মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। তারা গর্বাচভের গৃহীত উদারপন্থী কর্মসূচি 'গ্লাসনস্ত পেরস্ত্রইকার' ব্যাপারে খুশি ছিলেন না। সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় গর্বাচভ বেঁচে গেলেন ঠিকই, কিন্তু নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। কারণ ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই এর মধ্যে স্বাধীনতার দাবী জোরালো হয়ে উঠেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুসের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গোপনে একটি চুক্তিতে সই করেছিলেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বাকি প্রজাতন্ত্রগুলোকে কিছু না জানিয়েই তারা এটি করেছিলেন। চুক্তিটি হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ পদত্যাগ করেন এবং তার জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
সেসময় কঠিন সময় পার করছিলেন মিখাইল গর্বাচভ। ততদিনে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। ১৯৮৯ সালে পতন হয়ে গেছে বার্লিন প্রাচীরের। কিন্তু তখনও পর্যন্ত টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিখাইল গর্বাচভ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক তখন পথ খুঁজছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি বলেন, সেসময় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান অগ্রাধিকার।
ইউক্রেন, বেলারুস এবং রাশিয়া- এই তিনটি প্রজাতন্ত্রের নেতারা বৈঠকে বসেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বৈঠকের জের ধরেই আকস্মিকভাবে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। বৈঠকটি হয়েছিল পশ্চিম বেলারুসে। ডেকেছিলেন বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ। তার সঙ্গে যোগ দেন রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক। ইউক্রেন ততদিনে স্বাধীনতার আকাঙ্খার কথা ঘোষণা করে ফেলেছে। কিন্তু বেলারুস তখনও সেরকম কিছু করেনি। বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ বলেছেন, বৈঠকে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে তার মনে এরকম কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল না।
তিনি চেয়েছিলেন শীতকালে বেলারুসে কীভাবে তেল এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে। "আমাদের অর্থনীতি তখন বড় ধরনের সংকটে।। আমরা জ্বালানির মূল্য পরিশোধ করতে পারছিলাম না। কেউ ঋণও দিতে চাইছিল না। আমাদের সাহায্য করার জন্য রাশিয়াকে অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম, যাতে শীতে আমাদের জমে যেতে না হয়," বলেন তিনি।
কিন্তু ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত করার পথ খোঁজাই ছিল ওই বৈঠকের একমাত্র আলোচ্য বিষয়। ক্রাভচুক বলেন শুশকেভিচ যখন তেল ও গ্যাসের কথা বলছিলেন, তখন তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না শুশকেভিচ কী বলছেন! "আমি ভেবেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্যই আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। কারণ সংকটের কারণে দেশের মানুষ তখন বিপর্যস্ত। দেশটি কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার জন্যই আমরা ওই বৈঠকে বসেছিলাম।"
বৈঠকের পূর্ব নির্ধারিত আলোচ্য-সূচি যাই হোক না কেন, রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিনসহ তারা তিনজনই জানতেন মিখাইল গর্বাচভকে না জানিয়ে এরকম একটা বৈঠকে বসা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, "মিখাইল গর্বাচভের নির্দেশে সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির গোয়েন্দারা আমাদের গ্রেফতার করতে পারতো। কারণ সোভিয়েত কেজিবি তখনও গর্বাচভের অধীনে। কিন্তু আমাদের বেলারুসের গুপ্তচর সংস্থার প্রধান বরিস ইয়েলৎসিনের গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন।"
"বৈঠকের প্রায় পনের দিন আগে থেকে প্রতিদিন তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন যে গ্রেফতার হওয়ার কোন ঝুঁকি নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেলারুসের গুপ্তচর সংস্থার প্রধান অবসর নেওয়ার পরে যখন রাশিয়ায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করলেন, তখন তিনি অনুতাপ করেছেন, কেন তিনি ১৯৯১ সালে আমাদের গ্রেফতার করেন নি," হাসতে হাসতে বলেন তিনি। রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক এবং বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ ১৯৯১ সালের ৭ই ডিসেম্বর বৈঠকে বসেন।
এর পরের দিন ৮ই ডিসেম্বর সকাল ন'টায় এই তিন নেতা তাদের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ জানালেন যে বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে সমঝোতার প্রথম পরিচ্ছদটি লিখতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। "আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লাইনটি আমি মনে রাখবো। এটি ছিল আমাদের সমঝোতার শুরুর লাইন। কোন ধরনের তর্কাতর্কি ছাড়াই এই লাইনটির ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম। লাইনটি ছিল এরকম: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর-এর কোন অস্তিত্ব আর নেই।"
লাইনটি শোনার পর বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ প্রথম বলেছিলেন যে, এতে সবার আগে সই করতে চান। এই চুক্তির ফলে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচভ কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন। তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে আরো কিছু ক্ষমতা তুলে দেওয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে কয়েক শতাব্দীর রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান ঘটলো। এটা ছিল বিরাট এক পদক্ষেপ। এর পরে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছিল যে, এই তিন নেতা সুস্থ মস্তিষ্কে এই চুক্তিতে করেছিলেন কি না।
ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক বলেন, "এরকম একটা জনপ্রিয় কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে যে আমরা মদ্যপ অবস্থায় এই চুক্তির খসড়া তৈরি করেছিলাম। এটা পুরোপুরি ভুল।" "এটা ঠিক যে সোভিয়েত রীতিতেই ঐ বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছিল এবং ঐ বাড়ির সবখানেই প্রচুর মদ পানের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কেউ তা স্পর্শ করেনি। আমরা এক একটা অনুচ্ছেদ তৈরির পর বড়জোর এক-দুই ফোঁটা ব্র্যান্ডি পান করতাম," বলেন তিনি।
এর পরের কয়েক ঘন্টায় চুক্তির মোট ১৪টি অনুচ্ছেদ গৃহীত হয়। রাত তিনটে নাগাদ তৈরি হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণার কাগজপত্র। তখন পুরো বিশ্বকে সেটা জানানোর পালা। বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, "ইয়েলৎসিন এবং ক্রাভচুক কৌতুক করে আমাকে বললেন, আমরা দু'জন মিলে আপনাকে মনোনীত করেছি গর্বাচভকে বিষয়টি জানানোর জন্য। তখন আমি হেসে বললাম, মিস্টার ইয়েলৎসিন, আমি আর ক্রাভচুক মিলে আপনাকে মনোনীত করছি আপনার প্রিয় বন্ধু প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ফোন করার জন্য।"
"এর পর আমি মস্কোতে মিখাইল গর্বাচভের অফিসে ফোন করি। কিন্তু তারা আমাকে গর্বাচভের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে দিচ্ছিল না। তারা আমার কলটিকে একজনের পর আরেকজনের কাছে দিচ্ছিল। আর আমাকে বারবার ব্যাখ্যা করতে হচ্ছিল, আমি কে, কোত্থেকে ফোন করেছি!" "আর ইয়েলৎসিন যখন দেখলেন আমি মস্কোতে টেলিফোনে কথা বলছি, তখন তিনি প্রেসিডেন্ট বুশকে ডায়াল করলেন। আর তার পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী আঁন্দ্রে কোজিরেভ আরেকটি লাইনে প্রেসিডেন্ট বুশের কথা অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। ইউক্রেনের নেতা লিওনিদ ক্রাভচুক দু'জনের কথা শুনছিলেন।"
এর মধ্যেই বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ টেলিফোনে গর্বাচভের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেলেন। এবারও তাদের দুজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন ইউক্রেনের নেতা ক্রাভচুক।
ইউক্রেনের নেতা ক্রাভচুক বলেন, "দু'জনের মধ্যে কঠিন আলাপ হচ্ছিল। গর্বাচভ তার ওপর খুব রেগে গিয়েছিলেন। তিনি বলছিলেন, আপনারা কী করেছেন! পুরো দুনিয়া উলট-পালট করে দিয়েছেন। সবাই তো আতংকের মধ্যে আছে।" "আমি গর্বাচভকে বললাম, আমরা কী ধরনের চুক্তিতে সই করতে যাচ্ছি। গর্বাচভ তখন বললেন, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কী হবে? তখন আমি বললাম, আসলে বরিস ইয়েলৎসিন এখন প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে কথা বলছেন। এবং প্রেসিডেন্ট বুশের মনে হয় আপত্তি নেই!" বলেন বেলারুসের প্রেসিডেন্ট শুশকেভিচ।
এর কয়েক ঘণ্টা পরেই বৈঠকে বসা তিন নেতা এ উপলক্ষে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে সই করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর এবার তাদের বাড়ি ফেরার পালা। বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ বাড়ি ফেরার পথে বুঝতে পারলেন, তারা যা করেছেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতোটা। তিনি বলেন, "গাড়িতে বাড়ি ফেরার সময় আমি রেডিও শুনছিলাম বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে তা জানার জন্য। খেয়াল করলাম, বার বার ইয়েলৎসিন আর ক্রাভচুকের নাম বলা হচ্ছে। আর যখন আমার নাম আসছে তারা সেটা ঠিকমত উচ্চারণ করতে পারছে না।"
"তারা কখনো বলছে চুকচোভিচ, কখনো শেশকোভিচ, আবার বলছে শাখোভিচ- যার যা খুশি বলছে। তখন আমি বুঝলাম- আমরা একটা বিরাট খবর তৈরি করে ফেলেছি।" তবে এর পরই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ। তিনি ভেবেছিলেন তাদের পার্লামেন্টের ৮২ শতাংশই সদস্যই কমিউনিস্ট এবং তারা যদি চুক্তিটি অনুমোদন না করে, তাহলে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
তবে শেষ পর্যন্ত তিনটি আঞ্চলিক পার্লামেন্টেই এই সমঝোতা অনুমোদন করা হয়। এরে পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোও এতে যোগ দিতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। লিওনিদ ক্রাভচুক হন স্বাধীন ইউক্রেনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন। আর বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লভ শুশকেভিচ ১৯৯৪ সালে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।