Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মরুর দুলালের (সা.) ইসরা ও মি’রাজ

পীরজাদা মুহাম্মদ এমদাদুল্লাহ শাজলী | প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:১০ এএম

মি’রাজ শব্দের আভিধানিক অর্থ-সিঁড়ি। ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ উচ্চ মর্যাদা, আধ্যাত্যিক পূর্ণতা, উর্দ্ধালোকে গমণ, বিশেষত: আল্লাহর নৈকট্য লাভ। রাসুলের মি’রাজকে ইসরা নামেও নামকরণ করা হয়েছে। মশহুর গণের মতে, ইস্রা ও মি’রাজ একই বাস্তবতার দুটি ভিন্ন ভিন্ন নাম। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ, নৈশ ভ্রমণ, লয়ে যাওয়া ইত্যাদি। যেন স্থান হিসেবে ঐ ভ্রমণের নাম মি’রাজ আর কাল হিসেবে ইসরা।
মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ইসরা আর আকসা হতে উর্দ্ধলোক পর্যন্ত ভ্রমণকে মি’রাজ বলে ও মন্তব্য পাওয়া যায়। ছাহাবীগণ কখনো ইসরা শব্দ বলে মি’রাজ বুঝাতেন, আবার কখনো শুধুমাত্র উর্দ্ধলোকে গমণ অর্থেই শব্দটি ব্যবহার করতেন। মি’রাজ বা ইসরা ঘটনা দুটি রাত্রিকালে সংঘটিত হয়েছিল-যে কারণে ইসরা শব্দটি উভয় ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মি’রাজ একটি সফর। ঐ সফর ছিল ‘আলমে-মূলক হতে ‘আলমে-মালাকুত, ‘আলমে-জাবারুত ও ‘আলমে-লাহুত পর্যন্ত। ‘আলমে মুলক ছিল হাবিবে খোদার (সা.) বাশারী হাকিকতের বিকাশ, ‘আলমে মালাকুতে মালাকী- হাকিকতের বিকাশ, ‘আলমে জাবারুত ও লাহুত ছিল হাক্কী হাকিকতের বিকাশ। ঐ সফর ছিল একজনের ভ্রমণ আর একজনের গ্রহণের সফর। রাসূলে দো’জাহা ছাড়া অন্য কোন নবী-রাসূল, ফেরেস্তা, জ¦ীন, মানব সন্তান তথা সৃষ্টিজগত এমন মর্যাদাপূর্ণ-সফরের গৌরব অর্জন করতে পারেন নি।
মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত রাসুলের ভ্রমণ এবং মি’রাজের ঘটনা ২৭ রজব রাতে সংঘটিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২৭ রজব মি’রাজের স্মৃতি বার্ষিকী মুসলিম বিশে^ পালিত হয়ে থাকে।
দয়াল নবীর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুয়্যতের ১২ সালে। কুরাইশদের তীব্র অত্যাচার, রাসুলের সহধর্মিনী হজরত খাদিজার ইন্তেকাল, চাচা আবু তালেবের মৃত্যু, তায়েফ গমণের হৃদয় বিদারক ঘটনা প্রভৃতি কারণে যখন রাসুল (সা.) সীমাহীন ব্যথিত ছিলেন তখন পবিত্র মি’রাজের সফরে হাবীবকে ধন্য করেন আল্লাহ তায়ালা।
কুরআন মাজিদেও সুরা বাণী ইসরাইলের ১নং আয়াতে সূরা নাজম এর ১-১৮ নং আয়াতে এবং সূরা তাকভীর এর ১৯-২৪নং আয়াত সমূহে মি’রাজের ঘটনা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে সুরাতুল ইসরার (বাণী-ইসরাইল) সমগ্র অংশেই মি’রাজের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। প্রথম দিকে রাসুল (সা.) এর মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণের বর্ণনা, মধ্য ভাগে উপদেশ ও নসিহত। অতঃপর পার্থিব দুঃখ কষ্ট ভোগ করার কারণে মু’মিনগণ যাতে ব্যথিত ও ভারাক্রান্ত না হয়, তদুদ্দেশ্যে পূর্বযূগীয় নবী-রাসুলদের ঘটনাবলী স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এতদসহ ইসলামের শত্রু কুরাইশদের শাস্তি সমন্ধে সতর্ক করে দেয়া। প্রসঙ্গক্রমে ইঙ্গিতে রাসুল (সা.) কে হিজরতের আদেশ দেয়া, অতঃপর মুসলিম উম্মার প্রতি মি’রাজের প্রতিক্রিয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। সবশেষে মু’মিনদের মধ্যে সাহস সঞ্চালনের উদ্দেশ্যে মুসা (আ.) মিশর হতে হিজরতে বাধ্য হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বন্ধুর মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ কুরআন মাজিদের সূরা নাজম এর ১-১৮ ও সূরা তাকভীর এর ১৯-২৪ নং আয়াতে মানবাত্মার আধ্যাত্যিক পূর্ণতা লাভের সর্বশেষ স্তরের কথা বর্ণনা করেছেন। কতটা কাছে আল্লাহ তাঁর হাবিবকে (সা.) নিয়েছিলেন কুরআনের বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়Ñ “ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ অথবা তারচেয়েও অল্প দুরত্ব রহিল” (সূরা নাজম; আয়াত-৯)। বলা প্রয়োজন এ স্তরে পৌছা সত্বেও মানবাত্মা মানবাত্মা-ই থেকে যায়, সে আল্লাহ হয়ে যায় না। সে নিশ্চয়ই আল্লাহতে আত্ম বিলীন হয়ে যায়। আল্লাহর মুখ দিয়ে কথা বলেন এবং তার ইচ্ছানুযায়ী প্রতিটি কার্য করে থাকেন।
ধারাবাহিক চলার গতিতে রাসুল সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছলেন। তৎপর জান্নাত ও জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করলেন। নবীজি জান্নাত পরিদর্শনে গেলে তাঁর সম্মানে ফুলের বাগানগুলো মধুর সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয়। জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে নবীজির সম্মানে জাহান্নামের আগুন নিভে যায়।
রাসুলে আরাবীর (সা.) মি’রাজ সফরে জিব্রাইল, মিকাইল (আ.) সহ ৫০ হাজার ফেরেস্তা রাসুলের খেতমতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বোরাক নামক বাহন বেহেস্ত হতে পাঠানো হয়েছিল। বোরাকের গতি ছিল বিদুৎতের গতি। অবতরণ কালে সামনের পা দু’খানা লম্বা ও আরোহন কালে পিছনে পা দু’খানা লম্বা হয়ে যায়। দৃষ্টির শেষ সীমানায় পা ফেলে বোরাক। তা ছাড়া রাসুলের মি’রাজের ঐ সফরে আরো ১০টি সোপান খেদমতের সৌভাগ্য লাভ করে বলে জানা যায়।
মরুর দুলালের মি’রাজ ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী সফর। যা সাধারণ জ্ঞানে বুঝা বড়ই দুরহ ব্যাপার। ঐ সফরে চক্ষু দ্বারা দেখার জন্য যেসব শর্ত পূরণ আবশ্যক সে সব শর্তের যাবতীয় বাধা রাসুলের চক্ষু হতে সরায়ে দেয়া হয়েছিল। শ্রবণের সাধারণ নিয়মাবলী অপসারিত হয়েছিল এবং স্থান কালের সব দুরত্ব তাঁর জন্য সংকুচিত করা হয়েছিল।
হাবীবে খোদার (সা.) মি’রাজের রাতের বিচরণ যতদুর পর্যন্ত হয়েছিল তাতে তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবী-রাসুলদের সকল শ্রেষ্ঠত্বকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বাইতুল মাকদিসে মুসল্লী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন নবী-রাসুলদের আত্মাসমূহ, বাইতুল মা’মুরে ফেরেস্তাকুল। ধন্য হয়েছিল আকাশ-বাতাস, আরশ, কুরসি, লাওহে-মাহফুজ, কলম, জান্নাত-জাহান্নাম তথা উর্দ্ধজগত। মি’রাজের রাতে সৃষ্টির নিদর্শন সমূহ বন্ধুকে দেখায়ে যুগ-জনমের ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন মহান আল্লাহ। আর নিদর্শন সমূহ দেখে চক্ষু শীতল করেছিলেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)।
একান্ত সানিধ্যের সফরে নিজস্ব পরিবেশে উর্দ্ধ দিগন্তে দুই ধনুকের ব্যবধানে নিকটবর্তী হয়ে যা অহি করার তা অহি করে- পরিপূর্ণ আত্মিক শক্তি সম্পন্ন করেছিলেন-মহান আল্লাহ্ তাঁর হাবীবকে (সা.)। ১৪০০ বছর পর আল্লাহর হাবীবের মি’রাজের স্মৃতি বার্ষিকী দিবস তথা মি’রাজুন্নবীর (সা.) লিখনীতে আমাদের মিনতী হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমাদের অন্তরে রাসুলের প্রেম দান করুন। আমিন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ