Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

বাংকার থেকে ফেরার আকুতি

ইউক্রেনে আটকে পড়া ২৮ নাবিককে নেওয়া হবে মলদোভা হয়ে রোমানিয়ায়

চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২২, ১২:০০ এএম

ইউক্রেনের বন্দরে আটকে পড়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) জাহাজ এমভি বাংলার সমৃদ্ধির ২৮ নাবিক এখন সেখানকার একটি বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে কয়েকজন গতকাল শুক্রবার তাদের পরিবারের কাছে বার্তা পাঠিয়ে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, প্রাণ বাঁচাতে বাংকারে আশ্রয় নিয়েছেন। নিরাপত্তা পেলেই তারা সেখান থেকে মুভ করবেন।

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রকেট হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ থেকে গত বৃহস্পতিবার তাদের সরিয়ে নেওয়া হয় কিছুটা নিরাপদ বাংকারে। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে বাংকারে আশ্রয় নেওয়ার পরও তাদের আতঙ্ক কাটেনি। দ্রুত ঘরে ফিরে আসতে উদগ্রীব তারা। নাবিকদের স্বজনেরাও তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়ে আসছে।
এদিকে সরকারি তরফে বলা হয়েছে, ওই দেশে আটকে পড়া ২৮ নাবিক ও রকেট হামলায় নিহত জাহাজটির তৃতীয় প্রকৌশলী হাদিসুর রহমানের লাশ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইউক্রেন থেকে উদ্ধার এমভি বাংলা সমৃদ্ধির নাবিকদের মলদোভা হয়ে রোমানিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ইউক্রেন থেকে প্রথমে পাশের দেশ মলদোভা হয়ে রোমানিয়ায় নেওয়া হবে। এরপর রোমনিয়া থেকে দেশে ফেরানো হবে। গত বুধবার সন্ধ্যার দিকে জাহাজটিতে রকেট হামলা হয়। নাবিকদের প্রচেষ্টায় আগুন নেভানো গেলেও ব্রিজে থাকা জাহাজের তৃতীয় প্রকৌশলী হাদিসুর রহমানের মৃত্যু হয়। ওই জাহাজে ক্ষয়ক্ষতির আর উদ্বেগের মধ্যে বাংলা সমৃদ্ধিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ২৮ নাবিককে সরিয়ে নেওয়া হয়। হাদিসুরের লাশও তাদের সঙ্গেই রয়েছে।

এর আগে ইউক্রেনের শেল্টার হোম থেকে তাদেরকে প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড হয়ে ফেরানোর পরিকল্পনার কথা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় নাবিকদের উদ্ধারের গতিপথ পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা জানাল সরকার।

বাংকার থেকে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করছেন নাবিকেরা। তারা তাদের সর্বশেষ অবস্থা বর্ণনার পাশপাশি দেশে ফিরিয়ে আনার আবেদন করছেন। নাবিক ওমর ফারুক তুহিনের ভাই ওমর শরীফ জানান, আমার ভাই ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে বলেছে- এখন বাংকারে আছি, নিরাপত্তা পেলে মুভ করব। ইউক্রেনে রকেট হামলায় এক নাবিকের মৃত্যুসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল নগরীর বারিক বিল্ডিং এলাকায় বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাবিকদের স্বজনদের অনেকে জড়ো হন। সন্তানকে উদ্ধারের আকুতি নিয়ে সেখানে হাজির হন ওমর ফারুক তুহিনের মা মোছাম্মৎ খায়রুন্নেছা। সঙ্গে ছিলেন বড় ভাই ওমর শরীফ এবং মামা জহির উদ্দিন। সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধা খায়রুন্নেছা। তিনি বলেন, আমি খুব টেনশনে আছি আমার ছেলের জন্য। কীভাবে আমার ছেলেটাকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে, আমি জানি না। আমার ছেলেটি সুস্থ শরীরে ফিরে আসুক। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে আনেন। জাহাজে রকেট হামলার পর থেকে ছেলের সঙ্গে আর মোবাইলে সরাসরি কথা বলতে পারছেন না বলে তিনি জানান। বলেন, গত দুই দিনে আর কথা হয়নি। এখন শুধু ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছে।

এদিকে, ইউক্রেনে যুদ্ধে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজের ২৮ নাবিককে দ্রুত সময়ের মধ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) নেতারা। তারা একই সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে জাহাজ পাঠিয়ে বিএসসির জাহাজ পরিচালনায় যে গাফিলতি হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনেরও দাবি জানান। ওই কমিটিতে বিএমএমওএ’র দুই জন প্রতিনিধিকে রাখার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। গতকাল অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএমএমওএ’র সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন। এতে নিহত তৃতীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাদিসুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় বীর ঘোষণা এবং জীবিত ২৮ নাবিককে সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মাননা এবং পুরস্কার দেওয়ার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

এসময় উপস্থিত ছিলেন বিএমএমওএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহবুবুর রহমান, সহ সাধারণ সম্পাদক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. গোলাম জিলানি ও মো. ইফতেখার আলম। বিএমএমওএ’র পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয় জাহাজটি জেনে বুঝে কেন এই যুদ্ধকবলিত অঞ্চলে ঢুকল? ১৫ ফেব্রুয়ারি জয়েন্ট ওয়ার কমিটি জায়গাটি যুদ্ধকবলিত অঞ্চল ঘোষণা করে। জাহাজটি নোঙর করে ২২ ফেব্রুয়ারি, যা সম্পূর্ণ প্রশ্নবিদ্ধ। চার্টার পার্টি বিধিমালা অনুযায়ী কোনও জাহাজ কোম্পানি তার জাহাজের নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধকবলিত এবং দস্যুপ্রবণ এলাকাতে জাহাজ গমনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। এক্ষেত্রে জাহাজ মালিক বিএসসির পক্ষ থেকে জাহাজটিকে যুদ্ধকবলিত এলাকায় কেন গমনের অনুমতি দিল?

ইউক্রেনের অলিভিয়া সৈকতে আটকে পড়েছে সেতু
এদিকে, দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ফয়সাল আহমেদ সেতু কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক বিশ্বাসের ছোট ছেলে। সেতু বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ এমভি ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে ডেক ক্যাডেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে ইউক্রেনের অলিভিয়া সৈকতে অবস্থান করছেন। জাহাজটিতে ২৯ সদস্য নিয়ে ইউক্রেনের অলিভিয়া সৈকতে আটকে পড়েছে। এরই মধ্যে এ জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ঘটনায় ঘটে। এ হামলায় গোলাবারুদের আঘাতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো সমুদ্রতীরে জাহাজ নোঙর করে ২৮ জন আটকে আছেন। জাহাজটির ডেক ক্যাডেট হিসেবে কর্মরত থাকা ফয়সাল আহমেদ সেতুর পরিবার এমন তথ্য জানান।

সমুদ্রে চলমান অবস্থায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে মাইনের আতঙ্কে আটকে পড়ে জাহাজটি। গত বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার দিকে জাহাজটিতে বোমা হামলা হয়। এতে নিহত হন ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান। ফয়সাল আহমে তার পরিবারকে জানান, এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। এদিকে জাহাজটিতে যে পরিমাণ খাবার মজুত আছে, তা অল্প কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। সেতুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মা টলি খাতুন বলেন, যত দ্রুত সম্ভব আমার ছেলেসহ সবাইকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।

সাতক্ষীরায় দুশ্চিন্তায় ক্যাপ্টেন মনসুরুলের পরিবার
সাতক্ষীরা থেকে স্টাফ রিপোর্টারের দেয়া তথ্যে জানা যায়, ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে হামলার শিকার বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খান (৩৬) সাতক্ষীরা শহরের নারকেলতলা এলাকার বাসিন্দা। এলাকায় তিনি গিনি নামেই পরিচিত। তার বাবা সেলিম খান অবসরপ্রাপ্ত বিএডিসি কর্মকর্তা।
গত ২ মার্চ রকেট হামলার কবলে পড়ে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’র এক নাবিক নিহত হয়েছেন। জাহাজে জীবিত থাকা ২৮ জনের মধ্যে ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খান একজন। হামলার পর থেকেই চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের। যতদ্রুত সম্ভব ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খানকে কাছে ফিরে পেতে চান তারা।

ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খানের বাবা সেলিম খান জানান, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়িতে কথা বলেছেন ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খান। জানিয়েছেন, ভালো আছেন। সন্ধ্যার দিকে ইউক্রেনের ওয়ালভিয়া বন্দরে তাদের নামানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানেই আছেন তারা। তিনি আরও বলেন, ছেলের জন্য বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত। মা ও স্ত্রী সারাদিন কান্নাকাটি করছে।

ক্যাপ্টেন মনসুরুল আলম খানের তিন ছেলের মধ্যে ফাহিমি ও ফারহান (১০) যমজ, আর ছোট ছেলে ফারদিনের বয়স তিন বছর। সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জানিয়ে সেলিম খান বলেন, শিপিং অফিস থেকে যোগাযোগ করে বলেছে, আমরা উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছি, আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইউক্রেনিরা মাইন বসিয়ে রাখায় জাহাজটি বের হতে পারেনি। মনসুরুল আলম খানের বড় ছেলে ফারহান বলে, বাড়ির সবার মন খারাপ। আব্বুকে আমরা দ্রুত ফিরে পেতে চাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইউক্রেন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ