Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এক ডাক্তার-নার্সে হাসপাতাল!

হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ায় রাস্তায় শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৫ এএম

রোগী ভর্তি করে ফেলা হতো বিলের ফাঁদে

সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আনা হতো

নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউ থাকার কথা, কিন্তু সেখানে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। এরমধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র দুটিতে। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর মাত্র একটি। করোনাকালে আইসিইউর চাহিদা বেশি থাকার সুযোগে অধিক মুনাফার ফাঁদ হিসেবেই অনুমোদন ছাড়াই চলছিল অতিরিক্ত চারটি আইসিইউ।

শুধু তাই নয়, ৩০টি সাধারণ বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৫টি। পরিচালনার বিধি মোতাবেক ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও নার্স রয়েছে মাত্র একজন। আর তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজনের দায়িত্বে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা। যদিও সেই নার্স ও চিকিৎসক আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। সাধারণ নার্স ও চিকিৎসক তারা।

রাজধানীর শ্যামলীস্থ আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে বিল পরিশোধ সংক্রান্ত দ্ব›েদ্ব চিকিৎসাধীন যমজ শিশুকে জোর করে বের করে দেয়ার পর যমজ এক শিশুর নির্মম মৃত্যু ও অপর শিশুকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের মালিক গোলাম সারওয়ারকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।
জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে টাকা দিতে না পারায় রাজধানীর শ্যামলীর আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল থেকে ৬ মাস বয়সী দুই যমজ শিশুকে বের করে দেয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়ার পথে যমজ শিশুদের একজন আহমেদ মারা যায়। তবে আরেক শিশু আব্দুল্লাহকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

শিশুদের মা আয়েশা বেগম বলেন, গত শনিবার বাচ্চা দুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের দুজনকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকায় পরদিন গত রোববার এক দালাল কম টাকায় ভালো চিকিৎসার কথা বলে শ্যামলীর আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ওই হাসপাতালে ৭২ ঘণ্টায় ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা বিল আসে। আমি গরিব মানুষ, এত টাকা দিতে পারব না জানালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে মারধর করে। তাদের পায়ে ধরলে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। আমার কাছে থাকা ৪০ হাজার টাকা নিয়ে অসুস্থ বাচ্চাসহ আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। পরে ফার্মেসিতে থাকা ওষুধের টাকা নেয়ার জন্য শাহিন নামের একজনকে আমার সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালে পাঠায়। আসার পথে আমার ছেলে আহমেদ মারা যায়। আমার সঙ্গে কেউ নেই, আমি একা। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।

আয়েশা বেগম আরো বলেন, আমার স্বামী বিদেশ থেকে অনেক কষ্টে টাকা পাঠিয়েছেন। তারা ভুয়া বিল করে আমার কাছ থেকে টাকা দাবি করেন। আমার একটা ছেলেকে হারিয়েছি। আরেক সন্তান আব্দুল্লাহকে ঢামেক হাসপাতালে পুলিশ ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। তার অবস্থাও ভালো নয়। আমাদের বাসা সাভারের রেডিও কলোনির বাতপাড়া এলাকায়।
এমন অভিযোগের পর গতকাল সকালে ওই হাসপাতালের মালিক গোলাম সারোয়ারকে গ্রেফতার করে। পরে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীর শ্যামলীতে বেসরকারি ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল’ এ সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ না করায় চিকিৎসাধীন যমজ শিশুকে জোর করে বের করে দেয়ার ফলে যমজ এক শিশুর মৃত্যু ও অপর শিশুর আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। নির্মম ও অমানবিক এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।

যমজ সন্তান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগী মোহাম্মদপুর থানায় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার পর র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে গতকাল শুক্রবার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে আমার বাংলাদেশ হাসাপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ারকে গ্রেফতার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার গোলাম সারওয়ার জানায়, আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দালাল নিয়োগ করা আছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেসরকারি ওই হাসপাতালটিতে গত ২ জানুয়ারি যমজ শিশুকে ভর্তি করা হয়।
ভর্তির পর থেকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয় অন্যথায় চিকিৎসা করা হবে না বলে জানায়। ভিকটিম ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। তবে অতিরিক্ত আরো টাকা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। টাকা না দেয়ায় চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয় বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। একপর্যায়ে অর্থ না পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ভুক্তভোগীর যমজ সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়।

গ্রেফতার সারওয়ার র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, সে দীর্ঘ ২০-২২ বছর যাবত রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ৬টি হাসপাতালে পরিচালনা করে আসছে। সেগুলো হলো ঢাকা ট্রমা, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডায়াগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিক্যাল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। এরমধ্যে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল বাদে সবই বন্ধ করেছেন নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ উঠার পর।

প্রায় এক বছর যাবত শ্যামলীতে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে তিনি দালাল সিন্ডিকেট জড়ান। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল হতে রোগীদের ফুসলিয়ে নিজের হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসতেন। গ্রেফতার আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক গোলাম সারওয়ার জানান, হাসপাতাল পরিচালনার বিধি মোতাবেক সার্বক্ষণিক ৩ জন চিকিৎসক ডিউটিরত থাকার কথা থাকলেও সার্বক্ষণিক একজন ডিউটিতে থাকত। হাসপাতালটিতে ২টি আইসিইউসহ ৩০টি বেডের প্রাধিকার রয়েছে। তার হাসপাতালে ৬টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। তন্মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে ২টির। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউবেটর ছিল ১টি ও ১৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। মূলত আইসিইউ কেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে সে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে।

অনুমোদন পাওয়ার শর্ত না মেনেও কি করে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন পেয়েছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্য র‌্যাব পেয়েছে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সে ধরণের শর্তপূরণের বিষয় তিনি ইন্সপেক্টশনে দেখিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করব।

অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে। যেহেতেু জোরপূর্বক নির্যাতন করে বের করে দেয়ায় যমজ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কি-না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে ময়নাতদন্তের বিষয় আছে। ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন মামলায় যে, তাকেসহ যমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়না তদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে।

 



 

Show all comments
  • Abul Kalam Azad Khan ৮ জানুয়ারি, ২০২২, ৯:৩৫ এএম says : 0
    এইসব ডাক্তার এবং হাসপাতালের মালিককে ধরে ধরে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো উচিৎ।
    Total Reply(0) Reply
  • মোজাম্মেল হক ৮ জানুয়ারি, ২০২২, ৯:৩৮ এএম says : 0
    এদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসপাতাল

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ