Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভাষা মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ নেয়ামত

রাশেদ নাইব | প্রকাশের সময় : ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম

মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যে মাধ্যম ব্যাবহার করে কথা বলে মূলত সেটাই হলো ভাষা। কখনো কখনো ভাষা হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যে নবজাতক নিজ হাতে কিছু খাওয়ার শক্তি রাখে না, এমনকি শক্ত খাবার গ্রহণ করার সেই সক্ষমতাও রাখে না, আধো আধো বুলি দিয়ে সে শিশুই খুব দ্রুত ভাষাকে রপ্ত করে ফেলে। তার মধুমাখা ভাঙা ভাঙা শব্দে জয় করে কঠিন যোদ্ধার মন। মহান আল্লাহ তাঁর এই আমূল নিয়ামতের কথা পবিত্র কোরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন। তিনি বলেন : পরম করুণাময়, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ (সুরা : আর-রহমান, আয়াত : ১-৪)।
পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারের বেশি ভাষা রয়েছে। এশিয়ায় প্রচলন আছে দুই হাজার ২০০ ভাষার। এর মধ্যে শুধু ভারতবর্ষে ব্যাবহার হয় ১৫০ এর চেয়েও বেশী ভাষা। বিশ্বে এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা পাখির ভাষায় কথা বলে! কথ্য বা লেখ্য ভাষার সাংকেতিক সংস্করণ হিসেবে শিস দিয়ে যোগাযোগ করে। এই শিস ভাষা আবার শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু আওয়াজ নয়, বরং বেশ কাঠামোবদ্ধ ও ব্যাকরণসম্মত।
পৃথিবীতে প্রায় ৭০টি স্বীকৃত শিস ভাষা নথিভুক্ত আছে, যাদের বেশির ভাগই প্রায় বিলুপ্তির পথে। কম্পাঙ্কের তীক্ষ তার দরুন শিসের আওয়াজ সহজেই আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় ধরতে পারে। এমনকি চার কিলোমিটার অবধি পৌঁছাতে পারে এই আওয়াজ। তাই বিস্তীর্ণ ক্ষেতসমৃদ্ধ কৃষিজীবী জনপদের আন্ত যোগাযোগে এ ভাষা বেশি প্রচলিত। মরক্কোর অ্যাটলাস বা হিমালয়ের পার্বত্য জনপদ, লাওসের মালভূমি, ব্রাজিলের আমাজন, এমনকি খরাবিদীর্ণ ইথিওপিয়ায়ও মানুষ শিসের সাহায্যে যোগাযোগ করত। গ্রিক পরিব্রাজক হেরোডটাস স্বয়ং ইথিওপিয়ান শিস ভাষার সাক্ষী। তাঁর কাছে এ ভাষা ছিল ‘বাদুড়ের কিচিরমিচির’-এর মতো। তুরস্ক, স্পেন, গ্রিসের প্রত্যন্ত কিছু অঞ্চলে আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে পাখির ভাষা। ভাষার বৈচিত্র্য মহান আল্লাহর বিস্ময়কর নিদর্শন ও বিশেষ নিয়ামত। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতালা ইরশাদ করেন ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। (সুরা রুম : আয়াত ২২)।
ভাষা মানবজীবনের সুন্দরতম দিক। এর মাধ্যমে বিকশিত হয় মানুষের ব্যক্তিত্বের শোভা ও সৌরভ। মহান আল্লাহ তাঁর আসমানি কিতাবগুলো বিভিন্ন ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন। যেমন—দাউদ (আ.)-এর গোত্রের মাতৃভাষা ছিল ইউনানি। তাই ‘জাবুর’ ইউনানি বা অ্যারামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। এভাবেই তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে হিব্রু ভাষায়। ইঞ্জিল অবতীর্ণ হয়েছে ইউনানি বা গ্রিক ভাষায়। আর পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবি ভাষায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে স্বজাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়। (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ০৪)।
উপরোক্ত আয়াতগুলো দ্বারা বোঝা যায়, মাতৃভাষা মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ কারণেই মহান আল্লাহ প্রত্যেক নবী (আ.)-দের তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছেন। মাতৃভাষায় আল্লাহর দিকে আহ্বান করলে মানুষ তা খুব সহজেই গ্রহণ করবে। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের টান স্বভাবগত। মাতৃভাষার সম্মান রক্ষা করার জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। যার প্রমাণ আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ দেখতে পেয়েছি ১৯৫২ সালের ০৮ ই ফাল্গুনেই। সেখানে আমাদের সোনার ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলা চেয়ে রাজপথে তাজা রক্তের বন্যা প্রবাহিত করেছে।তবুও মাতৃভাষাকে অর্জন করেছে।
প্রত্যেক নবী নিজ নিজ ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষাভাষী।’ একইভাবে পবিত্র কোরআনে হজরত মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে হজরত হারুন (আ.)-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৩৪)। নি:সন্দেহে এসব আয়াত ও হাদিস মুসলিম জাতিকে মাতৃভাষার প্রতি যত্নবান এবং তার আন্তরিক চর্চার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। বরং নির্দেশ প্রদান করে। তাই আমাদের সবার উচিত বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগ করা।
বাংলা ভাষা খুবই চকমৎকার ভাষা। সাবলীল ভাষায় মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। সন্তানদের এমন পরিবেশ উপহার দেওয়া, যেখানে তাদের শব্দভাণ্ডারে কোনো অশ্লীল, কুফরি ও অকৃতজ্ঞতার শব্দ স্থান পাবে না। জ্ঞান অর্জন ও দাওয়াতি কার্যক্রমের জন্য বিদেশি ভাষা শিখতেও আপত্তি নেই। এ বিষয়টিকে ইসলাম নিরুৎসাহ করেনি। রাসুল (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-কে ইহুদিদের ‘ইবরানি’ ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ১৫ দিনে তা আত্মস্থ ও কণ্ঠস্থ করে ফেলেন।
তবে বিদেশি শব্দের অতিপ্রয়োগ যেন নিজের মায়ের ভাষাকে বিকৃত করে না দেয়। ভাষা বিকৃতি ও মিশ্রকরণের কুপ্রভাব সমাজের সব স্তরেই দিন দিন বাড়ছে। পরিবারে, পথেঘাটে, অফিসে, বাজারে—সবখানেই যেন দিন দিন এর জয়জয়কার চলছে। অতি বিদেশপ্রেম ও স্মার্টনেস যেন আমাদের অস্তিত্বই বিলীন করে না দেয়। পাশাপাশি কেউ যেন কারো আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে কাউকে ছোট না করে। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টিকে তাচ্ছিল্য করার অধিকার কারো নেই। সর্বপরি ভাষা মহান আল্লাহ'র অশেষ নেয়ামত। আমরাও সেই নেয়ামতের যথার্থ ব্যাবহার করবো। ইনশাআল্লাহ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ