Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঈমান পরিচিতি এবং সংশয়ে করণীয়

মুফতী বেলাল রাজী | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:১০ এএম

আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। সোনা-রুপা কিংবা মণি-মুক্তাকে আমরা সবচেয়ে দামি মনে করি। কিন্তু বাস্তবে তার চেয়েও দামি হলো আমার ঈমান। কারণ, ঈমান ছাড়া সারা জীবনের আমল বৃথা। মানুষের উপর সর্বপ্রথম ফরজ হলো ঈমান। সমস্ত আমল ও ইবাদত, পরকালীন মুক্তি সবকিছু ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। ঈমান-আকীদা হলো বুনিয়াদ, আর আমল-আখলাক হলো তারা শাখা। তাই নেকআমল ছাড়া কেবল সঠিক ঈমান থাকলেও স্বীয় অপরাধের সাজাভোগের পর একদিন সে জান্নাতে যাবেই।
ঈমানের শাব্দিক অর্থ : ঈমান শব্দটি আরবি। শাব্দিক অর্থ- শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করা, বিশ্বাস করা, স্বীকার করা ইত্যাদি। ঈমানের পারিভাষিক অর্থ : ‘ঈমান’ এর পরিচয় দিতে গিয়ে আলেমগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন- ১. ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মতে- ‘আন্তরিক বিশ্বাস এবং মৌখিক স্বীকৃতির নাম হলো ঈমান।’ ২. ইমাম গাযালী (রহ.)-এর মতে- ‘রাসূল (সা.)-এর আনীত সকল বিধানসহ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলে। তবে মৌখিক স্বীকারোক্তি হচ্ছে পার্থিব বিধান চালু হওয়ার শর্ত। উক্ত স্বীকারোক্তিকে কাজে-কর্মে বাস্তবায়ন করা পূর্ণাঙ্গ ঈমানের জন্য শর্ত।
বিশুদ্ধ ঈমানের গুরুত্ব : মানুষের স্বভাবজাত ও বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশুদ্ধ বিশ্বাসই হচ্ছে তাদের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি এবং পরিচালিকা শক্তি। শুদ্ধ বিশ্বাস মানুষকে দেয় প্রশান্তি। পক্ষান্তরে অশুদ্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার মানুষকে ডুবিয়ে মারে অস্থিরতা ও হতাশায়। ঈমান ও আমলের সমন্বয় হচ্ছে ইসলাম। সহীহ ঈমান-আকীদাই হচ্ছে ইসলামের মূলভিত্তি। আমাদের যত ইবাদত, সবগুলো কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে বিশুদ্ধ ঈমান। যদি এতে কোনো ভুল-ত্রুটি তথা কুফর ও শিরক মিশ্রণ থাকে, তাহলে কিছুই কবুল হবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : ‘যে ব্যক্তি পরকালে কল্যাণ কামনায় চেষ্টা করে, এমতাবস্থায় যে সে মুমিন, তাহলে তার চেষ্টা ও কর্ম কবুল করা হবে।’ (বনী ইসরাঈল : ১৯) ‘এবং পুরুষ ও মহিলা হতে যে কেউ সৎকর্ম করবে, এমতাবস্থায় যে সে মুমিন। তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (সূরা মুমিন : ৪০)। ঈমানদারদের কোনো ভয়-ভীতি ও পেরেশানী নেই। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- ‘মনে রাখবে! নিশ্চই আল্লাহর ওলিগণের কোনো ভয় নেই। তারা কোনো চিন্তাগ্রস্তও হবে না। আর তারা সেসমস্ত লোক যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়ার পথ অবলম্বন করেছে।’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৩)।
ঈমান বিষয়ে সংশয় হলে করণীয় : যেসকল বিষয়ে ঈমান রাখতে হয়, সেসকল বিষয়ে যদি কখনো মনে সন্দেহ জাগে। যেমন- (নাউযুবিল্লাহ) আসলেই আল্লাহ বলে কেউ আছেন কি? কিংবা থাকলে তাকে কে সৃষ্টি করেছেন? জান্নাত-জাহান্নাম আসলেই আছে কি? তদ্রুপ কুরআন, রাসূল, পরকাল, তাকদীর ইত্যাদি ঈমান সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে সন্দেহ জাগলে তিনটি আমল করণীয়। যথা- ১. ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বনির রজীম’ পড়ে নেওয়া। ২. ‘আ-মানতু বিল্লাহি’ অর্থাৎ আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলাম, পড়ে নেওয়া। ৩. উক্ত চিন্তা থেকে বিরত হয়ে অন্য কোনো চিন্তা বা কাজে লিপ্ত হওয়া। (মুসলিম শরিফ ১ম খণ্ড)।
ঈমান বাড়ে/কমে কীভাবে : ঈমান বৃদ্ধি করার অর্থাৎ ঈমানের মধ্যে নূর পয়দা করার সঠিক কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেমন- ১. ঈমানের আলোচনা করা। ২. ঈমানদারদের সাহচর্যলাভ করা। ৩. বেশি বেশি নেকআমল করা। পক্ষান্তরে কতিপয় কারণে ঈমান দুর্বল হয়ে যায়, এমনকি কখনো ঈমান বিনষ্টও হয়ে যায়। যেমন ১. বিদআতপূর্ণ আমল দ্বারা। ২. গোনাহ দ্বারা। ৩. কুফর-শিরকমূল কথা-বার্তা বলা কিংবা কুফরের ন্যায় কাজ করা।
যেসব বিষয়ে ঈমান রাখতেই হবে : সাতটি মৌলিক বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান। সেই সাতটি বিষয় হলো- ১. আল্লাহর প্রতি ঈমান। আল্লাহর প্রতি ঈমান অর্থ মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ে বিশ্বাস রাখা- ‘আল্লাহর জাত তথা অস্তিত্বে বিশ্বাস’। ‘আল্লাহর গুণাবলিতে বিশ্বাস’। ‘আল্লাহর একাত্মবাদে বিশ্বাস করা’। ২. ফেরেশ্তা সম্বন্ধে ঈমান। ফেরেশ্তা সম্বন্ধে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তারা আল্লাহর এক প্রকার নূরের সৃষ্টি মাখলুক, যারা পুরুষ বা নারী নন। কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি থেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ। তারা আল্লাহর আদেশের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম করেন না। তারা বিভিন্ন আকার-আকৃতি ধারণ করতে পারেন। আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।
৩. নবী ও রাসূলগণ সম্বন্ধে ঈমান। নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখার অর্থ হলো এই বিশ্বাস রাখা- ‘নবীগণ নিষ্পাপ’। ‘নবীগণ মানুষ, তাঁরা আল্লাহ বা আল্লাহ রূপান্তর নন। তাঁরা আল্লাহর পুত্রও নন; বরং তাঁরা আল্লাহর প্রতিনিধি ও বান্দা’। ‘নবীগণ আল্লাহর বাণী হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন’। ‘নবীদের ধারাবাহিকতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। তাঁর পর আর কোনো নবী আসবেন না’। ‘নবীগণ কবরে জীবিত। আমাদের নবী করিম (সা.)-ও কবরে জীবিত আছেন’। ‘সকল নবী-রাসূল সত্য পয়গাম্বর ছিলেন। সকলের প্রতিই ঈমান রাখতে হবে। তবে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনের পর অন্য সকল নবীদের শরিয়ত রহিত হয়ে গেছে’। ‘নবীদের অলৌকিক ঘটনা যাকে মু’জিজা বলে, মু’জিজায় বিশ্বাস করাও ঈমানের অন্তর্ভুক্ত’।
আল্লাহ্র কিতাব সম্বন্ধে ঈমান : আল্লাহ তা‘আলা মানব ও জিনজাতির পথ-প্রদর্শন এবং দিক নির্দেশনার জন্য নবীদের মাধ্যমে তাঁর বাণীসমূহ পৌঁছে দিয়েছেন। এই বাণী ও আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে বলা হয় কিতাব। এক বর্ণনা মতে সর্বমোট ১০৪টি কিতাব প্রেরণ করা হয়েছে। তন্মধ্যে চারটি হলো বড় কিতাব। যথাÑ ১. তাওরাত, হযরত মূসা (আ.)-এর উপর। ২. যাবূর, হযরত দাঊদ (আ.)-এর উপর। ৩. ইঞ্জিল, যা হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহর প্রেরিত আসল ইঞ্জিল বর্তমানে দুনিয়ার কোথাও নেই। বর্তমানে ইঞ্জিল বা বাইবেল নামে যে গ্রন্থ পাওয়া যায় তা মূলত মানুষের রচনা ও সংকলন। যুগে যুগে বিভিন্ন পাদ্রী ও খ্রিষ্টান পণ্ডিতগণ তাতে বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। ফলে এটি মানুষের মনগড়া, বিকৃত ও মানবরচিত ইঞ্জিলে পরিণত হয়; আসমানি আসল ইঞ্জিল নয়। ৪. কুরআন, যা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর নাজিল হয়েছে। আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে ঈমান রাখার অর্থ নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিশ্বাস করা- ১. এসমস্ত কিতাব আল্লাহর বাণী, মানবরচিত নয়। ২. আল্লাহ যেমন অবিনশ্বর ও চিরন্তন, তাঁর বাণীও তদ্রƒপ অবিনশ্বর ও চিরন্তন। ৩. কুরআন মাজীদ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ কিতাব। ৪. কুরআন শরীফ হেফাজতের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ওয়াদা করেছেন। তাই কুরআন অবিকৃত বলে বিশ্বাস করতে হবে।
৫. আখেরাত সম্বন্ধে ঈমান : আখেরাত সম্বন্ধে বিশ্বাস করার অর্থ হলো মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে কবর ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়। হাশর-নশর, জান্নাত-জাহান্নাম ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতেই বিশ্বাস করা। সুতরাং নিম্নোক্ত বিষয়াবলিতে বিশ্বাস রাখতে হবে- ক. কবরের সুয়াল-জবাব সত্য। খ. কবরের আজাব সত্য। গ. পুনরুত্থান ও হাশরের ময়দান সত্য। ঘ. আল্লাহ্র বিচার ও হিসাব-নিকাশ সত্য। ঙ. নেকী ও বদীর ওজন সত্য। চ. হাউজে কাউছার সত্য। ছ. পুলসিরাত সত্য। জ. সুপারিশ সত্য। ঝ. জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য। ৬. তাকদীর সম্বন্ধে ঈমান ‘তাকদীর’ অর্থ- পরিকল্পনা। আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বে সবকিছুর পরিকল্পনাও লিখে রেখেছেন। অতএব ভালো মন্দ সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে সংঘটিত হয়, এই বিশ্বাস রাখতে হবে। ৭. মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান দিবসের প্রতি ঈমান । আখেরাতের প্রতি ঈমান আনা একটি অপরিহার্য বিষয়। আখেরাত বলতে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়া, কেয়ামত, হাশরের ময়দান, আমলের হিসাব-নিকাশ, অবশেষে জান্নাত বা জাহান্নামে প্রবেশ করা ইত্যাদি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ