নারী দিবস ম্যারাথনে পাপিয়া চ্যাম্পিয়ন
‘নিরাপদ সমাজ, নিরাপদ নারী’-স্লোগানে অনুষ্ঠিত নারী দিবস রেগুলার ম্যারাথনে রেগুলার বাংলাদেশের পাপিয়া খাতুন চ্যাম্পিয়ন, হামিদা
আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা ব্যুরো : কবি রজনীকান্ত সেনের স্বাধীনতার সুখ কবিতাটি আজ বার বার মনে পড়ছে। বিশেষকরে যখন একটি দোঁচালা বেড়ার ঘরের সামনে বসে এক আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের গল্প শুনছি, ঠিক তখনই বার বার মনে উঁকি দিয়েছে ছোট্টোবেলায় পড়া শিশুতোষ এই কবিতার পঙক্তিগুলো- ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই। আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পড়ে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে...’! কুড়ে ঘরে থেকে শিল্পের বড়াই যে চলে, তার প্রমাণ আরো একবার দিলেন খুলনার খালিশপুর হাউজিং স্টেট বিআইডিসি রোডের নর্থ জোন বি বøকের ৭নং প্লটের টিনের ছাউনি আর মুলি বাঁশের বেড়া দেয়া অতি সাধারণ ঘরে জন্ম নেয়া এক তরুণ মেহেদী হাসান মিরাজ।
ভাবছেন হঠাৎ এত কাব্যিকতা কেন? যে গল্পটি আজ রচিত হয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটে, তার জন্য শুধু রজনীকান্ত নয়, স্বয়ং মহাকবি হোমারও বুঝি লিখে দু’চারটি চয়ন। বাসাটি তাও আবার নিজেদের নয়। বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানাধীন আওলিয়া গ্রামে জন্ম মেহেদী হাসান মিরাজের। জীবন-জীবিকার তাগিদে ২০০০ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে খুলনায় আসেন মিরাজের বাবা। তিন হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বসবাস করছেন তারা। অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে উঠান তলিয়ে ঘর ডুবে যায়। তখন কাঠের চুলা তলিয়ে যাওয়ায় রান্না-খাওয়ারও সমস্যায় পড়তো হতো তাদের। বিশ্বজয় করে গতকাল এই ছোট্ট কুঠুরিতেই পৌঁছেছে সোনার ছেলে মিরাজ। বেলা চারটায় বিসিবি ভবনে এসে এক সময়ের সতীর্থ আরেক বিশ্বজয় কার পেসার মুস্তাফিজের সঙ্গে দেখা করে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার ফ্লাইটে খুলনার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন এই ঘূণির নতুন বিস্ময়। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে রাত হয়ে যায়। তবে তাতে এতটুকু কমেনি আলোর বিচ্ছ¡ুরণ। বাবা-মা, একমাত্র ছোট বোন তো ছিলোই, পুরো এলাকার মানুষ এমনকি সোনার ছেলেকে দেখতে দূর-দুরান্ত থেকে আসা লোকে লোকারণ্য ছোট্ট উঠান। টেস্ট জয়ের পর থেকে ক্রিকেট ভক্তরা মিরাজের বাবা-মাকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাসায় ভিড় করছেন ফুল ও মিষ্টি নিয়ে। অনেকেই মিরাজের বাবার সঙ্গে ও বাসার সামনে ছবি তুলে ফেসবুকে দেবার পড়েছে হিড়িক। মিডিয়া কর্মীদেরও যেন ফুসরত নেই। খুলনায় ফিরলে কিভাবে মেহেদী হাসান মিরাজকে সংবর্ধনা দেয়া যায়; তা নিয়ে দিনভর চলেছে খুলনা জেলা প্রশাসন ও ক্রীড়া অঙ্গণে তোড়জোড়। তাদের ভিড়ে ছেলেকে অনেকদিন পর কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন মা মিনারা বেগম ও বোন রুমানা। দূরে দাঁড়িয়ে তখন দু’চোখে অঝর ধারায় বারি ঝড়াচ্ছেন বাবা জালাল হোসেন। অন্য সময়ের মত এ কান্না কষ্টের নয়, আনন্দের।
এমন এক মূহুর্তের সাক্ষী হতে পেরে নিজেকেই ধন্য মনে হচ্ছে। সেখানে গিয়ে জানা যায় বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত তারকার জীবন-কথা। অতি সাধারণ ঘরে বেড়ে উঠা মিরাজ এখন খুলনা তথা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব ছোঁয়া অনন্য উচ্চতায়।
কথা বলে জানা গেছে, মিরাজের বাবা রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভার মোঃ জালাল হোসেন, মা গৃহিণী মিনারা বেগম, একমাত্র বোন রুমানা আক্তার মীমকে নিয়েই ছোট পরিবার। ২০০০ সালের দিকে জীবন-জীবিকার তাগিদে মিরাজ ও মীমকে নিয়ে বরিশাল ছেড়ে খুলনায় আসেন জালাল হোসেন। খুলনার খালিশপুরে এসে ড্রাইভিং শিখে রেন্ট-এ কারের চালক হিসেবে রুটি-রুজির পথ বেছে নেন। তখন মিরাজের বয়স ৩, আর মীমের এক বছর বয়স। ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি চরম আগ্রহ ছিল মিরাজের। কাশিপুর মাঠেই হাতে কড়ি; তাছাড়া বিভিন্ন মাঠে, পাড়ার ভাইদের খেলার সময় গিয়ে হই-হুল্লোড় করতেন মিরাজ। এ জন্য অনেক সময় বাবার কঠোর শাসনও অগ্রাহ্য করতেন তিনি। বাবা-মা তেমন ক্রিকেট না বুঝলেও ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট পাগল ছিলেন মিরাজ। মাঝে মধ্যেই স্কুল পালিয়ে ক্রিকেট খেলতেন। কাশিপুর ও সরকারি বিএল কলেজ মাঠ থেকে শুরু করে অলিগলিতে, ফুটপাতে ক্রিকেটে মজতে দেখা যেতো মিরাজকে। দরিদ্র রেন্ট-এ-কার চালক বাবা জালাল হোসেনের কিডনীর জঠিলতায় মাস দশেক আগে অপারেশন করিয়েছেন। সেই থেকে এখনো আয়-রোজগারে যোগ দিতে পারেননি তিনি।
মিরাজের বাবা জালাল হোসেন বলেন, সামর্থ্য ছিলো না ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনে দেয়ার। কিন্তু তাতে থেমে যাননি মিরাজ। স্থানীয় কোচের সহযোগিতায় কঠোর অনুশীলনে তৈরি করেন নিজেকে। আমার ছেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে এতেই আমি খুশী। আল্লাহ ওকে আরো অনেক বড় করুণ। দেশের জন্য মিরাজ আরো সম্মান বয়ে নিয়ে আসুক, সেই দোয়া করি। বোর্ডের কেউ কল করেননি, তবে মিরাজ ফোন করেছে কয়েকবার।
মিরাজের একমাত্র বোন মীম বললেন, ভাইয়ার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে। বাড়ি আসতে চাইছে; কিন্তু ছুটি মিলছে না। ভাইয়াকে দেখার জন্য মাও অস্থির। ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসন তাদের ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি লিফট দিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, মিরাজের সাফল্যে তার পরিবার, স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী এবং পাড়া প্রতিবেশীদের পাশাপাশি খুলনার মানুষও আনন্দে দিশেহারা। শুধুই কি খুলনা সারা বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্ব মিডিয়ায় খালিশপুরের শ্রমিক অঞ্চলের টিনের ঘর ও বাঁশের বেড়ার ঘরে বেড়ে ওঠা ছেলেটির সুনাম গাইছে। গত ৩০ অক্টোবর ঢাকা টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ইংল্যান্ডকে ১৬৪ রানেই গুঁড়িয়ে দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। টাইগারদের ছুঁড়ে দেয়া ২৭৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালো করলেও মিরাজের বোলিং ঘুরনিতে ক্রিজে দাঁড়াতে পারেননি ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা। ফলে সাকিব-মিরাজ-তামিমদের জয়টা ১০৮ রানের। ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইংলিশদের হারালো টাইগারবাহিনী। যার হাতে পরাস্ত ইংল্যান্ড সেই ছেলেটি খুলনার খালিশপুরের। তাইতো খুলনায় মিরাজকে নিয়ে এতো উল্লাস, এতো মাতামাতি, মিষ্টির ছড়াছড়ি, এতো আবেগ, এতো অনুভূতি।
মিরাজের শিশুকালের কোচ মোঃ শাহনেওয়াজ জানান, কাশিপুর স্কুল মাঠ ও সরকারি বিএল কলেজ মাঠ থেকে শুরু করে অলিগলিতে, ক্রিকেট খেলতো মিরাজ। অসম্ভব ভালো খেলতো। বিভিন্ন সময় তাই ওকে ভাড়ায় খেলতে নিয়ে যেতো। তখনই বুঝেছিলাম মিরাজ একদিন ক্রিকেট বিশ্বে জায়গা করে নিবে। আজ সে স্বপ্ন পূরণ হলো। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়ের নায়ক মিরাজ-ই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।