাণ বাঁকখালী নদীর অবৈধ দখলদারের একাধিক তালিকায় রয়েছে পৌর মেয়রের নাম। বিআইডবিøউটিএ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রথম অবৈধ দখলদারদের তালিকা করে। ৫১ জনের ওই তালিকায় ৮ নম্বরে ছিলেন মুজিবুর রহমান। ২০২০ সালের ১৩১ জনের তালিকায়ও তাঁর অবস্থানের হেরফের হয়নি। তিনি শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকায় বাঁকখালী নদীর এক হাজার বর্গফুট জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে মেয়র মুজিবুর রহমানের বক্তব্য হচ্ছে- তিনি বাঁকখালী নদীর কোন জায়গা দখন করেননি। এগুলো তাঁর পৈত্রিক সম্পদ। তবে বিআইডবিøউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, মেয়র মুজিবুর রহমান এখনো নদীর জায়গা দখল করে আছেন। তাঁর স্থাপনা এখনো উচ্ছেদ করা হয়নি।

এদিকে পর্যটন শহরে প্রতিদিন উৎপন্ন ১২০-১৩০ টন বর্জ্য সংগ্রহ করে ট্রাকে করে কস্তুরাঘাট এলাকায় নদীর জায়গায় ফেলা হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১২ সাল থেকে এখানে বর্জ্য ফেলা শুরু হয়, যা এখনো চলছে। এতে করে নদীর বিরাট এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। সরেজমিনে কস্তুরাঘাট এলাকায় দেখা যায়, বছরের পর বছর ময়লা ফেলার কারণে সেখানে বর্জ্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এতে একদিকে হচ্ছে নদী ভরাট অন্যদিকে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। বাঁকখালী দখল বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে ২টি পৃথক মামলা আছে বলে জানা গেছে।

জেলার অন্যতম প্রধান নদী হচ্ছে চকরিয়ার মাতামুহুরি। এই নদীর দুই তীরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন লাখো মানুষ। প্রতি মৌসুমে এখানকার চাষিরা ধান ছাড়াও জোগান দিয়ে থাকেন পাঁচ-ছয় কোটি টাকার বেশি শীতকালীন সবজি। নদীর পাশে আছে শতকোটি টাকার চিংড়ি ও মৎস্য খামার। একটা সময় মাতামুহুরী চাষিদের কাছে আশীর্বাদ হলেও এখন ভর করছে আতঙ্ক। নদীতে যত্রতত্র মেশিন বসিয়ে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এতে নদীর দুই তীরের প্রতিরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে বসতি। এতে করে প্রতি বছর বর্ষায় নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় দু›কুল। বালু উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে নদীর ওপর তৈরি চারটি সেতু ও একটি রাবার ড্যাম। বালু উত্তোলন বন্ধ করে যোগাযোগ স্থাপনা রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপজেলা প্রশাসনকে তাগাদা দিয়েও প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে রয়েছে অভিযোগ।
মিয়ানমার সীমান্ত রেখায় নাফ নদী জেলার সবচাইতে বড় নদী। এতেও চলছে দখল-দুষণ। সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁধের ভেতরে নদীর বুকে অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক চিংড়ি ঘের। এতে নদীর স্বাভাবিক ¯্রােতে প্রতিবন্ধকতায় প্রতিবছর ভেঙ যায় বেড়িবাঁধ ও হয় ভূমি ক্ষয়। এছাড়াও জেলার ৯ উপজেলায় অবস্থিত ছোট বড় খাল ও ছড়া গুলোতে প্রতিনিয়ত চলছে পাহাড় খেকো ও বালু দস্যুদের আক্রমণ। পাহাড় কাটার কারণে খাল গুলো যেমন ভরাট হয়ে যাচ্ছে অপরদিকে বালু খেকুদের অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ছোট বড় ছড়া এবং খালগুলো গতিপথ পরিবর্তন করে মৃত্যুপ্রায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উখিয়ার রেজু খাল থিমছড়ি খাল, বড় ছড়া টেকনাফের খাইয়ুক খালি খাল ও ঈদগাঁও এর ঈদগাঁও খাল ইত্যাদি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ