Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৃতদের জন্য জীবিত আপনজনদের করণীয়

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর
প্রিয়জনকে শেষবারের মতো একটু দেখার আকুলতা সবারই থাকে, এটা যেভাবে সত্য, সেভাবে এটাও সত্য যে, আমাদের প্রাণের ধর্ম ইসলামের নির্দেশ হলো, কেউ মারা গেলে, তার জানাযা, দাফন ইত্যাদি কার্য যেন খুব দ্রুতই সম্পন্ন করা হয়। বিভিন্ন হাদীসে দ্রুত দাফন কার্য সম্পন্ন করার ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ এসেছে। বিখ্যাত সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযা, দাফন ইত্যাদি খুব দ্রুত সম্পন্ন কর। সে যদি নেককার ও আমলদার মানুষ হয়, তাহলে তো তার জন্য অবারিত কল্যাণ ও নিয়ামত অপেক্ষা করছে, তোমরা তাকে সেই কল্যাণ ও নিয়ামতের দিকেই এগিয়ে দিলে আর যদি সে এমন না হয়, [বদকার হয়] তাহলে তো সে মন্দ, দাফনের মধ্য দিয়ে সে মন্দকে তোমাদের ঘাড় থেকে নামিয়ে দিলে। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৩১৫] অন্য আরেকটি হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা.কে বলেন, ‘হে আলী! তিনটি জিনিস বিলম্ব কর না। ১. নামায, যখন এর সময় হয়ে যায়। ২. জানাযার নামায, যখন জানাযা উপস্থিত হয়ে যায়। ৩. উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলে মেয়েদের বিয়ে। [জামে তিরমিযী, হাদীস:১০৭৫] উভয় হাদীসের ভাষ্য খুবই দ্ব্যর্থহীন। তা হলো, মাইয়িত যেমনই হোক, নেককার বা বদকার, তার দাফনকার্য দ্রুত সম্পন্ন করার মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ, হয়তো মাইয়িতের জন্য কিংবা জীবিতদের জন্য। পাশাপাশি রয়েছে প্রাণের নবীর নিদের্শ- ‘তোমরা মৃত ব্যক্তির জানাযা দাফন ইত্যাদি খুব দ্রুত সম্পন্ন কর। অযথা বিলম্ব কর না।’ কাজেই জানাযা, দাফন কার্য সম্পাদনে অযথা কালবিলম্ব করা মোটেই উচিত নয়।

২. জানাযায় উপস্থিত হওয়া
দ্বিতীয় করণীয় হলো, জানাযায় উপস্থিত হওয়া। জানাযার নামায যদিও ফরযে কেফায়া, কিছু মানুষ আদায় করলেই সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। কিন্তু হাদীসের ভাষ্যমতে জানাযার নামায জীবিতদের উপর মৃত ব্যক্তিদের হক বা অধিকার। পাশাপাশি মাইয়িতের জন্য তা দুআও বটে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- একজন মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের ৫টি হক বা অধিকার রয়েছে। ১. সালাম দিলে তার জবাব দেওয়া। ২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা-শুশ্রুষা করা ৩. মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় শরীক হওয়া। ৪. দাওয়াত দিলে তা গ্রহণ করা। ৫. হাঁিচদাতা আল হামদুলিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। [সহীহ বুখারী, হাদীস:১২৪০; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২১৬২]

জানাযা ও দাফনে অংশগ্রহণকারীর ফযীলত
এ জীবনে যারা যত বেশি মাইয়িতের ঘনিষ্ঠ ছিল, শেষ বিদায়ের সময় সাধারণত তারাই বেশি সঙ্গ দেয়। কাফন-দাফন, জানাযা সব পর্বেই তারা উপস্থিত থাকে। বাকীরা সাধারণত জানাযার নামায শেষে যার যার মতো চলে যায়। অথচ জানাযার নামায শেষে দাফন কার্যে অংশ গ্রহণকারীর জন্য রয়েছে অমূল্য পুরুস্কারের ঘোষণা। সিহাহ সিত্তাসহ হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাযার নামায আদায় করে, সে এক কিরাত পরিমাণ নেকি লাভ করে আর যে জানাযার নামায আদায় করে তার দাফন কার্যে অংশগ্রহণ করে তা শেষ করে আসে, সে দুই কিরাত পরিমাণ সাওয়াব লাভ করে। দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কিরাত হলো, উহুদ পাহাড়ের সমান। অথবা তিনি বলেছেন, দুই কিরাতের এক কিরাত হলো, উহুদ পাহাড়ের সমান [আবূ দাউদ,হাদিস: ৩১৬৮] জানাযা ও দাফনের জন্য খুব বেশি সাময় লাগে না। এরচে ঢেড় বেশি সময় আমরা বন্ধ-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে বা গোনাহের কাজে নষ্ট করে থাকি। অথচ জানাযা ও দাফনে অংশ গ্রহণের এত ফযীলত থাকা সত্ত্বেও আমরা অনেকে জানাযায় শরীক হই না। অনেকে আবার জানাযা পড়ে দাফনের পূর্বেই চলে আসি। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার। আল্লাহ তাওফীক দান করুন।

দাফন পরবর্তী সময়ে জীবিতদের করণীয়
১. দাফনের পরপরই তার জন্য দুআ ও ইস্তিগফার করা
দাফনের পর মৃত ব্যক্তির পরকালীন নাজাত ও সুখ-শান্তির জন্য আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের কিছু করণীয় থাকে। সেগুলোর মধ্যে সর্ব প্রথম করণীয় হলো, দাফনের পরপরই তার জন্য দুআ ও ইস্তিগফার করা। যদিও জানাযার নামাযই মাইয়িতের জন্য একটি দুআ। কিন্তু মনে রাখতে হবে দাফনের পরপরই তার শুরু হয় কবর জগতের সুওয়াল-জওয়াব বা প্রশ্নোত্তর পর্ব। পরীক্ষার শুরু সেখানেই। তাই জানাযা পড়েই ক্ষ্যান্ত করার সুযোগ নেই। দাফনের পরপরই তার জন্য দুআ ও ইস্তিগফার করা, যেন তার সুওয়াল-জওয়াব সহজ হয়; কবর জগতের প্রতি ধাপই যেন সহজে পেরিয়ে যেতে পারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এই আমলটি করেছেন। হযরত উসমান রা. বর্ণনা করেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো মৃত ব্যাক্তির দাফন কাজ শেষ করতেন, তখন তার কবরের পাশে দাড়িঁয়ে সাহাবীদের বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাই এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং আল্লাহর কাছে দুআ কর, তিনি যেন তাকে ঈমানের উপর দৃঢ় ও অবিচল রাখেন। কারণ এখনই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। [আবু দাঊদ, হাদিস:৩২২১] অন্য আরেকটি হাদীসে এসেছে-“মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সকল প্রকারের আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিন প্রকার আমলের সওয়াব তখনও পৌছতে থাকে। ১. সদকায়ে জারিয়া। ২. উপকারী ইলম। ৩. নেককার সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। [মুসলিম: হাদীস, ১৬৩১] পিতা-মাতা বা আপনজন মারা গেলে তাদের জন্য দুআ করা, দান-খায়রাত ও এমন কিছু করা যা মাইয়িতের আখেরাতে উপকারে আসে জীবিতদের অবশ্য কর্তব্য। এটি জীবিতদের উপর মৃতদের অধিকার বা হক। তাই কোনো আপনজন মারা গেলে দাফন পরবর্তী সময়ে তার জন্য বর্ণিত আমলগুলো করা উচত।

২. ঋণ পরিশোধ করা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে চলতে গিয়ে নানাজনের সাথে নানা রকমের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সম্পর্কের ভিতর দিয়ে অনেক সময় আর্থিক লেনদেনও হয়। ঋণ হয়। অনেকেই মৃত্যুর আগেই সেই ঋণ পরিশোধ করতে পারেন। অনেকেই আবার ঋণ আদায়ের আগেই চির বিদায় নিয়ে চলে যান। সেই ঋণ পরিশোধ করা মাইয়িতের আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনদের অবশ্য কর্তব্য। মরহুমের সম্পদ থাকলে তার সম্পদ দিয়েই ঋণ শোধ করবে। না থাকলে আপনজনদের কর্তব্য হলো, নিজেদের সম্পদ দিয়ে হলেও তার ঋণ আদায় করে দেওয়া। আদায় না করলে মাইয়িতকে পরকালে এ জন্য পাকড়াও করা হবে। আর ঋণ আদায় করে দিলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দিবেন। দেনার তালিকায় মানুষের আদায়যোগ্য ঋণ যেমন থাকতে পারে, তেমনি থেকে যেতে পারে শরীআতারে কোনো ফরয হুকুমও। যেমন কেউ ফরয হজ্ব আদায় না করেই মৃত্যু বরণ করেছে। তাহলে তার উত্তসূরিরা তার বদলী হজ্ব আদায়ের ব্যবস্থা করে দিবে। এভাবে কাযা নামায বা রোযা থেকে গেলে সেগুলোর ফিদইয়া আদায় করে দিবে। কোনো মান্নত থাকলে তাও পুরো করে দিবে। এক কথায় মাইয়িত কোনো ঋণ রেখে মারা গেলে, চাই মানুষের ঋণ বা আল্লাহর, [আল্লাহর ঋণ হলো, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি] উত্তসূরিরা তা আদায় করে দিবে। এটা তাদের দায়িত্ব। সাহাবী বুরাইদাহ রা. বলেন, আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছেই বসা ছিলাম। এ সময় জনৈক মহিলা এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমার এক বাদী আমি আমার মাকে দিয়েছিলাম। এখন তিনি ইন্তিকাল করেছেন। তাঁর কথা শুনে তিনি তাঁকে বললেন, তুমি তোমার মাকে দেওয়ার সুওয়াবও পেয়েছ। আবার মিরাছ হিসাবে সে বাদীর মালিক তুমিই হবে। এরপর উক্ত নারী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মায়ের উপর এক মাসের রোযা কাযা রয়েছে। (চলবে)

লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ