Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আইন বাস্তবায়নে অনীহা সরকারি কর্মকর্তাদের

প্রকল্প বাস্তবায়নে জমি অধিগ্রহণ-২ উন্নয়নের লক্ষ্যে অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা ঝুলিয়ে রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:১২ এএম

দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য অধিগ্রহণ করা জমির দাম ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার আইনে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে সরকার। অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করে ক্ষতিগ্রস্তদের সে টাকা দিতে গরিমসি করছে দায়িত্বশীলরা। কাগজে অহেতুক ভুল ধরে, আইনের মারপ্যাঁচের অজুহাত দেখিয়ে দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে জমির মালিকদের।
রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশেই একই অবস্থা। এমনকি কোথাও কোথাও অধিগ্রহণের রেওয়াজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রভা খাটিয়ে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করে উন্নয়ন করা করা হচ্ছে। জমির মালিকদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের আইন করে অধিগ্রহণকৃত জমির তিনগুন মূল্য দেয়ার ব্যবস্থা করলেও আমলারা কেন সে আইনের পথে হাঁটছেন না তা রহস্যজনক।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাস্তা সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৩ হাজার ৮ শত কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ভ‚মি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ আছে ১৬১ কোটি টাকা। অথচ জমি অধিগ্রহণের টাকা পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্তরা। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের ১২ ওয়ার্ডের বাইপাইল-কাশেম কটন মিল রাস্তা ভায়া হয়ে কাদের মার্কেট পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে ১৪৮ জন জমির মালিকের ভ‚মি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

এসব জমির ক্ষতিগ্রস্ত মালিককে টাকা না দিয়ে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ভ‚মি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে ১৪৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তরা জমির ক্ষতিপূরণ চেয়ে উচ্চ আদালতে মামলাও করেছেন বলে জানা গেছে। এ কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এদিকে রাতের আঁধারে রাস্তা খুঁড়ে বড় বড় গর্ত করে মনির কনস্ট্রাশন নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। করোনাকালে রাস্তায় গর্ত থাকার কারণে কাশেম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটিড, কাশেম ল্যাম্পস লি:, হনবিল গার্মেন্টস, মেঘনা নিটিং কারখানাসহ অনেক শিল্প-কলকাখানার মালামাল সরবরাহ করতে পারছে না। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অবস্থায় পড়ে থাকায় সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারছে না। এছাড়া গর্ত হওয়ার রাস্তার বালুতে এলাকার এবং মিল-কারখানার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিক কাশেম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসভীর উল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের জমি দখল করে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম অধিগ্রহণ ছাড়া প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পাইনি। আবার ঢাকার জেলার ৩০০ ফিট এলাকায় আমার বাবার জমি অধিগ্রহণ করেছে ২০১৫ সালে। যার কেস নম্বর ২০ ঢাকা জেলা। কিন্তু এ টাকাও তুলতে নানা হয়রানি করা হচ্ছে।

জমি অধিগ্রহণের টাকা দেয়া নিয়ে লুকোচুরি চলছে সারা দেশে। যেসব জেলায় উন্নয়ন কাজের জন্য অধিগ্রহণ করা হলেও জমির মালিকরা টাকা পাচ্ছেন না। সে জেলাগুলো হচ্ছে- রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ ২০১৭ সালে ভ‚মি অধিগ্রহণ আইনে তিনগুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ১৪৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। সেখানে ৬৭ কোটি টাকা সড়ক ও জনপথ বিভাগ দিয়েছে। এখনও ৭৮ কোটি টাকা বাকি রয়েছে। পুরো টাকা না দেওয়ায় জেলা প্রশাসক জমি অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে পারছেন না। ২০১৮ সালে শহরের মাঝখানে ৪ লেন এবং ৪ লেনের ২ দিকে ২ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণের মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। নলকা-সিরাজগঞ্জ-সয়দাবাদ সড়ক নামে ৩টি প্যাকেজে ২১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পটি।

এনুয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এডিপি) আওতায় জিওবির অর্থায়নে ২৬৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সেই মোতাবেক নলকা-চন্ডিদাস গাঁতী ও মুলিবাড়ি-মালশাপাড়া ২টি ২ লেন সড়ক নির্মাণকাজ; কিন্তু জমি অধিগ্রহণ করা হলেও তার টাকা পাচ্ছে না। জমির আমিনুল বলেন, ডিসি অফিসে গেলে খালি ঘুষ দিয়ে জমির টাকা তুলতে হয়। আবার ঘুষ না দিলে না হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। একই প্রকল্পের জমির মালিক জাহিদ হোসেন বলেন, শহরের মূল জায়গা স্বাধীনতা স্কয়ার কদম ফোয়ারা চত্বর। সেখানে এসেই ৪ লেনের কাজ কিছু দিন বন্ধ ছিল। পরে শুরু হলেও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে বরাদ্দ আসছে না।

এদিকে জমির দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়া ছাড়াও ২০১৭ সালে আইন সংশোধন করে জমির দাম তিন গুণ করায় জমি অধিগ্রহণের খরচ বেড়েছে। বগুড়ার সংযোগ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ঝুলে আছে ১৭ বছর, প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ১৫ গুণ। ২০০৪ সালে সাড়ে ৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। সেখানে ১৭ বছরের ব্যবধানে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২০৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১৫ গুণ।

পরে ২০১১ সালে প্রকল্প সংশোধন করে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়ার জনসভা থেকে এই সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দিলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নে সওজ অধিগ্রহণ ও নির্মাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু অনেকেই টাকা পাননি। সে বিষয়ে বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মো. সিরাজ বলেন, বগুড়ার প্রতি বর্তমান সরকারের অবহেলা, বঞ্চনার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প। সরকার দেশে সুষম উন্নয়ন করছে, তবে বগুড়াকে বাদ দিয়ে। ১৭ বছর ধরে প্রকল্পটি ঝুলিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। আর আমার এলাকার মানুষ ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছে না।

শরীয়তপুর-চাঁদপুর মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। এরইমধ্যে ৪টি গ্রুপে এ কাজের দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণও করা হয়েছে এখনো অনেই টাকা পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। শরীয়তপুর-চাঁদপুর মহাসড়ক উন্নয়নে সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮৫৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। এর মধ্যে ৯৫ দশমিক ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৪৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখনো অনেক টাকা পরিশোধ করতে পারেনি জেলা প্রশাসন। নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ সড়ক প্রশস্তকরণে ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এ সড়কের পাশে ৮৩২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া সড়কের উভয় পাশে অবস্থিত ৫টি মসজিদ, ২টি কবরস্থান, ২টি মাজার ও ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু তাদের টাকা এখনো পায়নি বলে জানা গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রকল্প বাস্তবায়ন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ