চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
তাই বলে তা মহামেদ হতে পারে না। ১৯৮৪ সালে মারা যাওয়া বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আবু মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহর উপর একটি দৈনিকে নিবন্ধ প্রকাশ করাা হয়। শিরোনাম ছিল- আবু মহামেদ হাবীবুল্লাহ: শ্রদ্ধাঞ্জলী। ভক্তের হাতে পড়ে মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ হয়ে গেলেন মহামেদ হাবীবুল্লাহ। তাও আবার মৃত্যুর পরে। এমনকি প্রবন্ধের ভিতরে যতবার তার উল্লেখ কর হয়েছে ততবারই মহামেদ উল্লেখ করা হয়েছে। এটি উদ্দেশ্যমূলক বানান বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার যত গন্ডগোল নামের আহমাদ শব্দ নিয়ে। কেউ লেখেন আহমেদ, কেউ লেখেন আহামেদ, আবার কেউ লেখেন আহম্মেদ, আহম্মদ, কিংবা আহাম্মেদ। অজ্ঞতার কারণে কেউ লিখলে তা শোধরানোর চেষ্টা করা দরকার কিন্তু জেনে শুনে লিখলে তাকে বারণ করবে কে? আহমাদ ‘ম’-এর সাথে আকার যুক্ত করে উচ্চারণই শুদ্ধ উচ্চানণ। তবে আহমদ উচ্চারণও দীর্ঘদিন শুদ্ধের কাছাকাছি হিসেবেই ধর্তব্য হচ্ছে। কিন্তু আহমেদ, আহম্মেদ, আহাম্মদ লেখার কোন অবকাশ নেই।
ইংরেজী স্টাইলে মুসলেম নামনূরুদ্দীন হয়ে যায় নূরেডীন। বিলেতের এ নূরেডিন পরে আর নূরুদ্দীন হতে পারে না। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইবনে সীনা এবসীন ছিলেন। ভ্রান্ত বিকৃতির এভাবে বেড়াজাল সৃষ্টি করে খ্রীস্টানগণ আমাদের অনেক মুসলিম মনীষীদেরকে শত শত বছর আটকে রেখে মুসলিমদের পরিচিতির সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এক্ষেত্রে হিন্দুদের ষড়যন্ত্রও কম নয়। তারা কখনো মুসলিম নেতাদের নাম, ইসলামী নাম শুদ্ধ করে লেখেন না। হিন্দু লেখকগণ সোহরাওয়ার্দিকে লেখেন সুরাবর্দী, জেনারেল ওসমানীকে লেখেন ওশমান, মুসলমান তাদের কাছে মুচলমান, ইসলাম হয়ে যায় এচলাম। কিন্তু মুসলিমদের মধ্যে যারা তাদের কঠিন নামের তারা বানানে ও উচ্চারণে কখনো ভুল করেন না। আবার অনেকে আছেন নামের বহমান শব্দকে বিকৃত বানানে রেহমান লেখেন। রহমান যেহেতু আল্লাহর নাম, তাই এ নামের বিকৃত বানান আইন করে হলেও বন্ধ করা উচিত। একইভাবে হুসাইন শব্দের বানান হোসেন লেখা হয় ভুলভাবে প্রায়ই। এসব থেকে প্রত্যেক মুসলিমই বিরত হওয়া প্রয়োজন।
মুসলিম সমাজে আবার পুরো নামকে বিকৃত করেও উচ্চারণ করা হয়। এ ধরণের বিকৃত উচ্চরণকারীগণ তিন ধরনের। ১ম শ্রেণী : এরা সাধারনত অশিক্ষিত। এরা আদর করেও প্রিয় সন্তানের নাম চাঁন্দুমিয়া হলে তাকে চাঁন্দু, শাসসুদ্দিনকে শামসু ডাকেন। অনেক সময় সংশোধনের কোন প্রচেষ্টায়ও তারা কর্ণপাত করেন না ২য় শ্রেণী: এরা কম-বেশী লেখা পড়া জানেন। এদেরকে ভুল ধরিয়ে দিলে এরা সংশোধিত হন। ৩য় শ্রেণী : এরা শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত। এরা ফ্যাশন বা আভিজাত্য হিসেবে বিকৃত উচ্চারণ করেন এবং লেখেন। এমনকি সংশোধনের উদ্যোগও তারা গ্রহণ করেন না। এরাই মুহামেদ, রেহমান, করিমকে ক্যারিম উচ্চারণ করেন ও লেখেন। তবে পূর্বোল্লেখিত আরবী তারখীম পদ্ধতিতে ১ম বৈধ এবং এটি বিকৃতির আওতায় পড়বে না।
আরেক ধরণের বিকৃতি রয়েছে যারা সাধারণভাবে নামকে বিকৃত করেন। যেমন হাসানকে হাসান্যা বা হাসু বলা। আবার আল্লাহর দাসত্বসূচক নামগুলোকে আল্লাহর নামে ডাকাও মারাত্মক ধরণের বিকৃতি। আবদুর রহমান, আবদুর রায্যাক এরূপ নাম গুলোকে আব্দুল বাদ দিয়ে রাহমান বা রায্যাক ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এ বিকৃতি মারাত্মক, কঠিন গুনাহ এবং অনেক ক্ষেত্রে ঈমানের পরিপন্থী। একইভাবে ফজলে রাব্বী, আশেক এলাহীকে, ফজলে ও আশেক বাদ দিয়ে রাব্বী, এলাহী ডাকাও ঈমান পরিপন্থী।
নামকরণে ইসলাম স্বীকৃত অনুষ্ঠান হচ্ছে আকীকা। যা জন্মের সপ্তম দিনে করা সুন্নাহ্। কিছু মুসলিম পরিবারে সুন্নাহ্ সম্মতভাবেই তা পালিত হয়। কিন্তু অনেক মুসলিম পরিবারেই তা সঠিকভাবে পালিত হয় না। প্রাচীন বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে জন্মের দিন আনন্দ উল্লাস করা হত। মুগল আমলে মীর্জা নাথানের পুত্র সন্তানে জন্ম উপলক্ষে এরূপ রাত্রি ব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছে। হাতির লড়াই, নুত্যগীত অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন। ইতালীয় পর্যটক মানুচি উল্লেখ করেছেন, সন্তান জন্মের পর থেকে ছয় সাত দিন উৎসব হত। এটিকে উৎসব ছট্টি (ষষ্ঠ দিবসের কৃত্য) নামে অভিহিত করা হত। এভাবে মুসলিমদের মাঝে বিকৃত উৎসবের ধারা তৈরি হয়। আবার কোথাও নামকরণের দিন হিসেবে জন্মের একাদশ বা দ্বাদশ দিনকে পালন করা হয়। এটি হিন্দুদের অনুশীলিত একটি রীতি। যা হিন্দু শাস্ত্র মনুর মতে এ কাজের প্রশস্ত সময়। তবে বর্তমানে বাংলাদেশে সপ্তম দিনে নামকরণের পরিবর্তে চল্লিশতম দিনেও নামকরণ করা হচ্ছে এবং অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে শরী’আহ্র অনুমোদনহীন অনেক কাজও অনুশীলিত হচ্ছে। আবার নামকরণের প্রক্রিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে একটি প্রক্রিয়া এমনও অনুশীলিত হয় যে, একজন মৈালভী ডাকা হবে। তিনি পুস্তক বন্ধ করে সু বা কাঁটা প্রস্তকের পাতার মধ্যে ঢুকাবেন। তারপর সুচবিদ্ধ জায়গাটা খোলা হবে এবং সে পাতার প্রথম অক্ষরটি তিনি গ্রহণ করবেন ও এর অর্থানুসারে শিশুর নামকরণ করবেন। অথচ ইসলামে এরূপ পদ্ধতি গ্রহণের কোন বিষয় বর্ণিত হয়নি। এটি বিদ্আত ও পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাধারণত ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে নামের ভাষা হবে আরবী। সারা পৃথিবীতে এটি অনুশীলিত রীতি। আমাদের দেশে অনেকে মাতৃভাষা অথবা আঞ্চলিক ভাষায় নামকরণের কথা বলে থাকের। বাঙ্গালী মুসলিমের নাম বাংলা ভাষায় হওয়ার ব্যাপারে প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুধী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মত প্রকাশ করলে তার সমকলীন বাংলা ও উর্দু ভাষাবিদ, সাহিত্যিক হেকিম হাবিবুর রহমান তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। একই অনুষ্ঠানে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লহকে হেকিম হাবিবুর রহমান ‘কবিরাজ বলি নারায়ণ’ বলে কয়েকবার সম্বোধন করলে তিনি হতচকিত হয়ে যান। পওে কথোপকোথনে হেকিম হাবিবুর রহমান এর ব্যাখ্যায় বলেন, তার মতে ডক্টর শব্দের বাংলা অর্থ কবিরাজ, শহীদ শব্দের অর্থ বলি, আল্লাহ শব্দের অর্থ নারায়ণ। অতএব ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর উচিৎ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে এফিডেবিট করে নিজের নাম বাংলা করে এ দর্শন বাস্তবায়নে পথিকৃতের ভ’মিকা পালন করা।
তার এ জবাবে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এ মত পরিত্যাগ করেন। এভাবে বাংলা অর্থ করলে আবদুল্লাহর অর্থ হবে ভগবান দাস, শহীদুল্লাহর অর্থ করলে হবে বলি নারায়ণ। তাহলে আমরা কি এরূপ বাংলা শব্দে নামকরণ করব? (নাউযুবিল্লাহ)
বাংলাদেশর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকের নাম বহু শব্দে প্রণীত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।